উপস্থাপনা
আমাদের বাড়ি মেঘনা নদীর তীরে। গ্রাম থেকে বাইরে কোথাও যেতে হলে নৌকাই আমাদের প্রধান অবলম্বন। কিন্তু আমি গ্রামেই পড়াশোনা করি বলে বাইরে কোথাও যাওয়া হয় না। গত বছর শীতকালে আমার ছোট মামার সাথে মেঘনা নদীর ওপর দিয়ে নৌকাযোগে সৈয়দপুর নামে একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। সারাটা দিন আমাদের নৌকাতেই কাটে। সে দিনের কথা ভাবতে আজও আমার খুব ভাল লাগে।
যাত্রা
দেবীপুর ঘাট থেকে আমাদের ছোট নৌকা পাল তুলেছিল। তখন ভোর পাঁচটা। আমাদের মাঝি দু'জন। কিশোর বয়স্ক মাঝি বৈঠা ধরল । আর বুড়ো মাঝি ফ্লাক্স থেকে চা পান করায়ে শীত কমাবার চেষ্টা করছিলেন। ছোট মামা ছইয়ের ভৈতর ঢুকে পা গুটিয়ে শুয়ে পড়লেন।
নদীর দৃশ্য
শীতকালের মেঘনা বড় শান্ত । আমাদের নৌকা তখন চলছে নতুন জেগে ওঠা চরের পাশ দিয়ে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জলে-ডাঙ্গায় এক আশ্চর্য স্পন্দন শুরু হয়। চরে জনমানব নেই । বক, হরিয়াল, হাঁস ইত্যাদি পাখি রোদ পোহাতে পোহাতে ইতস্তত ঘুরছে। চরের বকে ছোট ছোট ঢেউ খেলানো বালির প্রান্তর। যেদিকে তাকাই কেবল পানি আর পানি। ঘন্টা খানেক চলার পর আর একটা চর দেখা গেল।
আরও পড়ুন :- দেশ ভ্রমণ - বাংলা রচনা | ক্লাস 6, 7, 8, 9, 10
দূর থেকে চরটা রঙিন মনে হচ্ছিল। কাছে এসে দেখা গেল, বিস্তীর্ণ তীর জুড়ে মরিচের খেত। কালচে সবুজ পাতার ভেতরে ভেতরে পাকা পাকা লাল মরিচ। এখানে নদীর খাড়া উঁচু পাড়। দেখেই বুঝা যায় এখন ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ভাবতে না ভাবতেই পাড় ভাঙ্গার আওয়াজ শুনতে পেলাম । নৌকা তীর থেকে একটু দূর দিয়ে চলতে শুরু করে ।
দুপুরের আহার
এরই ভেতর করম আলী মাঝি আমাদের জন্য রান্না-বান্না সেরে ফেলেছে। ডাল ও মাছের তরকারি দিয়ে মোটা লাল চালের ভাত । এদিকে নদীর হাওয়ায় আমার খুব খিদে পেয়েছিল । তাই ঐ খাবারও অমৃতের মত মনে হল ।
সন্ধ্যার বর্ণনা
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। শান্ত, ধূসর সন্ধ্যা, নিস্তব্ধ দুপদুপ্ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। দু'তীরের বৃক্ষশ্রেণী জমাট অন্ধকারের মত দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে বহুদূরে দু-একটি ক্ষীণ আলোকরেখা দেখা যাচ্ছে, ঐগুলো দূরবর্তী গ্রামের আলো। অন্ধকার ক্রমে নিবিড়তর হয়ে এল।
আরও পড়ুন :- বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প - রচনা class 6 , 7 , 8 , 9, ssc, hsc - PDF
আকাশে অসংখ্য তারকা উদিত হয়েছে। স্বচ্ছ নদীবক্ষে তাদের প্রতিবিম্ব চিক চিক করছে। চারদিকে কি গভীর নীরবতা। সৃষ্টি যেন নীরবে কার ধ্যানে মগ্ন হয়ে রয়েছে । এমন সময় আমাদের সুগায়ক বন্ধু বাদল ভাটিয়ালী গান ধরল-
“মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে
আমি আর বাইতে পারলাম না ।
আমি সারা জীবন বাইলাম বৈঠা রে,
আমার নাও ভাইটায় বৈ আর উজায় না । ”
সেই প্রশান্ত সন্ধ্যায়, সেই প্রশস্ত পদ্মাবক্ষে এ উদাস করা ভাটিয়ালী গান কেমন উপভোগ্য তা বর্ণনা করা সহজ নয়। কিছুক্ষণ পর বন্ধুর গান থেমে গেল; কিন্তু তার রেশ এখন পর্যন্তও যেন কানে বাজছে । সত্যিই সেই দিনটির কথা চিরদিন মনে থাকবে। দূরের কোন এক মসজিদে আজান শোনা গেল। আজানের মধুর শব্দ বাতাসে ক্ষীণ হয়ে ভেসে আসছে। হঠাৎ কানে এল, “চড়কডাঙার ঘাটে এসেছি।”
উপসংহার
এ নৌকা ভ্রমণের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা কখনও ভুলতে পারব না। একই সাথে আমরা দেখেছি প্রকৃতির সুন্দর ও কঠোর রূপ । এটা আমার অনেক দিন মনে থাকবে।
আপনার পছন্দ হতে পারে এমন আরও পোস্টের তালিকা