ভূমিকা
ধর্মীয় ও সামাজিক প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে লোকশিল্পের উদ্ভব। আলপনা, মনসাঘট, লক্ষ্মীর সরা, মঙ্গলঘট ইত্যাদি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন লোকশিল্প। পটচিত্রে ধর্মীয় আবেগ যুক্ত থাকলেও তা জীবিকার উপায় হিসেবে গণ্য। নানারকম ডিজাইন ও অলংকরণে শোভিত আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি গৃহস্থের ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটায়।
খেলার পুতুল, শখের হাঁড়ি, সোনা-রুপার অলংকার ইত্যাদি শৌখিন দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব শিল্পকলারই কিছু না কিছু নান্দনিক আবেদন থাকে। তাই হিংস্র পশু বা রাক্ষসের মুখোশচিত্র যতই কদাকার হোক, নির্মাতার হাতের ছোঁয়া এবং ঐতিহ্য-সংস্কার আবেগের সংমিশ্রণে তার মধ্যেও এক প্রকার রস সঞ্চারিত হয়, যা বীভৎস রস নামে খ্যাত।
লোকশিল্প কী
ঘরে বসে যে পণ্য উৎপাদন করা হয় বা পরিবারের ক্ষুদ্রাকার ও সামান্য মূলধন কাজে লাগিয়ে স্থানীয় কাঁচামালের- ভিত্তিতে যে শিল্প গড়ে ওঠে তাকে লোকশিল্প বলে। এ ধরনের শিল্প সাধারণত ব্যক্তির দ্বারা অথবা পরিবারের সদস্য দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রয়োজনে সেখানে মজুরির বিনিময়ে বাড়তি শ্রমিকও নিয়োগ করা যায় ।
বাংলাদেশের লোকশিল্প
বাংলাদেশ লোকশিল্পের দেশ। লোকশিল্প আমাদের গৌরব, আমাদের ঐতিহ্য। শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও পণ্য পাঠিয়ে আমাদের লোকশিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এ দেশের লোকশিল্পের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বিশেষ করে ঢাকার মসলিনের গৌরব আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে দুনিয়ায় ।
ঢাকাই মসলিন
বাংলাদেশের লোকশিল্পের কথা উঠলে প্রথমেই আসে ঢাকাই মসলিনের কথা। ঢাকার ডেমরা এলাকার তাঁতিদের তৈরি এ অমূল্য সৃষ্টি এককালে দুনিয়াজুড়ে তুলেছিল প্রবল আলোড়ন। মোগল বাদশাহদের অন্যতম বিলাসের বস্তু ছিল এই মসলিন কাপড়। এটা এত সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে বোনা হতো যে, ছোট্ট একটি দিয়াশলাইয়ের মধ্যে একটি মসলিন শাড়ি অনায়াসে ঢুকানো যেত। সে সময় বিদেশে এই মসলিন কাপড়ের প্রচুর কদর ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড় আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
নকশিকাঁথা
নকশিকাঁথা একটি অন্যতম প্রধান গ্রামীণ লোকশিল্প। একসময় বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে নকশিকাঁথা তৈরির রেওয়াজ ছিল। বর্ষাকাল ছিল নকশিকাঁথা সেলাইয়ের উপযুক্ত সময়। এ সময় গ্রামের মেয়েরা সংসারের কাজ শেষ করে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে, পাটি বিছিয়ে নকশিকাঁথা সেলাই করতে বসত। তারা মনের মাধুরী মিশিয়ে এ কাঁথার ওপর বিচিত্র রকমের নকশা ফুটিয়ে তুলত।
জামদানি শাড়ি
লোকশিল্পের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো জামদানি শাড়ি। নারায়ণগঞ্জ জেলার নওয়াপাড়া জামদানি কারিগরদের বসবাস। শতাব্দীকাল ধরে, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে এ তাঁত শিল্প বিস্তার লাভ করেছে। এক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, শীতলক্ষ্যা নদীর পানির বাষ্প থেকে যে আর্দ্রতার সৃষ্টি হয় তা জামদানি বোনার জন্য খুবই উপযোগী। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অনেক কাপড়ের কারখানা গড়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন :- পাহাড়পুর - ঐতিহাসিক স্থান বা দর্শনীয় স্থান : রচনা
খাদি বা খদ্দর
খাদি বা খদ্দরের প্রচুর কদর রয়েছে এদেশের গ্রাম ও শহরে। খাদি কাপড়ের বিশেষত্ব হলো এর সবটাই হাতে তৈরি। তুলা থেকে হাতে সুতা কাটা হয়। এদেশের গ্রামে বাড়ির আশপাশে তুলার গাছ লাগানোর রীতি আছে। সেই গাছ থেকে উৎপাদিত তুলা দিয়ে সুতা কাটা ও হস্তচালিত তাঁতে এসব সুতা দিয়ে কাপড় প্রস্তুত করা হতো, সেটাই হলো খাদি কাপড় ।
কাঁসা ও পিতলের তৈজসপত্র
একসময় এদেশের গ্রামে গ্রামে কাঁসা ও পিতলের তৈরি আসবাবপত্র প্রচলিত ছিল। আজও শত শত কারিগর তৈরি করে বিচিত্র ধরনের তৈজসপত্র। মাটির ছাঁচে গলিত কাসা ঢেলে বিভিন্ন আকৃতির তৈজসপত্র তৈরি করা হয় ৷ এছাড়াও গ্রামে-গঞ্জে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের লোকশিল্প। পোড়ামাটির কাজের ঐতিহ্য এদেশে বহু যুগের। প্রাচীনকাল হতে মাটির তৈরি কলস, হাড়ি, পাতিল, সানকি, ফুলদানি, দইয়ের ভাঁড় প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
লোকশিল্পের সংরক্ষণ
যান্ত্রিক সভ্যতা তথা শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প আজ বিলুপ্ত প্রায় । লোকশিল্পের পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়েই আবার নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে। লোকশিল্পই এদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির বুনিয়াদ । তার গৌরবময় ইতিহাসের পুনরুজ্জীবনই দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মরাগাঙে সমৃদ্ধির ঘ্রাণ আনতে পারে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ তথা লোকশিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যান্ত্রিক শিল্পের পাশাপাশি আমাদের কুটিরশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
উপসংহার
লোকশিল্প আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রতীক। বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও লোকশিল্পের ভূমিকা রয়েছে। তাই দেশের লোকশিল্পকে আরও উন্নত, মজবুত ও সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দরিদ্র জনসাধারণের ভাগ্য পরিবর্তনে লোকশিল্পের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিসীম।
আপনার পছন্দ হতে পারে এমন আরও পোস্টের তালিকা