বাংলা প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের কৃষক - ১৫ প্যারা

উপস্থাপনা :

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের ৮০% লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বের আদিমতম শিল্পী কৃষক সমাজ ৷ কৃষকরা মাঠে কাজ করে ফসল ফলায়, সে ফসলে আমাদের অন্ন আসে। আমাদের কৃষকদের বাস্তবজীবন বড়ই বৈচিত্র্যময়। চরম কষ্ট আর ক্ষণিক আনন্দের খেলা চলে বাংলাদেশের কৃষকদের সংগ্রামী জীবনে। তাই কৃষকের সংগ্রামী জীবনকে আমাদের অবশ্যই সম্মানের চোখে দেখতে হবে ।

কৃষকদের পরিচয় : 

যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ক্ষেত-খামারে নানা শস্য ফলায় তারাই কৃষক। এ দেশের কৃষকদের একশভাগ গ্রামে বাস করে। তবে শহর-বন্দরের আশেপাশে কিছু কৃষকের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদে কোনো আড়ম্বর বা বাহুল্যতা নেই। 

প্রচণ্ড রোদে বৃষ্টিতেও লুঙ্গি, গামছা, গেঞ্জি বা ছোটখাটো শার্ট, পাঞ্জাবি ছাড়া তাদের গায়ে কোনো পোশাক দেখা যায় না। পূর্ণ মৌসুমের সময় তাদের নাওয়া-খাওয়া ও পোশাকের কোনো খবর থাকে না বললেই চলে ।

জাতীয় জীবনে কৃষকের গুরুত্ব :

বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে কৃষকের গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষক অহর্নিশি কঠোর পরিশ্রম করে যে সোনার ফসল উৎপাদন করে; তা গলাধঃকরণ করে এদেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ ক্ষুধার কঠিন জ্বালা থেকে মুক্তি লাভ করে । তাই কৃষক সকলের নমস্য।

আরও পড়ুন :- বাংলা রচনা: বাংলাদেশের কৃষক [ Class - 6, 7, 8 ,9 ,10]

কৃষকের অতীত ও বর্তমান : 

বাংলার কৃষকদের একসময় গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু ও পুকুর ভরা মাছ ছিল । কিন্তু তাদের বর্তমান অবস্থা বড়ই করুণ ও বেদনাদায়ক। চরম প্রতিকূলতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের জীবন কাটছে আজ ।

অতীত জীবন : 

বাংলাদেশের কৃষকরা এক সময় গৌরবময় জীবন যাপন করতো। ‘গোলাভরা ধান আর গোয়ালভরা গরু' –এ প্রবাদের সঙ্গে যে ঐশ্বর্য ও সুখকর জীবনের ইঙ্গিত জড়িত, তা আজকের দিনে রূপকথার মতো শোনালেও এক সময় এটা সত্যি ছিল। অবশ্য সে সুদিনের যথেষ্ট কারণও ছিল। তখন দেশের লোকসংখ্যা ছিল কম। 

জমির পরিমাণও ছিল বেশি। কৃষকরা যা ফসল উৎপন্ন করত, তাতেই তাদের সারা বছর বেশ ভালোভাবে চলে যেত। কালক্রমে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে চাষাবাদযোগ্য জমির ওপর প্রবল চাপ পড়েছে। বিশেষত ইংরেজ আমল থেকেই বাংলার কৃষককুলের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। যে ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে।

বর্তমান জীবনধারা : 

আমাদের দেশের কৃষকদের সমস্যা অনেক। রোগ-শোক, দুঃখ-দরিদ্র এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। অশিক্ষা- কুসংস্কারে তাদের জীবন দুর্বিষহ। দেশের কৃষকেরা অধিকাংশই অশিক্ষিত। এ অবস্থার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। যুগে যুগে বৈজ্ঞানিক পরিবর্তনে আজ বিশ্বের মানুষ সভ্যতার যে স্তরে এসে পৌঁছেছে, সে তুলনায় আমাদের কৃষক সমাজ অত্যন্ত পশ্চাদপদ হয়ে আছে। 

আরও পড়ুন :- ধান - বাংলা রচনা  [ ক্লাস ৬, ৭, ৮, ৯, ১০] - Sikkhagar

বাংলাদেশের কৃষক মান্ধাতার আমলের কৃষি ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। সেকেলে ভোঁতা লাঙ্গল আর একজোড়া কঙ্কালসার বলদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে এখন কৃষকেরও কঙ্কাল দেহই অবশিষ্ট রয়েছে। জমির উর্বরাশক্তিও কমে গেছে। জমি এখন বহু খণ্ডে বিভক্ত। এ ধরনের অসংখ্য প্রতিবন্ধকতায় বাংলাদেশের কৃষকদের জীবন দুঃখে-দারিদ্র্যে জর্জরিত হয়ে উঠেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে দেশের উন্নতি কোনো দিনই সম্ভব হবে না।

কৃষির গুরুত্ব : 

বাংলাদেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস পার্ট। আবার খাদ্য-শস্যের প্রাচুর্য না থাকায় দেশের প্রয়োজনীয় খাদ্য বিদেশ থেকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে আমদানি করতে হয়। ফলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয়। বাংলাদেশর অর্থনৈতিক উন্নতি এবং বিদেশের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্যে দেশের কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করতে হবে।

কৃষির উন্নতির উপায় : 

আমাদের কৃষির উন্নতি করতে হলে অশিক্ষিত নিরক্ষর কৃষকদেরকে আধুনিক প্রযুক্তির আলোকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শিক্ষা দিতে হবে। প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক ওষুধ, বীজের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারিভাবে কৃষকদেরকে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। 

বর্তমান বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তি ও চাষাবাদের আধুনিক পদ্ধতি সম্বন্ধে ধারণা দিতে হবে এবং তাদেরকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্বল্প মূল্যে প্রয়োজনে কিস্তির মাধ্যমে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

কৃষকদের শ্রেণিবিভাগ : 

বাংলাদেশের কৃষক সমাজ প্রধানত দু'ভাগে বিভক্ত। যথা—

ক. ভূমালিক কৃষক।

খ. ভূমিহীন বর্গাচাষি কৃষক ।

ভূমালিক কৃষক : 

এ শ্রেণির কৃষকের প্রচুর পরিমাণে জমি থাকে। তারা চাষাবাদের মাধ্যমে বিরাট মূলধনের মালিক হয়ে যায়। সাধারণ কৃষকের মনে সুখ ও শান্তি না থাকলেও এ শ্রেণির কৃষকের টাকা-পয়সা ও আরাম-আয়েশের অভাব নেই।

ভূমিহীন বর্গাচাষি : 

এ শ্রেণির কৃষকদের কারো সামান্য জমি আছে, আবার কারো একেবারেই নেই। তারা প্রথম শ্রেণির জমিদারদের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে। পরিশ্রমের চেয়ে তাদের প্রাপ্তির পরিমাণ খুবই কম ।

আরও পড়ুন :- বাংলা রচনা - বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য  [ Class 6, 7, 8. 9, 10 ] 

কৃষকদের আর্থিক অবস্থা : 

বাংলাদেশের কৃষকরা কঠোর পরিশ্রম করলেও তাদের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। কারণ পরিশ্রম করে তারা যে ফসল ফলায়, কম কৃষকই তা ভোগ করতে পারে। এ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে বেশিরভাগ সম্পদ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে। ফলে গ্রাম-বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ আজ উপেক্ষিত বঞ্চিত। তাদের পেটে ভাত নেই, পরনে ভালো কাপড় নেই। অনাহার, অশিক্ষা ও নানারকম রোগব্যাধিতে তারা নিত্য আক্রান্ত ।

বাংলাদেশের কৃষকদের দুরবস্থার কারণ : 

বাংলাদেশের কৃষকদের দুরবস্থার কারণগুলো নিচে উপস্থাপন করা হলো-

১. কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না। কৃষিঋণ শোধ করতেই সিংহভাগ ফসল বিক্রি করে দিতে হয়। তাছাড়া অসময়ে বিক্রির ফলে কম দামে বিক্রি করতে হয়।

২. জমির মালিক ও জোতদারদের শোষণের শিকার হয় নিরীহ কৃষকরা। তারা কৃষকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয় না।

৩. প্রয়োজনের সময় পর্যাপ্ত সার ও কীটনাশক পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও অনেক সময় অধিক মূল্যে কেনা সম্ভব হয় না।

৪. অধিকাংশ কৃষকের নিজস্ব জমি নেই। তারা অন্যের জমি চাষ করে কোনোরকমে অন্নের ব্যবস্থা করে।

৫. কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ধরা হলেও সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা করে না।

৬. একই পরিবারের জমি বহুখণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। যার ফলে উন্নত চাষ পদ্ধতি এখানে অসম্ভব ।

৭. প্রয়োজনের সময় উপযুক্ত ঋণ পাওয়া যায় না বলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়।

৮. কৃষকদের উৎপাদিত ফসল গুদামজাতকরণের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। ফলে মৌসুমে উৎপাদিত ফসল প্রচুর পরিমাণে বিনষ্ট হয় বা কমদামে বিক্রি করতে হয়।

৯. প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদিতে কৃষকের ফসল বিনষ্ট হয়।

১০. কৃষি মৌসুমে সেচ ব্যবস্থার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ গভীর নলকূপ নেই। ফলে কৃষকদের ভাগ্য মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। 

১১. গভীর নলকূপের ব্যবস্থা হলে তা পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই।

১২. একই জমিতে বারবার চাষের ফলে জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। ফলে উৎপাদিত হচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত ফসল।

আরও পড়ুন :- বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প - রচনা class 6 , 7 , 8 , 9, ssc, hsc - PDF

কৃষকদের দুরবস্থা দূরীকরণের উপায় : 

কৃষকদের দুরবস্থা দূরীকরণার্থে নিম্নবর্ণিত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে- ক. তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

খ. শ্রমের উপযুক্ত পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করতে হবে।

গ. পর্যাপ্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঘ. কৃষিঋণ, উন্নত সার, কীটনাশক ও লাঙ্গলসহ যাবতীয় অত্যাধুনিক ব্যবস্থার ব্যাপারে সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন । 

ঙ. জমির খণ্ড-বিখণ্ডতা দূরীকরণের মাধ্যমে খামারভিত্তিক চাষ পদ্ধতির ব্যবস্থা করতে হবে।

চ. প্রয়োজনের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

ছ . পচনশীল কৃষি পণ্যের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

জ. প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে গভীর নলকূপ ও তা পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

ঝ. আধুনিক চাষ-পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঞ. কৃষকদের মাঝে সুলভে আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে।

ত. কৃষকের উৎপাদিত কৃষি পণ্য সরাসরি বাজারজাত করতে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক ও প্রশাসনিক নিরাপত্তা ও সহযোগিতা

দিতে হবে।

থ. মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য ও চাঁদাবাজদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে হবে।

দ. কৃষকদেরকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে হবে।

উপসংহার : 

আমাদের মনে রাখতে হবে, কৃষক সমাজ জাতির ভবিষ্যৎ। তারা আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়। সুতরাং কৃষকরা যাতে সহজ উপায়ে ফসল ফলাতে পারে, আর তাদের শ্রমের সঠিক মূল্য পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

Post a Comment

0 Comments

Bottom Post Ad