উপস্থাপনা :
আজকাল পত্র-পত্রিকা খুললেই যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে, তাহল যৌতুক প্রথার বলি-নারী সমাজ। সমাজে নারীরা যত প্রকারে নির্যাতিত হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হল যৌতুক প্রথার শিকার। আমাদের সমাজ জীবনে এক ভয়াবহ অভিশাপ হিসেবে বিরাজমান এ যৌতুক প্রথা অথচ শরৎচন্দ্র বলেন-“অর্থের বিনিময়ে যারা একজন নারীকে বিয়ে করতে সম্মত হয় সেই পুরুষ কোনদিন তার স্ত্রীকে ভালোবাসবে না-
পাত্রীর অভিভাবকদের একথাটা বুঝা উচিত।” শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম করে গেলেও সমাজের এই 'বিষবৃক্ষ'কে সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হয়নি। বরং তা বেড়ে গেছে ধাপে ধাপে। এটা আমাদের জন্য সত্যি এক লজ্জাজনক ব্যাপার, মানব সভ্যতার এক কলঙ্কময় অধ্যায় ।
যৌতুকের কারণ ও উৎপত্তি :
মানুষের অর্থ লালসা থেকে যৌতুক প্রথার সৃষ্টি হয়। দারিদ্র্য বা আর্থিক দুরবস্থাও যৌতুক প্রথা সম্প্রসারিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। হিন্দু আইনে কন্যারা পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারী হয় না বলে কন্যাকে অর্থাৎ তার স্বামীকে পুষিয়ে দেয়ার মানসিকতা ও চিন্তা ভাবনা থেকে পণপ্রথার সৃষ্টি। ক্রমান্বয়ে এ প্রথা বিষবৃক্ষের মত সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রাচীনকালে আর্য-অনার্য রাজপরিবারের মধ্যে যৌতুক প্রথা চালু ছিলো শুল্কের আকারে । অনার্যরা সমাজে মর্যাদা পাবার জন্য আর্য পাত্রদের কাছে কন্যা সম্পাদন করতেন এবং বিনিময়ে তাদেরকে যৌতুক দান করতেন। এভাবে যৌতুক প্রথা একটি সামাজিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন :- ইভটিজিং / নারী উত্যক্তকরণ রচনা [ ক্লাস ৬, ৭, ৮, ৯, ১০]
নারী নির্যাতনে যৌতুকের প্রভাব :
নারী নির্যাতনে যৌতুকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। যৌতুক দেয়ার মাধ্যমে নারীকে নগণ্য প্রাণী এবং পণ্যে পরিণত করা হয় । মানুষ হিসেবে সমাজে নারীকে মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নে যৌতুক এক বিরাট বাধা। বিবাহের মত অবশ্য কর্তব্য ও পবিত্র দায়িত্ব পালনে পুরুষের কোন দায় নেই অথচ নারীকে এর বিনিময়ে অর্থপ্রদান করতে হবে-এর চেয়ে জঘন্য প্রথা সমাজে আর কিছু নেই। এটি একটি সামাজিক অবিচার।
যৌতুকের নৃশংসতা :
যৌতুক প্রথার নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা ও নারী নির্যাতন আজকাল সর্বজনবিদিত। ‘পণ' হিসেবে মোটা অংকের টাকা ছাড়াও স্বর্ণালংকার, মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী, টেলিভিশন, ভিসিআর, ফ্রিজ, মোটর সাইকেল ইত্যাদিসহ ফ্লাট বাড়ি বা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ গমনের খরচের কথা কখনও কখনও এসে পড়ে। এতসব চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে কনের অভিভাবকরা হিমশিম খেয়ে যান। তারপরেও তারা পুরোপুরি চিন্তামুক্ত নন।
কেননা কন্যার শ্বশুর বাড়ি থেকে নতুন নতুন চাহিদা থাকে, এ চাহিদা পূরণ না হলেই শুরু হয় স্ত্রীর উপর নির্যাতন। আর এ নির্যাতনকারীর ভূমিকায় স্বামী একা থাকে না, শ্বশুর, শাশুড়ী, ননদ, দেবর সকলেই। এ নির্যাতনেরও বিভিন্ন কৌশল আছে। যেমন-শারীরিক নির্যাতন, হত্যার পর সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে রাখা, গলায় বিষ ঢেলে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া এবং আরও অনেক রকমারী কৌশল ।
আরও পড়ুন :- বাংলা রচনা - ইসলামে নারীর মর্যাদা [ Class - 6, 7, 8 ,9 ,10] - PDF
প্রতিকারণ :
নারী যাতে নিগৃহীত না হয়, নিপীড়িত না হয়, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারী নিজেকে যাতে সম্পৃক্ত করতে পারে এ জন্য হীন যৌতুক প্রথা বন্ধ করা প্রয়োজন । এজন্য দরকার সরকার ও জনসাধারণের সমন্বিত উদ্যোগ। সরকারের উচিত কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করা।
প্রচার মাধ্যমগুলো যৌতুক বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে । পাত্র ও পাত্রীপক্ষসহ সকল স্তরের জনসাধারণের সচেতনতাই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। সরকার ইতোমধ্যে যৌতুক বিরোধী কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু সেটা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এদিকে সরকারকে আইনের প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার :
যৌতুকের অভিশাপ থেকে নারী সমাজকে রক্ষা করা অতি জরুরি। যৌতুক লেনদেনের হীন মানসিকতা পরিবর্তন করে নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ জন্য নারী আন্দোলনের পাশাপাশি নারী পুরুষসহ সমাজের সকল স্তরের জনসাধারণের সচেতন হওয়া প্রয়োজন । যৌতুক নামক সামাজিক ব্যাধি সমাজ থেকে দূর করতে না পারলে নারীরা কখনো মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারবে না ।
আপনার পছন্দ হতে পারে এমন আরও পোস্টের তালিকা