দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার : রচনা (২০ পয়েন্ট)

(toc)Table Of Contens

উপস্থাপনা : 

তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম । এদেশের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি লোকের জীবনযাত্রার মান নিম্নমানের। কারণ তাদের আয় কম। এছাড়াও এদেশ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত। এমতাবস্থায় এদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি জনসাধারণের জীবনকে করেছে দুর্বিষহ। কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, মজুতদারি প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপ সামাজিক পরিস্থিতিকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত। 

দ্রব্যমূল্যের সাথে জীবনযাত্রার সম্পর্ক : 

দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার সাথে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। কারণ দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকলে মানুষ তাদের সীমিত আয়ে পরিকল্পিতভাবে সাংসারিক ব্যয় পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে এ সীমিত আয় দ্বারা সংসার পরিচালনা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। যার ফলে অভাব নামক রাক্ষুসীর রাহুগ্রাসে নিপতিত হয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করে।

জনজীবনে পণ্যমূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া : 

ক্রমাগত পণ্যমূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে অসন্তোষের আগ্নেয়গিরি, ক্রোধের বজ্র ও বিদ্বেষের বিদ্যুৎ পুঞ্জীভূত করে। প্রতিনিয়ত বিধ্বংসী অভাব ও শোচনীয় দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানুষ হয়ে ওঠে মরিয়া। সমাজ জীবনে বিক্ষোভের উত্তাপ ও উচ্ছৃঙ্খলার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে। নিরুপায় মানুষ ধর্মঘট করে কখনও, আবার কখনও বা বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনে নামে। কলকারখানা যানবাহন অফিস-আদালত এমনকি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ হয় এবং হয়তো বা শেষ পর্যন্ত বেতনও বাড়ে। কিন্তু আসল সমস্যার দুর্বার ও আগ্রাসী শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা অসম্ভব। বেতন বাড়তে না বাড়তেই মূল্যমান এত বেশি উঁচুতে পৌঁছায় যে, সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিসটির আর নাগাল পায় না।

চাহিদা ও যোগান : 

পণ্যমূল্যবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ চাহিদার তুলনায় যোগানের অভাব। চাহিদা যেখানে দীঘির সেখানে ডোবা খুঁজে জল সরবরাহ চলে না। ফলে সীমাবদ্ধ জিনিসের জন্য অগণিত ক্রেতার ভিড় এবং পরিণামে মূল্যবৃদ্ধি ও জিনিস সংগ্রহের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা। বাঁধাধরা আয়ের লোকেরা এই প্রতিযোগিতায় হটে যায় এবং জেতে মুষ্টিমেয় কিছু বিত্তবান। এদিকে যেহেতু মুষ্টিমেয়কে নিয়ে সমাজ নয়, সেহেতু নির্দিষ্ট কিছু লোক বেশি সুবিধা ভোগ করলে সমাজের বরং ক্ষতি। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের উৎপাদন বাড়াতে হবে। চাহিদা ও যোগানের সঙ্গতি যেন অব্যাহত থাকে, লক্ষ রাখতে হবে সেদিকে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি : 

বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্রতম দেশ। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনবিশিষ্ট এদেশে ১৬ কোটি লোক বাস করে। আয়তনের তুলনায় এ সংখ্যা খুবই মারাত্মক। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে যে উৎপাদন হয়ে থাকে তা দিয়ে এ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

কৃষি উৎপাদন হ্রাস : 

অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাস করে থাকে। আর এ হ্রাসের ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটতে বাধ্য।

রাজনৈতিক অস্থিরতা : 

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হলে অর্থাৎ রাজনৈতিক আন্দোলন, ধর্মঘট, হরতাল, মারামারি, রাহাজানি ইত্যাদি কারণে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পণ্যসামগ্রী পরিবহনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। ফলে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী নষ্ট হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে দ্রব্যের সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।

সামাজিক ব্যবস্থা : 

মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব সেহেতু সমাজে সকলের সাথে তাল মিলিয়েই চলতে হয়। মানুষের এ তাল মিলিয়ে চলার প্রবণতা থেকেই জন্ম নেয় প্রতিযোগিতা। এভাবে প্রতিযোগিতার ফলে জিনিসের দাম বৃদ্ধি ঘটে থাকে।

প্রশাসনিক দুর্নীতি : 

অবৈধ ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের নাকের ডগায় ওপর দিয়েই অবৈধভাবে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করে থাকে; কিন্তু প্রশাসন তা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। এছাড়া ঘুষ খেয়ে এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদেরকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার নজিরও কম নয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ : 

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস আমাদের নিত্যসঙ্গী। কখনও জলাবদ্ধতা আবার কখনও খরার কারণে দেশের লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য বিনষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে বাজারে পণ্যের যোগান হ্রাস পায়। তাই উৎপাদনস্বল্পতার কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।

দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট : 

কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় অবৈধ পথে খাদ্যশস্য পাচার করে থাকে। ফলে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয় এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়। অস্বাভাবিক হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ : 

দেশের দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের তুলনায় অর্থের যোগান বেশি হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি গলে অর্থের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় । এমতাবস্থায় একই পরিমাণ অর্থ দ্বারা মানুষ পূর্বাপেক্ষা কম পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারে। বলে মানুষের জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়ে। নিম্নে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো -

অর্থের যোগান বৃদ্ধি : দেশে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের তুলনায় অর্থের যোগান বেশি হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় । 

ঘাটতি ব্যয় : আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি হলে সরকার অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপায় বলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ।

উৎপাদন হ্রাস : দেশে কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন হ্রাস পেলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ।

অধিক ঋণ দান : বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ উদার ও সুলভ ঋণদান নীতি অনুসরণ করলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ।

বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত : দেশে বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত বেশি হলে লোকের আয়ের পরিমাণ বেড়ে যায় বলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। 

মজুরি বৃদ্ধি : শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায় বলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ।

যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ : যুদ্ধের সময় সরকারকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় বলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় । 

জনসংখ্যা বৃদ্ধি : দেশে উৎপাদনের হার অপেক্ষা জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার অধিক হলে দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পায় বলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ।

চোরাচালান ও মজুতদারী : চোরাচালানী, মজুতদারীতে ও কালোবাজারীরা দ্রব্যসামগ্রীর কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কুফল : 

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্যে এক চরম অভিশাপ। তাদের অবস্থা হয় 'নুন আনতে পান্তা ফুরোয়' এর মত। 'মরার ওপর খাড়া ঘা' এর মতই দুর্ভোগ নেমে আসে তাদের জীবনে। জীবনভারে ভারাক্রান্ত হয়ে তারা মানবেতর জীবন যাপন করে । পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা চোখে সর্ষে ফুল দেখে ৷ আজ প্রতিটি জিনিসের দামই হু হু করে বেড়ে চলেছে লাগামহীন ঘোড়ার মত । দেশে প্রতি ঘন্টায়, এমন কি প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে কোনো না কোনো দ্রব্যের দাম । 

একবার বেড়েছে তো আর নামার নাম গন্ধ নেই। আমাদের দেশের কোন কোন দ্রব্যের দাম স্বাধীনতা পূর্বকালের চেয়ে পনের বিশ গুণ পর্যন্তও বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য বর্তমান বিশ্বের উন্নত ও অনুন্নত সকল দেশেই কমবেশী দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উন্নত ও অনুন্নত দেশের দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। উন্নত দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে জনগণের আয়ও বৃদ্ধি পায়। ফলে তার জীবনযাত্রার মান অধোমুখী হয় না। 

কিন্তু আমাদের দেশে যেখানে আয় বাড়ে ১০০ টাকা সেখানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ৩০০-৫০০ টাকা। ফলে জনগণ রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে দুবেলা দুমুটো অন্ন গুজে দিতে পুত্র-পরিজনের মুখে। আজ নবজাতকের কচি সুন্দর মুখ দেখে পিতামাতা আনন্দে উদ্বেলিত হতে পারেন না। বাজারের অগ্নিমূল্যে জীবন তাদের হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্বিসহ, ভারাক্রান্ত, ক্ষুধার রাজ্যে তারা আজ ক্ষুধার্ত বাঘের মতই হিংস্র, মারমুখো । কবির দৃষ্টিতে, “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।”

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিকার :

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখা আজকের দিনের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আমাদেরকে নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে -

ব্যাংকহার বৃদ্ধি : ব্যাংক হার বৃদ্ধি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণপ্রদানের পরিমাণ হ্রাস করতে হবে।

সরকারী ব্যয় হ্রাস : সরকারকে তার ব্যয়ের পরিমাণ যতদূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

উৎপাদন বৃদ্ধি : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার হচ্ছে ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করা। 

মজুরি নিয়ন্ত্রণ : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সময় শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

দাম নিয়ন্ত্রণ : দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্যে সরকার দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও অত্যাবশ্যকীয় ব্যবস্থা চালু করতে হবে ।

সরকারের গৃহীত উদ্যোগ : 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে সরকার নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে । যেমন-
১. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ।

২. এ বিষয়ে তত্ত্বাবধান করতে টিসিবিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

৩. প্রতি সপ্তাহে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর খুচরা ও পাইকারি মূল্যের তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সরকারের গৃহীত এসব পদক্ষেপ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে জনগণ আশাবাদী ।

ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি, অত্যাবশ্যকীয় জিনিস দুষ্প্রাপ্য : 

আমাদের দেশে নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি আজ আর কোনো ‘বিশেষ সংবাদ’নয়, যেন স্বতঃসিদ্ধ একটি নিত্য-সত্য। প্রতি বছর বা প্রতি মাসে তো বটেই, প্রতি ঘণ্টায় এমনকি প্রতি মুহূর্তে জিনিসপত্রের দর বাড়ছে। এ যেন প্রাণীর বয়সের মতো শুধু বাড়ে, একবার বাড়ার সুযোগ পেলে আর নামে না। চাল, ডাল, তেল, লবণ, জামা-কাপড় ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় জিনিস বহু মানুষের কাছে আজ বিলাসদ্রব্য হিসেবে গণ্য। 

গাঁয়ে এমন মানুষ অনেক আছেন দু'বেলা দু'মুঠো খাওয়া যাদের কাছে প্রাগৈতিহাসিক সত্য। যারা উপযুক্ত আচ্ছাদনের অভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে দীর্ঘকাল স্বেচ্ছা- নির্বাসিত। কেরোসিন-ভর্তি দীপ্তিমান একটি হারিকেন-লণ্ঠন আজ অনেকের কাছেই আলাদীনের প্রদীপের চেয়েও বিস্ময়ের বস্তু। গৃহনির্মাণের সামান্য উপকরণ তাজমহলের চেয়েও দুর্মূল্য। এছাড়া ঔষধকে স্বর্গলোকের অমৃত, কয়লাকে হীরক আর দই-দুধ ইত্যাদি খাদ্যকে নিষিদ্ধ বস্তু হিসেবে গণ্য করতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আজ যেন অভ্যস্ত।

কৃত্রিম অভাব, মজুতদারী ও ফটকাবাজি, সরকার ও জনসাধারণ : 

আমাদের দেশের বহু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম অভাব সৃষ্টিতে তৎপর। তারা অনেক সময় রাজনৈতিক প্রশ্রয় এবং টাকার জোরে বিপুল পরিমাণ পণ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখে এবং তারপর দেশে পণ্যের জন্য যখন হাহাকার শুরু হয় তখন বাড়তি দামে ধীরে ধীরে মজুত করা পণ্য বাজারে ছাড়ে। এতে ওদের মুনাফার অঙ্ক রাতারাতি ফুলে ফেঁপে ওঠে, আর জনসাধারণের পকেট কাটা যায় পাইকারি হারে। 

এ সমস্যার সমাধান করতে হলে ফটকাবাজি ও মজুতদারি নির্মূল করা প্রয়োজন। সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে, হাত হবে দেশপ্রেমিক ও জনবান্ধব। আইন ও বিচার-ব্যবস্থাকে প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে; শুধুমাত্র কথার কামান দাগালে বা বক্তৃতার ফুলঝুরি ছাড়লেই চলবে না। অবশ্য জনসাধারণেরও এ ব্যাপারে যথেষ্ট দায়িত্ব আছে। ‘পণ্যদ্রব্য নেই” এই আশঙ্কায় তারা যদি কারণে-অকারণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ‘ভূত ভূত’ বলে চিৎকার করে তো ওঝা সেজে একদল স্বার্থপর ব্যবসায়ী তাদের উপর খবরদারি করবেই। 

এছাড়া অতিরিক্ত পরিমাণে মজুত করার নেশা অনেককেই যেন পেয়ে বসে। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষও অনেক সময় ক্ষুদে মজুতদার হয়ে ওঠে। এই স্বার্থপর মনোবৃত্তি পরিহার করে যতদিন না আমরা অসাধু ব্যবসায়ীদের সামাজিকভাবে ‘বয়কট' করতে পারছি ততদিন আমাদের মুক্তি নেই।

মুদ্রাস্ফীতি, ঘাটতি অর্থ-ব্যবস্থা, কালো টাকা : 

মুদ্রাস্ফীতির ফলে নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ে। আমাদের দেশের ঘাটতি অর্থব্যবস্থায় ব্যয় সংকুলানের জন্য সরকার অনেক সময় অতিরিক্ত নোট বাজারে ছাড়ে। ফলে সম্পদের তুলনায় টাকার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সেই টাকার বেশির ভাগই গিয়ে পড়ে মুষ্টিমেয় কিছু ভাগ্যবানের হাতে। ভাগ্যবানদের অনেকে আবার ঠিকমত কর দেন না এবং তাদের অনেকেই প্রভূত পরিমাণ হিসাব-বহির্ভূত কালো টাকার মালিক। 

এর ফলে যাদের ক্রয়-ক্ষমতা বেশি তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগ্যপণ্য ক্রয় করেন এবং জিনিসের দর বৃদ্ধিতে ইন্ধন যোগান। অতএব, নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসের দর বৃদ্ধি রোধ করতে হলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ যেমন আবশ্যক; ঠিক তেমনি আবশ্যক কালো টাকার দৌরাত্ম্য বন্ধ করা।

বণ্টন-ব্যবস্থা, পরিবহন ও যোগাযোগ : 

বণ্টন-ব্যবস্থায় ত্রুটির জন্য অনেক সময় বহু নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যায়। কোন জায়গায় কোন জিনিসটি কী পরিমাণ প্রয়োজন, আগে ভাগেই তার হিসেব নিয়ে যথাসময়ে ঠিক জায়গায় ঠিক জিনিসটি পৌঁছে দেওয়া হলো সুষ্ঠু বণ্টন-ব্যবস্থার মূল কথা। দুঃখের বিষয়, বণ্টন-ব্যবস্থার এই মৌল নীতির দিকে লক্ষ রেখে আমাদের দেশে প্রায়ই কাজ হয় না। 

এছাড়া, যানবাহন ও যোগাযোগ-ব্যবস্থার সমস্যাকে অনেক সময় জটিল করে তোলে। উপযুক্ত পথঘাট ও পরিবহনের অভাবে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় ঠিক জিনিসটি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় না। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে আমাদের যানবাহনের ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও অনেক উন্নত করতে হবে; নতুন নতুন পথঘাট নির্মাণ করে পরিবহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

উপসংহার : 

যে দেশে উৎপাদন কম বা পণ্যের যোগান কম সে দেশের দ্রব্যমূল্য বাড়বে। তাই দেশের দ্রব্যমূল্যের পরিমাণ হ্রাস করতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন দেশের পণ্যের সঠিক উৎপাদন ও সঠিক যোগান, তার সাথে টাকার মূল্য স্থিতিশীল রাখা। এই বিষয়গুলো সঠিকভাবে পালন করলে দেশ ও জাতি এ করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাবে।

Post a Comment

0 Comments

Bottom Post Ad