ভূমিকা :
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। যুগ যুগ ধরে বহু জাতি এদেশে এসেছে ও রাজত্ব করেছে। প্রাচীনকালের বহু কীর্তি যেমন-দালানকোঠা, মূর্তিস্তম্ভ, দেয়াল কিংবা পাথরে খোদাই করা লেখা, দীঘি, পুকুর ইত্যাদি বর্তমানে ঐতিহাসিক স্থান নামে চিহ্নিত।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ :
বাংলাদেশে বহু উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। কুমিল্লার ময়নামতি ও লালমাই এর পুরাকীর্তি, রাজশাহীর পাহাড়পুরে বৌদ্ধ সভ্যতার প্রাচীন দালানের ধ্বংসাবশেষ, মহাস্থানগড়, চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ও মগ রাজাদের কীর্তি, সিলেটের শাহজালালের দরগাহ, ময়মনসিংহের মধুপুরের গড়, বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ,
দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির ইত্যাদি ঢাকার বাইরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন। ঢাকায় অবস্থিত লালবাগের কেল্লা, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, সোনারগাঁ, পরীবিবির মাজার, আহসান মঞ্জিল, হোসেনী দালান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থান। এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন বাংলাদেশের গৌরব। নিচে বিখ্যাত কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শনের বিবরণ তুলে ধরা হলো।
আরও পড়ুন : পাহাড়পুর - ঐতিহাসিক স্থান বা দর্শনীয় স্থান : রচনা
মহাস্থানগড় :
মহাস্থানগড় প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় নগর ‘পুন্ড্রনগর'-এর ধ্বংসাবশেষ। এখানে ব্রাহ্মী রীতিতে লেখা একটি খণ্ডিত শিলালিপি পাওয়া গেছে। এর নাম মহাস্থানগড় ব্রাহ্মীলিপি। এটি থেকে ধারণা করা হয় যে, ‘পুন্ড্রনগর' নগরটি মৌর্যবংশীয় শাসকরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মৌর্য ও গুপ্ত রাজবংশের প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে মহাস্থানগড় স্থাপিত হয়েছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে বগুড়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত এ সভ্যতার অনেক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। মহাস্থানগড়ে সুলতান মাহীসওয়ারের মাজার, মোগল আমলের মসজিদ, বহু মঠ, পরশুরামের প্রাসাদ, জিয়তকুণ্ড, খোদার পাথর ভিটা, পোড়ামাটির দ্রব্যাদি, সোনা-রুপার অলংকার ও মুদ্রা ইত্যাদি পাওয়া গেছে।
ময়নামতি :
প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলো কুমিল্লার ময়নামতি। এটি কুমিল্লা জেলা শহরের ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। ১৯৫৫ সালে এখানে খনন কাজ শুরু হয়। ময়নামতির এ ব্যাপক অঞ্চলে খনন কাজের জন্য পঞ্চাশটির বেশি স্থান চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, কৌটিল্য মুড়া, ময়নামতি প্রাসাদ টিলা ও রূপবান মুড়া অন্যতম। ময়নামতির খনন কাজের ফলে বেশ কিছু তাম্রশাসন ও মূর্তি পাওয়া গেছে। এছাড়া অনেক সোনা ও রূপার পোড়ামাটির সিল, মূর্তি ইত্যাদি পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন : বাংলা প্রবন্ধ রচনা - সুন্দরবন
পাহাড়পুর :
এটি রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার বদলগাছি থানায় অবস্থিত। প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষের অন্যতম নিদর্শন পাহাড়পুর। এটি সোমপুর বিহার নামেও পরিচিত। এটি পাল রাজাদের সময়ের একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। ১৯২৩ সালে এটির খনন কাজ শুরু হয়। এখানকার মাটি খুঁড়ে প্রায় ২৪ মিটার উঁচু একটি ইটের স্তূপ পাওয়া গেছে।
পাহাড়পুরের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ হলো সোমপুর বিহার। এ ভূখণ্ডে যত বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সোমবার বিহারের আয়তন সবচেয়ে বড়। পাল রাজা ধর্মপাল এই মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিহারে ১৮৯টি কুঠুরি আছে। পাথরের গায়ে খোদাই করা ৬৩টি মূর্তি পাওয়া গেছে। পাহাড়পুরের অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্নান ঘাট সত্যপীরের ভিটা ও গনেধশ্বরীর মন্দির।
সোনারগাঁ :
বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক স্থান হলো সোনারগাঁ। এটি নারায়ণগঞ্জ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৩৩৯ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ সোনারগাঁয়ে স্বাধীন সুলতানি আমল শুরু করেন। সুবর্ণ গ্রাম থেকে মুসলিম শাসনামলে এর নামকরণ করা হয় সোনারগাঁ।
মসলিন কাপড়, ইসলাম শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার জন্য এর সুনাম ছিল। এখানে সুলতানি ও মোগল আমলের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বহু আবাসিক ভবন, দিঘি, মঠ, দরগাহ, সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের সমাধি, পাঁচবিবির মাজার প্রভৃতি রয়েছে। ১৯৭৫ সালে এখানে লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের পুরাকীর্তি - প্রবন্ধ রচনা
লালবাগ দুর্গ/কেল্লা :
রাজধানী ঢাকার লালবাগে এটি অবস্থিত। ১৬৭৮ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এটি নির্মিত হয়। এ নিদর্শনটি আওরঙ্গবাদ দুর্গ নামেও পরিচিত। এটি প্রাচীন অপূর্ব সুন্দর কারুকাজ খচিত। এখানে আরও রয়েছে দরবার হল, মসজিদ, শায়েস্তা খানের কন্যা পরীবিবির মার্বেল পাথরের বাঁধানো মাজার, পুকুর, সুড়ঙ্গ পথ ইত্যাদি।
এগুলোর মধ্যে ২৬-২৭টি কাঠামোর অস্তিত্বসহ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ছাদ-বাগান ও ঝর্নার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংস্কারের পর লালবাগ দুর্গ এখন বেশ খানিকটা উন্নত রূপ ধারণ করেছে এবং ভ্রমণকারী ও দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। দুর্গটির কেন্দ্রীয় অংশ জুড়ে রয়েছে তিনটি ভবন-পূর্ব দিকে হাম্মাম, পশ্চিমে মসজিদ এবং এগুলোর মাঝখানে পরীবিবির সমাধিসৌধ। দুর্গে বিদ্যমান ভবনগুলোর মধ্যে পরীবিবির সমাধিসৌধটি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। লালবাগ দুর্গের মসজিদটি তিন
ঐতিহাসিক নিদর্শনের গুরুত্ব :
বাংলাদেশের অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন এদেশের পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ ও লাভবান করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বৌদ্ধ সাবলম্বী টুরিস্টদের দর্শনীয় ময়নামতি, পাহাড়পুর ও মহাস্থানগড়ের মতো সমৃদ্ধ ও সুপ্রাচীন কীর্তি পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে পারে। আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো বাঙালি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অংশ।
গুরুত্বপূর্ণ এ নিদর্শনগুলো দেখে আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু শিখতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে অতীত বাংলার সভ্যতা সংস্কৃতি তথা জনজীবনধারা। শিক্ষার্থীরা এসব স্থান দেখার সুযোগ থেকে মানসিক পরিতৃপ্তি লাভ করে। অবসর সময়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসব স্থানে বেড়ালে তাদের জানা ও চেনার আগ্রহ পূরণ হয়।
এছাড়া ঐতিহাসিক স্থানে প্রাচীন নিদর্শনগুলো দেখে একঘেয়েমি জীবন থেকে কিছু দিনের জন্য মুক্ত হয়ে আনন্দ উপভোগ করতে পারে। সুতরাং বলা যায়, ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো যেমন জাতির গৌরব তেমনি তা পর্যটকদের জন্য উৎকৃষ্ট বিনোদন মাধ্যম।
উপসংহার :
বাংলাদেশের উন্নয়নের দিক নির্দেশনা ও সামনে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা হিসেবে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো মাইলফলক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এগুলো দীর্ঘদিন সুরক্ষিত রাখার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাহলে আমাদের অনাগত নতুন প্রজন্ম এদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং এ জাতির কর্মদক্ষতা ও মেধার উৎকর্ষ দেখে গৌরব বোধ করবে।
আরও পড়ুন : রচনা : জাতীয় গাছ আম গাছ