(toc) Table Of Contens
উপস্থাপনা :
Industry is the mother of good luck. অর্থাৎ, পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। মানবজীবনের উন্নতি-অগ্রগতি, সভ্যতা- সংস্কৃতি, এমনকি অস্তিত্বও শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। ক্ষুদ্র পিপীলিকা থেকে শুরু করে মানব-মহামানব পর্যন্ত সকলকেই পরিশ্রম করতে হয়।
পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি :
সংস্কৃত প্রবাদে আছে- “দৈব নং দেয় মিতি কাপুরুষংবদন্তি।” অর্থাৎ, দৈবলব্ধ অর্থের কল্পকাহিনী অলস কাপুরুষের স্বল্পবিলাস মাত্র। কোনো অলস ব্যক্তি নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে না। সৌভাগ্য কোথাও থেকে ধার পাওয়া যায় না। কঠোর শ্রমসাধনা দ্বারাই সৌভাগ্য অর্জন করতে হয়। পৃথিবীর সফল ব্যক্তিদের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নিরন্তর প্রচেষ্টা ও কঠোর শ্রমের দ্বারাই তারা নিজের ভাগ্য নির্মাণ করেছেন।
শ্রম সম্পর্কে ধারণা :
শ্রম দু'প্রকার। শারীরিক শ্রম ও মানসিক শ্রম । আমরা অনেকেই শারীরিক শ্রমকে অমর্যাদাকর ও অসম্মানজনক মনে করি। আমাদের অনেকের ধারণা, শ্রমজীবী মানুষ যেমন চাষী, কুলি-মজুর, শ্রমিক- এরা ছোট জাতের মানুষ, কিন্তু তা ঠিক নয়। জাতীয় উন্নয়নে এদের অবদানই বেশি।
শ্রমের আবশ্যকতা :
পার্থিব জীবনে মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে সাফল্যজনকভাবে বাঁচতে হলে প্রয়োজন কঠোর শ্রম সাধনা। মানবজীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কেউ কারো অন্নের সংস্থান করে দেবে না। নিজের অন্ন নিজেকেই জোটাতে হয়। এজন্য বেঁচে থাকার তাগিদে পরিশ্রম করতে হবে।
আরও পড়ুন :- শ্রমের মর্যাদা- বাংলা রচনা[ Class - 6, 7, 8 ,9 ,10]- PDF ৩টি
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমের গুরুত্ব :
পবিত্র কুরআন ও হাদীসে শ্রমের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছে । রাসূল (স) বলেছেন, “যে মানুষ যত বেশি কর্তব্যনিষ্ঠ তার সফলতা তত বেশি হয়।” মহানবী (স) শৈশবকাল থেকেই শ্রমপ্রিয় ছিলেন। তিনি শৈশবে চাচার ব্যবসায় পরিচালনার জন্য সিরিয়া যেতেন।
পরে তিনি শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শ্রমের মাধ্যমে জগতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (স) বলেছেন, “শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।”
ভাগ্য নির্মাণ ও প্রতিভা বিকাশে পরিশ্রম :
মানুষ একদিকে যেমন সভ্যতার স্রষ্টা, অন্যদিকে সে আপন ভাগ্যেরও কারিগর। মানুষ নিজের ভাগ্য নিজেই নির্মাণ করতে পারে শ্রমের মাধ্যমে। কারণ ভাগ্য নির্মাণের হাতিয়ার হলো পরিশ্রম। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- God helps those who help themselves. অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করবে না, আল্লাহও তাকে সাহায্য করবে না।” অন্যদিকে প্রত্যেক মানুষের মাঝে প্রতিভা লুকিয়ে থাকে। মানুষ পরিশ্রমের মাধ্যমেই তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে।
ব্যক্তিগত শ্রম ও জাতীয় উন্নয়ন :
ব্যক্তির উন্নয়নের ওপর জাতীয় উন্নয়ন নির্ভরশীল। আবার ব্যক্তির উন্নয়ন পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল। শ্রমবিমুখ ব্যক্তি জাতির বোঝা। অলস ব্যক্তি নিজে যেমন সমস্যায় জর্জরিত থাকে, তেমনি জাতীয় উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত করে। তাই ব্যক্তি, জাতি ও শ্রম একসূত্রে গাঁথা।
আরও পড়ুন :- স্বদেশ প্রেম - বাংলা রচনা [ Class - 6, 7, 8 ,9 ,10] hsc
শ্রম ও সভ্যতা :
পরিশ্রম শুধু সৌভাগ্যের নিয়ন্ত্রক নয়; বরং সভ্যতা বিকাশেরও সহায়ক। মানব সভ্যতার উন্নতি অগ্রগতিতে শ্রমের অবদান অনস্বীকার্য। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত বেশি সভ্য। সভ্যতার উন্নতির জন্য প্রয়োজন শারীরিক ও মানসিক শ্রমের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ।
শ্রমের গুণ :
শ্রমই পাহাড় ভেঙে রাস্তা তৈরি করে, বন কেটে তৈরি করে বসতি। শ্রম গরিবকে ধনী, অসভ্য বর্বর জাতিকে রূপান্ত রিত করে সভ্য জাতিতে । মানুষের ভাগ্য গঠনের প্রধান হাতিয়ার হলো পরিশ্রম। পরিশ্রমের ফলে মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ে তুলতে পারে।
শ্রম ও মর্যাদা :
বিশিষ্ট ইংরেজ সাহিত্যিক কার্লাইল শারীরিক পরিশ্রমকে পবিত্র বলে অভিহিত করেছেন। কথায় বলে, বসে বসে খেলে রাজার রাজত্বেও কুলায় না; তখন রিক্তহস্ত হয়ে মর্যাদাহীন হয়ে পড়তে হবে। ফলে যে শ্রমের মর্যাদা দেবে সে সম্মানিত হবে।
শ্রম ও স্বাস্থ্য :
পরিশ্রম করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। নানারকম রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। পরিশ্রম না করলে ব্যায়াম করতে হয় আর ব্যায়াম হলো কৃত্রিম শ্রম । নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিশ্রম করলে ব্যায়ামের প্রয়োজন পড়ে না।
মানসিক উন্নতিতে শ্রম :
কথায় বলে, “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।” পরিশ্রমী মানুষ সর্বদা নিজের কাজের চিন্তায় থাকে। ফলে তার মাথা নানা রকম কুচিন্তা থেকে মুক্ত থাকে। তাছাড়া পরিশ্রমের ফলে শরীর ভালো থাকে। আর শরীর ভালো থাকলে মনও ভালো থাকে ।
বাংলাদেশে শ্রমের মর্যাদা :
আমাদের দরিদ্রতার অন্যতম কারণ শ্রমের অমর্যাদা। এখানে কায়িক শ্রমকে ঘৃণা করা হয়। শ্রমিককে তার প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। রবি ঠাকুর বলেন-
বাঙালি মোরা ভদ্র অতি পোষমানা এ প্রাণ
বোতাম আঁটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান ।
আরও পড়ুন :- পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার - রচনা [ Class - 6, 7, 8 ,9 ,10]
উন্নত দেশে শ্রমের মর্যাদা :
পৃথিবীর উন্নত জাতিগুলো শ্রমের মর্যাদা ও মূল্যায়নের ফলে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে। তারা কোনো কাজকেই ছোট বা ঘৃণ্য মনে করে না। আমেরিকা, কানাডা, জাপান, চীন, জার্মান, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।
শ্রমশীল ব্যক্তির উদাহরণ :-
রাসূল (স) বলেছেন, “নিজ হাতে কাজ করার মতো পবিত্র জিনিস আর কিছুই নেই।” তিনি নিজের কাজ নিজে করতেন। ভিক্ষা না করে পরিশ্রম করতে বলতেন। আব্রাহাম লিংকন, জর্জ ওয়াশিংটন, আইনস্টাইন প্রমুখ শ্রমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।
শ্রমিক লাঞ্ছনা :
সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ যারা, তারা গ্রহণ করেছে সমাজের সম্মানের কাজ, গৌরবের কাজ। সমাজের সমস্ত সুখ- সুবিধা নিজেদের কুক্ষিগত করে তারা তথাকথিত নিম্নশ্রেণির মানুষদের নিক্ষেপ করেছে ঘৃণা ও বঞ্চনার নীরন্ধ্র অন্ধকারে। অথচ সেই শ্রমিকেরা চিরকাল মাঠে মাঠে বীজ বুনেছে, ফলিয়েছে সোনার ফসল, তাঁতি বসে তাঁত বুনেছে, জেলে ধরেছে মাছ। অথচ স্বার্থপর সমাজের কাছ থেকে তারাই পায়নি মানুষের মর্যাদা।
শ্রমের জয় :
শ্রমিক সমাজ আজ বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানবিক শ্রমকে তার যোগ্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কালের যাত্রায় একমাত্র তারাই আজ সমাজের রথকে গতি দিতে পারে, একমাত্র তারাই পারে সমাজে কর্মমুখরতার ঢেউ আনতে। তাই আজ শ্রমের জয় বিঘোষিত হচ্ছে দিকে দিকে।
শ্রমিক দুনিয়ার প্রতি সকলের দৃষ্টি আজ আকৃষ্ট হয়েছে। দেশে দেশে আজ শ্রমিক সংঘ এবং শ্রমিক কল্যাণ স্বীকৃতি লাভ করেছে। সমাজ কাব্যে উপেক্ষিত এই শ্রমকে তার যোগ্য সম্মান না দিলে যে সমাজের উত্থান নেই, অগ্রগতি নেই— এ কথা আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু শ্রমিক সমাজকেও মনে রাখতে হবে যে, শ্রেণিস্বার্থ নয়, সমবণ্টনই কাম্য।
সমাজের সম্পদ, তার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সকল মানুষের জন্য সমভাবে বণ্টিত হওয়া উচিত। বুদ্ধিবল, বাহুবল, অর্থবল এবং শ্রমবল- সমাজের সবই প্রয়োজন। সমাজের বেদীমূলে সবাই যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রমদান করবে। তার বিনিময়ে প্রত্যেকে তার ন্যায়সংগত মূল্য পাবে। এটাই বর্তমান যুগের আদর্শ হওয়া উচিত ।
প্রাণীকূলে শ্রমের দৃষ্টান্ত :
আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ অতি তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র প্রাণী থেকেও শ্রমশীলতার অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারে । ক্ষুদ্র পিপীলিকা শীতের সঞ্চয়ের জন্য গ্রীষ্মকালে নিরলসভাবে খাদ্য সংগ্রহ করে। উঁই পোকা কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলে বিশাল ঢিবি। মৌমাছি মধু সংগ্রহে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। বন্য পশুপাখি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাদ্যের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে। এমনকি অতিথি পাখিরা হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয় জীবন রক্ষার তাগিদে
শ্রমবিমুখতার পরিণাম :
যারা অদৃষ্টবাদী, অলস ও শ্রমবিমুখ তারা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে ব্যর্থ হয়। অভাব-অনটন, জরা-ব্যাধি হয় তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। সম্পদ কিংবা সাফল্য এমনিতেই হস্তগত হয় না, নিরলস শ্রম আর সংগ্রাম করে অর্জন করতে হয়। যে জাতি অলস, কর্মবিমুখ তারা শিক্ষা ও সভ্যতায় অগ্রসর নয়। উন্নয়নের সোনার হরিণ তাদের কাছে কস্মিনকালেও ধরা দেয় না।
বর্তমান সভ্য দুনিয়ায় যে দেশ, জাতি উন্নয়ন ও অগ্রগতির সোপান রচনা করেছে, তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিরন্তর শ্রম ও সাধনার ইতিহাস। আলস্যে কালক্ষেপণ করলে তাদের ইতিহাসও রচিত হতো উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির বদলে দারিদ্র্য এবং ব্যর্থতার গ্লানিতে পরিপূর্ণ হয়ে ।
উপসংহার :
ইংরেজি প্রবাদ - God helps them who help themselves. অর্থাৎ, যে নিজেকে সাহায্য করে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। তাই সকলকেই শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। বৃথা আভিজাত্যের ভাব পরিত্যাগ করে সকল পরিশ্রমকে মর্যাদার বস্তু বলে গণ্য করতে হবে। কোনো কাজই অগৌরবের নয়- এ শিক্ষা সকলকে গ্রহণ করে পরিশ্রমী হতে হবে। তবেই আমরা বিশ্বের দরবারে সভ্য জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি ।