মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য লাভ ও আত্মত্যাগের অপূর্ব নিদর্শন হলো কুরবানি। সমাজে বসবাসরত প্রত্যেক সামর্থ্যবান ধনী মুসলমানর ওপর কুরবানি ওয়াজিব। নিম্নে কোরবানি শব্দের অর্থ কি? কুরবানী কাকে বলে এবং কুরবানির হুকুম কি? বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো-
কোরবানি শব্দের অর্থ কি ?
কোরবানি শব্দের অর্থ হলো –
১। নৈকট্য বা সান্নিধ্য লাভ।
২। উৎসর্গ করা।
৩। ত্যাগ বা বিসর্জন ইত্যাদি ।
কুরবানী কাকে বলে ?
ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, যিলহজ্জ মাসের নির্ধারিত দিনসমূহের যেকোনো দিনে মহান প্রভুর নৈকট্যলাভের উদ্দেশ্যে চতুষ্পদ প্রাণী জবাই করাকে কুরবানি বলা হয়।
শরহে বেকায়া গ্রন্থপ্রণেতার ভাষায় : কুরবানির দিনসমূহের কোনো একটি দিনে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট প্রাণী জবাই করাকে কুরবানি বলে।
কুরবানির হুকুম কি ?
কুরবানির হুকুম: কুরবানির শরয়ী বিধান সম্পর্কে কুদূরী গ্রন্থপ্রণেতা বলেন, প্রত্যেক ধনবান, স্থায়ী বাসিন্দা ও স্বাধীন মুসলমানের ওপর কুরবানির দিন তার নিজের ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানি করা ওয়াজিব। তবে এ বিধান সম্পর্কে ইমামদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। যেমন-
১। ইমাম আবু হানিফাসহ অন্যান্যের অভিমত: ইমাম আবু হানিফা, মালেক, যুফার ও হাসান (র)-এর মতে, যে ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব।
দলিল: ক. মহান আল্লাহর বাণী, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
খ.আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে রাসূল (স)-এর বাণী, مَنْ وَجَدَ سَعَةً وَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে যেন আমার ঈদগাহে উপস্থিত না হয়। এরূপ কঠোর উক্তি ও ভর্ৎসনা ওয়াজিবের ক্ষেত্রেই হতে পারে; সুন্নাতের ক্ষেত্রে নয়।
আরো পড়ুন : কুরবানী করার নিয়ম, দোয়া ও কুরবানীর মাসয়ালা-মাসায়েল। pdf
২। ইমাম শাফেয়িসহ অন্যান্যের অভিমত : ইমাম শাফেয়ি, আহমদ ও আবু ইউসুফ (র)-এর মতে, কুরবানি করা সুন্নাত।
দলিল: রাসূল (স)-এর বাণী,
مَنْ أَرَادَ أَنْ يُضَحى مِنْكُمْ فَلَا يَأْخُذُ مِنْ شَعْرِهِ وَأَطْفَارِهِ شَيْئًا . উদ্ধৃত হাদিসে أَرَادَ শব্দটি وُجُوبٌ সাব্যস্ত করে না। সুতুরাং তা সুন্নাত হওয়াই যুক্তিযুক্ত।
৩। ইমাম মুহাম্মদের অভিমত: ইমাম মুহাম্মদ, আবু ইউসুফ ও শাফেয়ি (র)-এর ভিন্ন মতে, কুরবানি করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।
দলিল: রাসূল (স)-এর বাণী,
مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ الصَّلُوةِ فَإِنَّمَا يَدْبَحُ لِنَفْسِهِ وَمَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصَّلُوةِ فَقَدْ تَمَّ نُسُكَهُ وَآصَابَ سُنَّةَ الْمُسْلِمِين.َ
ইমাম শাফেয়িসহ অন্যান্যদের দলিলের প্রত্যুত্তর : ইমাম শাফেয়ি (র)-সহ অন্যান্যদের উপস্থাপিত দলিলের উত্তরে হানাফি আলেমগণ বলেন, তাদের হাদিসে أَرَادَ শব্দটি الْخِيَرَة -এর অবকাশ দেয় না। অপরদিকে আবু হুরায়রা (রা)-এর বর্ণিত হাদিসে কুরবানি না করার ওপর যে ধমক এসেছে, তা শুধু ওয়াজিবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
কুরবানির সময়:
সকল ফকীহের মতে, কুরবানির সময় দু’ভাগে বিভক্ত। যথা-
ক. কুরবানির প্রথম সময়।
খ. কুরবানির শেষ সময়।
কা. কুরবানির প্রথম সময় :
কুরবানির প্রথম সময়কে স্খানভেদে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- ক. শহরে কুরবানির সময়, খ. গ্রামে কুরবানির সময়।
ক. শহরে কুরবানির সময়: শহরে কুরবানি করার সময় নিয়ে ইমামগণের মাঝে মতভেদ আছে। যেমন-
১। জমহুরের অভিমত: ইমাম আবু হানিফা (র) ও জমহুর ওলামায়ে কেরামের মতে, শহরে কুরবানির প্রথম সময় হলো ১০ যিলহজ্জ ঈদের নামায আদায়ের পর। ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানি করা বৈধ নয়।
দলিল :
مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ الصَّلُوةِ فَإِنَّمَا يَذبع – لِنَفْسِهِ وَمَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصَّلُوةِ فَقَدْ تَمْ نُسُكَهُ وَآصَابَ سُنَّةَ الْمُسْلِمِين.َ
অর্থাৎ, যে কেউ ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানি করে সে যেন নিজেদের জন্যই করে। আর যে ঈদের নামাযের পর কুরবানি করল সে যেন তার কুরবানি পূর্ণ করল এবং মুসলমানদের সুন্নাত অনুযায়ী আমল করল।
আরো পড়ুন : কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কয়টি?কার উপর ওয়াজিব-ওয়াজিব নয়
ইমামগণের মতভেদসহ বিস্তারিত আলোচনা নিম্নরূপ-
২। ইমাম শাফেয়ি ও মালেকের অভিমত: ইমাম শাফেয়ি ও মালেক (র)-এর মতে, নামাযের পর ইমামের কুরবানির পূর্বে শহরের লোকদের কুরবানি করা বৈধ নয়।
খ. গ্রামে কুরবানির সময়: সকল আলেম ও ফকীহের ঐকমত্যে যে সকল গ্রামে ঈদের নামায ওয়াজিব নয়, সে সকল গ্রামের লোকদের জন্য ১০ যিলহজ্জ সুবহে সাদেক প্রকাশিত হওয়ার পরই কুরবানির সময় শুরু হয় তবে বর্তমানে যেহেতু সকল গ্রামে ঈদের নামায পড়া হয়, সেহেতু সকল গ্রামের জন্য উক্ত সময়ই ধর্তব্য হবে।
খ. কুরবানির শেষ সময়:
কুরবানির শেষ সময় নিয়ে ইমামগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে। যেমন-
১। ইমাম আবু হানিফা ও জমহুর ওলামার অভিমত: ইমাম-আবু হানিফা (র)-সহ জমহুর ওলামায়ে কেরামের মতে, ১০ যিলহজ্জের পরে আরো দুদিন কুরবানির সময় বাকি থাকে। সুতরাং কুরবানির শেষ সময় হলো ১২ যিলহজ্জসূর্যাস্ত পর্যন্ত।
দলিল : ক. যেমন মহান আল্লাহর বাণী –
لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ
২. ইমাম শাফেয়ির অভিমত: ইমাম শাফেয়ি (র)-এর মতে, কুরবানির শেষ সময় হলো ১৩ যিলহজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
দলিল: মহানবী (স)-এর বাণী, أَيَّامُ التَّشْرِيقِ كُلُّهَا أَيَّامُ ذَبْحٍ অর্থাৎ তাশরীকের দিনসমূহের প্রত্যেকটিই কুরবানির দিন, আর তাশরীকের দিন হলো ১০ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত।
ইমাম শাফেয়ির দলিলের প্রত্যুত্তর: আহনাফের পক্ষ থেকে ইমাম শাফেয়ি (র)-এর উপস্থাপিত দলিলের প্রত্যুত্তরে বলা হয়, যেহেতু কুরবানির শেষ সময় ১২. ও ১৩ তারিখ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা রয়েছে, সেহেতু আমরা সর্বনিম্ন সময় ১২ তারিখকেই প্রাধান্য দিয়েছি, যাতে কোনোরূপ সন্দেহ ও সংশয়ের সৃষ্টি না হয় এবং নিশ্চিতভাবে কুরবানি শুদ্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া যেখানে ১২ তারিখ আসর পর্যন্ত সকলের ঐকমত্যে কুরবানি করলে-চলবে, সেখানে বিতর্কিত মতগুলো পরিহার করে নির্ভেজাল ও সমাধানমূলক সময়টি কুরবানির শেষ সময় বলে নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয়। আর যেহেতু কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সেহেতু দ্রুততার সাথে তা সম্পাদন করাও ঈমানের দাবি।
আরো পড়ুন : কুরবানির প্রশ্ন উত্তর – দলিল সহ