ভূমিকা :
বাংলাদেশে নানান সম্প্রদায় ও জাতিসত্তার মানুষ দীর্ঘকাল ধরে একসাথে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। এখানে প্রধান জনগোষ্ঠী 'বাঙালি'। এর পাশাপাশি আছে প্রায় অর্ধশত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। এসব জাতির মানুষদের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য; রয়েছে বিচিত্র ভাষা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। জীবন প্রণালিতে বৈচিত্র্য থাকলেও আমরা জাতীয়তার পরিচয়ে এক এবং দেশকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে একতাবদ্ধ। যুগ যুগ ধরে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ তাই শান্তি ও সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে আছে।
চাকমা :
মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত চাকমা সম্প্রদায়ের প্রধান বসতি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায়। নিজেদের মধ্যে তারা 'চাঙমা' নামে পরিচিত। তাদের নিজস্ব ভাষা ও হরফ রয়েছে। চাকমারা পিতৃতান্ত্রিক, পিতাই পরিবারের প্রধান । সমাজের প্রধান হলেন রাজা আর গ্রামের প্রধানকে বলা হয় কারবারি । চাকমারা প্রধানত বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ।
গারো :
গারো জনগোষ্ঠীর প্রধান বসতি ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা ও সিলেট অঞ্চলে। গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। মেয়েরা পরিবারের সম্পত্তির মালিক হয় । গারোদের নিজস্ব ধর্ম আছে। এটি এক ধরনের প্রকৃতিপূজা। ‘তাতারা রাবুগা' তাদের প্রধান দেবতা । তবে এখন অধিকাংশ গারো খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। এ সম্প্রদায় প্রধানত কৃষিজীবী। পাহাড়ে বসবাসকারী গারোরা জুমচাষ করে। আর সমতলের গারোরা সাধারণ নিয়মে কৃষিকাজ করে থাকে। গারো সংস্কৃতিতে গীতবাদ্য ও নৃত্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নিজস্ব কিছু বাদ্যযন্ত্রও আছে। নববর্ষ, নবান্ন ইত্যাদি উপলক্ষ্যে তারা বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করে থাকে । ‘ওয়ানগালা' গারো সমাজের একটি জনপ্রিয় উৎসব।
আরও পড়ুন : প্রবন্ধ রচনা : দুর্গাপূজা
মারমা :
মারমা সম্প্রদায়ও মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত এবং তাদের প্রধান বসতি পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহে। মারমাদেরও নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই এ সম্প্রদায় বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। মারমা জনগোষ্ঠী বেশ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত। তাদের সবচেয়ে বড়ো উৎসব হলো নববর্ষে সাংগ্রাই দেবীর পূজা এবং এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সাংগ্রাই উৎসব ।
সাঁওতাল :
সাঁওতাল জনগোষ্ঠী প্রধানত উত্তরবঙ্গ ও সিলেটের চা বাগানে বসবাস করে। অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত সাঁওতালরা মূলত বারোটি গোত্রে বিভক্ত। এদের সামাজিকব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। সাঁওতালদের নিজস্ব ধর্ম আছে কিন্তু কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই। পেশার দিক থেকে এই জনগোষ্ঠী প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত- কৃষক ও শ্রমিক। সাঁওতালরা খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে 'সোহনাই' হচ্ছে সাঁওতাল সমাজের শ্রেষ্ঠ উৎসব।
হাজং :
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার গারো পাহাড় সংলগ্ন সমতলভূমি এলাকায় হাজং সম্প্রদায় বসবাস করে। এদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। পিতার সম্পত্তিতে মেয়ের কোনো অংশ থাকে না। এরা আসামের আদি অধিবাসী এবং কাছারি নামক হাজং সম্প্রদায় নিজেদের সনাতনী হিন্দু বলে দাবি করে। তবে হিন্দুদের সঙ্গে এদের ধর্মীয় রীতি-নীতি ও পূজা-পার্বণে পার্থক্য আছে।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের উৎসব - রচনা ( ২০ পয়েন্ট )
খাসিয়া :
খাসিয়া জাতিগোষ্ঠী সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাস করে। তারা ছোটো ছোটো পাড়ায় একত্র হয়ে বসবাস করে। এ ধরনের পাড়াকে পুঞ্জি বলা হয়। খাসিয়া সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। এদের জীবিকা মূলত কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল।
মণিপুরি :
মণিপুরিদের আদি নিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যে। ১৭৬৫ সালের পর তারা এদেশের সিলেট অঞ্চলে চলে আসে। এদের প্রতি পাড়াতেই দেবমন্দির ও মণ্ডপ থাকে। ওই মন্দির ও মণ্ডপকে ঘিরেই পাড়ার ধর্মীয় ও সামাজিক যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তাদের প্রাচীন ধর্মের নাম 'আপোকপা' ।
অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তা :
উল্লিখিত সম্প্রদায়গুলো ছাড়াও এদেশে আরও বেশ কিছু ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। তাদের মধ্যে কুকি, মরুং, লুসাই, টিপরা, খুমি, ওঁরাও, রাখাইন, তঞ্চঙ্গ্যা, রাজবংশী, পাঙন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিটিরই রয়েছে আলাদা আলাদা সংস্কৃতি ও জীবনধারা।
উপসংহার :
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের বৈচিত্র্যময় জীবন ও সংস্কৃতি সুদীর্ঘকাল ধরে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে করেছে বর্ণিল। তাছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। একক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে তাদের ভূমিকা অতুলনীয় ।