রচনা : একুশের চেতনা বা জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা

উপস্থাপনা :  

বিশ্ব জুড়ে বাঙালি জাতির ব্যতিক্রমধর্মী ইতিহাস, একুশের ইতিহাস কোটি প্রাণের একাত্মতা, বাঙালি জাতির বেদনার্ত হৃদয়ের হাহাকার। রক্তে রঞ্জিত, সিক্ত হৃদয়ের মাথানত না করার সঠিক অঙ্গিকার। বুক ভরে মা ডাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। একুশ মানে বাংলা সংস্কৃতির আঙ্গিনায় নব সূর্যের উদয় । 

সম্প্রতি জাতিসংঘের ইউনেস্কো সংস্থা ঘোষণা করে অন্যান্য দিবসের মত ২০০০ সাল থেকে বিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হবে সে থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলা হয়।

ঘটনার সূত্রপাত : 

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রস্তাব উত্থাপিত হল গণপরিষদে বক্তৃতা করতে হবে ইংরেজি এবং উর্দূতে । এর প্রতিবাদ করল পূর্ববাংলার কিছু সংখ্যক সদস্য। তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দিল বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করতে দিতে হবে। যেহেতু পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৬৩ ভাগের মাতৃভাষা বাংলা।

আরও পড়ুন :- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস - রচনা ২০পয়েন্ট | PDF

ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত :  

১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এক জনসভায় দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করলেন উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তখন পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি মানুষের সম্মুখে মাতৃভাষা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ঝুলে রইল। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্র আন্দোলনে আরো গণজাগরণ দেখা দিল ।

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি :  

১৯৫২ সালের একুশে ফ্রেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। সেদিন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে সারাদেশে আন্দোলনের ঢেউ উঠে। পাকিস্তান সরকার বেসামাল হয়ে ১৪৪ ধারা জারি, সমস্ত সভা সমিতি, মিছিল, মিটিং নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। 

বাংলার আত্মত্যাগী ছেলেরা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মিছিল নিয়ে এগিয়ে চলল, মিছিলটি শাস্তিপূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে আসতেই পাকিস্তানী বর্বররা মিছিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, রক্তে ভরে গেল ঢাকার পিছঢালা রাজপথ। এ মিছিলে পাণ হারালো ছালাম, রফিক, শফিক, শফিউর, বরকত, জব্বার আরো নাম না জানা অনেক মায়ের সন্তান। 

আরও পড়ুন :- মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান- রচনা [Class - 6, 7, 8 ,9 ,10]এবং hsc

জাতীয় জীবনে একুশের তাৎপর্য ঃ  

একুশ বাংলা জাতিকে দিয়েছে মুক্তির ইশারা। একুশ প্রতিষ্ঠিত করেছে বাংলা ভাষাকে। ঐক্য এনে দিয়েছে বাঙালি সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি। তাই একুশ একটি তাৎপর্যপূর্ণ জাতীয় চেতনার দিন।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি : 

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর শুধু আমাদের মাতৃভাষা দিবস নয় । প্রতি বছর 'একুশে ফেব্রুয়ারি' সারা বিশ্বে পালিত হবে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো-এর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে 'একুশে ফেব্রুয়ারি'-কে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় । 

ইউনেস্কোর প্রস্তাবে বলা হয়, “১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের অনন্য ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং ১৯৫২ সালের এই দিনের শহীদদের স্মৃতিকে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কোর ১৮৮টি সদস্য দেশ এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হবে।"

উপসংহার : 

একুশ দুর্জয় ও দুর্বার বাঙালি জাতির এক কালজয়ী অমর ও অক্ষয় কীর্তির স্মৃতিময় প্রামাণ্য সনদ। একুশের নির্যাসকে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আমাদেরকে মনে-প্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি বলে প্রমাণ করতে হবে। কথনে, লিখনে, চিন্তনে ও পঠনে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করাই একুশের মূল দাবি। আর বিশ্বের দরবারে মাতৃভাষাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ায় দেশ ও জাতি আজ গর্বিত ।

Post a Comment

0 Comments