বাংলা প্রবন্ধ রচনা - সুন্দরবন

ভূমিকা : 

পৃথিবীর একক বৃহত্তম স্বয়ংক্রিয় উৎপাদনশীল ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হলো সুন্দরবন। বিচিত্র সব বন্যপ্রাণীর সমাবেশ সুন্দরবনকে চিহ্নিত করেছে এক অপরূপ প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে। তাছাড়া এখানে বিভিন্ন প্রকার গাছপালার চমৎকার সমাবেশ ঘটেছে। 

সুন্দরবন হচ্ছে একক ইকো সিস্টেম, যেটা শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের কাছেও আকর্ষণীয় বিষয়। সুন্দরবনের ৬২ শতাংশ বাংলাদেশের খুলনা বিভাগে এবং অবশিষ্ট ৩৮ শতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় অবস্থিত।

সুন্দরবনের আয়তন ও অবস্থান : 

সুন্দরবন পৃথিবীর পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারবিধৌত গরান বনভূমি (Mangrov Forest)। কর্কটক্রান্তির সামান্য দক্ষিণে বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূল ধরে বিস্তৃত ২১°৩০ ২২° ৩০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°০০′–৮৯°৫৫′ পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যবর্তী স্থানে এ বনভূমির অবস্থান।

প্রায় ২০০ বছর আগেও সুন্দরবনের আয়তন ছিল প্রায় ১৭,০০০ বর্গ কিলোমিটার। কিন্তু বর্তমানে এ বনভূমির আয়তন মাত্র ৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার । যার মধ্যে প্রায় ১,৭০০ বর্গ কিলোমিটার জলাভূমি ।

আরও পড়ুন :- পাহাড়পুর - ঐতিহাসিক স্থান বা দর্শনীয় স্থান : রচনা

মৃত্তিকা ও জলবায়ু : 

উৎপত্তির দিক থেকে সুন্দরবনের ভূভাগ সাম্প্রতিক কালের হলেও এটি মূলত হিমালয়ের ভূমিক্ষয়জনিত পলি থেকে সৃষ্ট। বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় সুন্দরবনের মাটি অন্যরকম। জোয়ার ভাটার কারণে এখানকার মাটিতে জলাবদ্ধতা ও লবাণাক্ততার প্রভাব বেশি। সুন্দরবনের মাটির প্রধান গাঠনিক উপাদান পলিযুক্ত দোআঁশ মাটি। এ বনকে উষ্ণমণ্ডলীয় আর্দ্র বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সুন্দরবনের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩১° সে. এবং সর্বনিম্ন ২১° সে.

সুন্দরবনের উদ্ভিদ : 

মাটির বৈচিত্র্যের কারণে সুন্দরবনের উদ্ভিদকূল ও বৈচিত্র্যময়। সুন্দরবনে রয়েছে বৃক্ষ, গুল্মলতা, ঘাস, পরগাছা এবং আরোহী উদ্ভিদের মধ্যে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, পশুর, ধুন্দুল, বাইন প্রভৃতি প্রধান। এগুলো মূলত লবণাক্ত পানিযুক্ত বনভূমির উদ্ভিদ। এছাড়া সুন্দরবনের প্রায় সব খালের পাড়েই জন্মে নিপা, পাম বা গোলপাতা। 

সুন্দরবনের প্রাণী : 

সুন্দরবনে নানারকম প্রাণীর দেখা মেলে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও বিশ্ববিখ্যাত। এছাড়া এখানে রয়েছে প্রায় ৫০টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা ও মায়া হরিণ, বানর, বনবিড়াল, সজারু এবং বন্য শুকর অন্যতম। সুন্দরবনে ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পারিযায়ী পাখি রয়েছে। বক, সারস, হাড়গিলা, কাদা-খোঁচা, লেনজা ও হট্টিটি এখানকার নদীনালার কিনারায় বিচরণ করে। 

এছাড়াও চিল, শকুন, ঈগল, মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, পেঁচা, বুলবুলি, শালিক, মুনিয়া, টুনটুনি, দোয়েল, বাবুই প্রভৃতি পাখি সুন্দরবনের সর্বত্রই বিচরণ করে। সুন্দরবনে প্রায় ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ দেখা যায়। এছাড়া নদীনালায় রয়েছে প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ। সরীসৃপের মধ্যে কুমির, সাপ, টিকটিকি জাতীয় সরীসৃপ, রাজগোখরা, অজগর, গুইসাপসহ কয়েক প্রকার সামুদ্রিক সাপ উল্লেখযোগ্য ।

আরও পড়ুন :- কুটির শিল্প - বাংলা প্রবন্ধ রচনা

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুন্দরবনের অবদান : 

সুন্দরবনের গাছ স্থাপনা তৈরিতে, জ্বালানি হিসেবে এবং কাঠকয়লা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া এখানকার গাছের বাকল ট্যানিন ও ঔষধ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। সুন্দরবনের গোলপাতার বিচিত্র ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এখানে প্রাপ্ত মধুর চাহিদা দেশ বিদেশে বেশ ভালো। 

এখানে যে শামুক ও ঝিনুক পাওয়া যায় তা খাবার চুনের ভালো উৎস। এছাড়াও সুন্দরবন থেকে সংগ্রহ করা হয় প্রচুর মাছ এবং বাগদা চিংড়ির পোনা। সুন্দরবনের বনজসম্পদকে কেন্দ্র করে কয়েকটি শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে খুলনা নিউজপ্রিন্ট ও হার্ডবোর্ড মিলস অন্যতম।

বর্তমানে সুন্দরবনের অবস্থা : 

১৮৭৫ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা দিলেও অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত সম্পদের আহরণে ধ্বংস হচ্ছে এর জীব বৈচিত্র্য। সেচের মাধ্যমে স্বাদু পানি তুলে নেওয়ায় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ওপরে উঠে এসে বনের লবণাক্ততা বৃদ্ধি করছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে পৃথিবীর ৫৩৩তম বিশ্ব ঐতিহ্য (World heritage) হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই বনকে সংরক্ষণে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক।

উপসংহার : 

এদেশের উপকূলবর্তী তথা দক্ষিণাঞ্চলের জীবন সুন্দরবনের আশীর্বাদপুষ্ট। বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতিতে এর প্রত্যক্ষ ভূমিকা অপেক্ষা পরোক্ষ ভূমিকা অনেক বেশি। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণকে এই একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্টকে সংরক্ষণের জন্যে সচেতন এবং কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে ।

Post a Comment

0 Comments

Bottom Post Ad