মহান আল্লাহ যাদেরকে তাঁর রাসূলের সঙ্গীরূপে নির্বাচন করেন তাঁদের কর্মকাণ্ড মানবজাতির জন্য একটি উৎকৃষ্টতম নমুনা। রাসূল (স)-এর অনু ছিল তাঁর সাহাবীদের জীবনের মূল লক্ষ্য। তাদের জীবন মরণ উভয়ই ছিল ইসলাম জন্য। নিম্নে প্রশ্নালোকে এ সংক্রান্ত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।
সাহাবা অর্থ কি ?
সাহাবা এর আভিধানিক অর্থ : صَحَابَةٌ শব্দটি صَحَابِيٌّ এর বহুবচন। আভিধানিক অর্থ হলো— সাথি, সঙ্গী, বন্ধু, সহচর, অনুসারী, companion ইত্যাদি ।
সাহাবা কাকে বলে ?
শরীয়তের পরিভাষায়- মানবজাতির মাঝে এমন একটি সম্মানিত জামায়াত যারা মুহাম্মদ (স)-কে পেয়েছেন ও তাঁর রিসালাতের ওপর ঈমান এনেছেন, তাকে ভালোবেসেছেন ও ঈমানের ওপর অটল থেকে ইন্তেকাল করেছেন তাদেরকে সাহাবী বলা হয়।
আরো : নবী করীম (সা) এর: জন্ম, নাম, বংশ পরিচয় ও মর্যাদা
সাহাবায়ে কেরামের আখলাক বা চরিত্র :
১. মহানবীর অনুসরণ : মহানবী (স)-এর ইত্তেবা বা অনুসরণ ছিল সাহাবায়ে কেরামের আখলাক বা চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই তাঁদের সততা, বিশ্বস্ততা, ভদ্রতা, আত্মত্যাগ ও সদাচরণ তুলনাহীন।
তাঁদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (স)-এর অনুসরণ ও অনুকরণের মাত্রা এতটা পূর্ণতা ও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেছিল যে, পূর্ববর্তী নবীদের মধ্য থেকে কোনো নবীর অনুসারীদের অনুকরণ তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি।
যখন তাঁরা রাসূলুল্লাহ (স)-কে কোনো কাজ করতে দেখতেন তখন তাঁরাও তা করতেন, শুধু এজন্য যে, রাসূল (স) তা করেছেন ।
২. কাফেরদের প্রতি কঠোর : সাহাবায়ে কেরাম তথা মহানবীর সাথিগণ ইসলামের ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন আর কাফেরদের প্রতি কঠোর অবস্থানে। যেমন মহান আল্লাহর বাণী- مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ অর্থাৎ, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল; আর তাঁর সাথে যারা আছেন (তাঁর সাহাবীগণ) কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর।
আরো : সাহাবা কারা? তাদের পরিচয় ও তাদের সমালোচনা করার বিধান
৩. পরস্পর সহানুভূতিশীল : রাসূল (স)-এর সাহাবিগণ ছিলেন একে অপরের প্রতি সকল ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ও দয়ার্দ্র। যেমন আল্লাহ তায়ালার বাণী- رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ অর্থাৎ, তারা তাদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও দয়ার্দ্র।
৪. সেজদাবনত : সাহাবায়ে কেরাম একটু সময় পেলেই তা আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করতেন। তারা আল্লাহর সামনে সেজদাবনত থাকতে অত্যধিক ভালোবাসতেন। যেমন মহান আল্লাহর বাণী- تَرَاهُمْ رَاكِعًا سُجُودًا অর্থাৎ, আপনি তাদেরকে সেজদাবনত দেখতে পাবেন ।
৫. আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা : সাহাবায়ে কেরাম মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সর্বদা ইবাদতে মশগুল থাকেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন- تَرَاهُمْ رُكَعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللهِ وَرِضْوَانًا – অর্থাৎ, আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে সেজদাবনত দেখতে পাবেন ।
৬. চেহারায় সেজদার চিহ্ন প্রস্ফুটিত : সাহাবায়ে কেরামের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন আর এ সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় হিসেবে আল্লাহর সামনে মাথাবনত করা এবং তাঁর সমীপে সেজদায় লুটিয়ে পড়াকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন।
আর আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দা হিসেবে তাদের চেহারায় সেজদার চিহ্ন রেখে দিয়েছেন । যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ অর্থাৎ, তাদের চেহারায় সেজদার চিহ্ন ও প্রভাব প্রস্ফুটিত থাকবে।
আরো : সাহাবা কাকে বলে? সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা কোরআন হাদিসের আলোকে
৮. রাসূলের সামনে নীচু কণ্ঠ : সাহাবায়ে কেরামের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তারা আল্লাহর রাসূলের সামনে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বিনয়ের সাথে নীচু কণ্ঠে কথা বলতেন । আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- إِنَّ الَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَ رَسُولِ اللهِ অর্থাৎ, যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নীচু করে ।
৯. তাকওয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষিত : সাহাবায়ে কেরাম হলেন তাকওয়ার ব্যাপারে – আল্লাহ কর্তৃক পরীক্ষিত একদল সোনার মানুষ। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- أولئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوى অর্থাৎ, আর তারা হলেন এমন ব্যক্তিত্ব আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন।
১০. ক্ষমা প্রাপ্ত : সাহাবায়ে কেরামের জন্য রয়েছে পরকালে মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ অর্থাৎ,আর তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার ।
১১. জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ : সাহাবায়ে কেরাম উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়ায় পরকালে জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভে ধন্য হবেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (স) বলেন- যে মুসলিম হিসেবে আমাকে দেখেছে এবং আমি যাদের দেখেছি, তাদেরকে আগুন স্পর্শ করবে না” (তিরমিযী)।
তিনি আরো বলেন, আমার কোনো সাহাবী কোনো স্থানে ইন্তেকাল করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন ঐ এলাকার নেতা বা নূর হিসেবে উঠাবেন (তিরমিযী)। তাঁরা দীনের হাদী ইসলামের নক্ষত্র।
সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য :
আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এরশাদ করেন-
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ- رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رَاكِعًا سُجُودًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا- سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ-
অর্থাৎ, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল; তাঁর সাহাবীগণ কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদায় অবনত দেখবেন। তাদের চিহ্ন হলো তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার প্রভাব পরিস্ফুট থাকবে। (সূরা ফাতহ : আয়াত- ২৯)
আয়াতে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যাবলি : এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সাহাবায়ে কেরাম তথা ঈমানদারদের কয়েকটি গুণ, চারিত্রিক অবস্থা এবং তাদের বাস্তব পরিচয় তুলে ধরেছেন । প্রশ্নোল্লিখিত আয়াতে সাহাবায়ে কেরামের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে ওঠে তা নিম্নরূপ-
১. তাঁরা কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর। আর এ কাফেরদের মধ্যে তাঁদের আত্মীয়স্বজন, ভাইবোন এবং বন্ধুবান্ধব রয়েছে; কিন্তু তাঁরা এদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন ।
২. তাঁরা পরস্পর পরস্পরের মুসলিম ভাই বোনের প্রতি অত্যন্ত অনুগ্রহশীল ।
৩. তাঁরা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্ত যথাসময়ে রুকু সেজদায় রত থাকেন। এর মাধ্যমে তাঁরা নিজেদেরকে মহান আল্লাহর কাছে সঁপে দেন ।
৪. তাঁরা মহান আল্লাহর সন্তোষ ও অনুগ্রহ অন্বেষণ করেন ।
৫. তাঁদের পঞ্চম গুণ হলো, সেজদার চিহ্ন তাঁদের চেহারায় দেদীপ্যমান। সেজদা দেয়ার ফলে তাদের চেহারায় কিংবা কপালে যে কালো দাগ পড়ে যায়, এখানে তার কথা বলা হয়নি; বরং এখানে চিহ্ন বলতে আল্লাহভীতি, উদারতা ও উন্নত নৈতিকতার যে সকল লক্ষণ ও নিদর্শন আল্লাহর আনুগত্যমূলক জীবনযাপনের ফলে স্বভাবতই মানুষের মুখমণ্ডলে ভেসে ওঠে, তা বোঝানো হয়েছে।
পরিশেষে : সাহাবায়ে কেরাম হলেন বিশ্বমানবতার মহান আদর্শ মহানবী (স)-এর হাতে গড়া সোনার মানুষ। তারা বিশ্ববাসীর মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ গুণাবলির অধিকারী। অতএব, প্রতিটি মুসলিমের উচিত তাঁদের গুণাবলি অর্জনের চেষ্টা করা।