মহান আল্লাহর দীদার লাভই মুমিনের চরম ও পরম পাওয়া। তবে তাঁকে দেখার সৌভাগ্য দুনিয়াতে সম্ভব না হলেও জান্নাতে অবশ্যই নসীব হবে। এটাই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা। তবে মুতাযিলারা এর বিরোধিতা করেছে। নিম্নে প্রশ্নালোকে এ সংক্রান্ত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।
পৃথিবীতে মহান আল্লাহকে দেখা যাবে কিনা :
মুসলিম উম্মাহর সকল মনীষীই এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, দুনিয়ায় থাকাবস্থায় কেউই স্বচক্ষে মহান আল্লাহকে দেখতে পায়নি এবং পাবেও না ।
পরকালে আল্লাহকে দেখার বর্ণনা :
এ ব্যাপারে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা হচ্ছে, পরকালে আল্লাহকে দেখা যাবে। জান্নাতবাসীগণ তাকে হাশরের ময়দান এবং জান্নাত উভয় স্থানেই দেখতে পাবেন। কাফের ও মুশরিকরা হাশরের ময়দানে ভয়ভীতির মধ্যে আল্লাহকে দেখতে পাবে।
আরো : তাওহীদ শব্দের অর্থ কি? কাকে বলে। কত প্রকার ও কি কি
আয়াতে এসেছে- لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ অর্থাৎ, যারা নেক কাজ করেছে, তাদের জন্য উত্তম বস্তু তথা জান্নাত এবং অতিরিক্ত আরো কিছু রয়েছে। (সূরা ইউনুস : আয়াত- ২৬)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূল (স) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘অতিরিক্ত আরো কিছু বলতে আল্লাহর মুখমণ্ডলের দিকে তাকানোকে বোঝানো হয়েছে। অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (স) উক্ত আয়াত পাঠ করে বলেন, “যখন জান্নাতবাসীগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং জাহান্নামবাসীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তখন একজন আহ্বানকারী ডেকে বলবে, ওহে জান্নাতবাসীগণ!
আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে দেয়া একটি প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তিনি তা পূর্ণ করতে চান। তারা সবাই বলবে, সে প্রতিশ্রুতি কী? তিনি কি আমাদের ওজনের পাল্লা ভারী করেননি, আমাদের মুখমণ্ডলকে উজ্জ্বল করেননি, আমাদেরকে কি জান্নাতে প্রবেশ করাননি এবং আগুন থেকে কি নাজাত দেননি? ঠিক এমন সময় আল্লাহ পর্দা উন্মোচন করবেন, তখন তারা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে।
আরো : ইসলাম ও ঈমান কাকে বলে?এদের মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্য
এ সময় তারা মনে করবে, তাঁর প্রতি দৃষ্টি দেয়ার চেয়ে অধিক পছন্দনীয় অপর কোনো বস্তু তিনি তাদের দেননি, এটিই হচ্ছে আয়াতে বর্ণিত সে ‘যিয়াদা’ তথা ‘অতিরিক্ত বস্তু’ । জান্নাতিগণ এ সময় আল্লাহকে দেখতে পেলেও জাহান্নামিরা তখন আল্লাহকে দেখতে পাবে না ।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- كَلَّا إِنَّهُمْ عَنْ رَبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَمَحْجُوبُونَ অর্থাৎ, কস্মিনকালেও নয়, সেদিন তারা তাদের রবের দর্শন হতে প্রতিরুদ্ধ অবস্থায় থাকবে। (সূরা মুতাফফিফীন : আয়াত- ১৫)
ইমাম শাফেয়ী (র)-সহ অন্যান্য ইমামগণ এ আয়াত দ্বারা জান্নাতবাসীদের জান্নাতে আল্লাহকে দেখার ব্যাপারে দলীল দিয়েছেন। জান্নাতবাসীদের আল্লাহকে দর্শনের ব্যাপারে রাসূল (স) বলেছেন, إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ عَيَانًا كَمَا تَرَوْنَ هَذَا، لَا تُضَامُونَ فِي رُؤْيَتِهِ۔ অর্থাৎ, নিশ্চয় তোমরা তোমাদের প্রভুকে চক্ষু দিয়েই এমনভাবে দেখতে পাবে, যেমন তোমরা এই চাঁদ দেখতে কোনো অসুবিধা অনুভব করো না।
আদী ইবনে হাতেম (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস দ্বারা জাহান্নামিদের হাশরের ময়দানে আল্লাহকে দেখার কথা প্রমাণিত হয়। তিনি বলেন, রাসূল (স) বলেছেন, যেদিন আল্লাহর সাথে, তোমাদের সাক্ষাৎ করার কথা সেদিন তোমাদের একজন আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, তার এবং আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকবে না, কোনো অনুবাদকও অনুবাদ করার জন্য থাকবে না।
আরো : নবী করীম (সা) এর: জন্ম, নাম, বংশ পরিচয় ও মর্যাদা
তখন তিনি বলবেন, আমি কি তোমার নিকট এমন রাসূল প্রেরণ করিনি, যিনি তোমাকে দীনের কথা শোনাতেন? তখন সে বলবে হ্যাঁ, আপনি পাঠিয়েছেন”। এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, সেদিন আল্লাহর সাথে প্রত্যেকের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হবে। এ ধরনের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন-وَكُلُّهُمْ آتِيهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَرَدًا অর্থাৎ, কেয়ামত দিবসে প্রত্যেকেই আল্লাহর কাছে একা এসে উপস্থিত হবে। (সূরা মারইয়াম : আয়াত- ৯৫)
উপরিউক্ত হাদিস এবং আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ সময় মুমিন ও কাফের নির্বিশেষে সবাই আল্লাহকে দেখতে পাবে, তবে কাফেরদের এ দেখাটি হবে ভয় ভীতি ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে।
আল্লাহকে দেখার ব্যাপারে মুতাযিলাদের অভিমত :
আল্লাহ তায়ালাকে পরকালে দেখার ব্যাপারে সাহাবীগণ থেকে প্রায় ত্রিশটির মতো হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহকে দেখা যাওয়া সংক্রান্ত হাদীসের সংখ্যা অনেকটা তাওয়াতুরের পর্যায়ে পৌছা সত্ত্বেও তা মুতাযিলা, জাহমিয়া, খারেজী ও ইমামিয়া সম্প্রদায়ের নিকট গোপন রয়েছে। তাই তারা তা অস্বীকার করে বলেছে, আল্লাহকে হাশরের মাঠে এবং জান্নাতে কোথাও দেখা সম্ভবপর নয়।
তারা তাদের দাবির সপক্ষে নিম্নোক্ত আয়াতের দ্বারা দলীল দিয়ে থাকে- رَبِّ ارِنِي أَنْظُرْ إِلَيْكَ، قَالَ لَنْ تَرَانِي অর্থাৎ, মুসা (আ) বলেন, প্রভু! আমাকে দেখা দাও, আমি তোমাকে দেখব। আল্লাহ বলেন, তুমি আমাকে কক্ষনো দেখতে পাবে না। (সূরা আরাফ : আয়াত- ১৪৩)
এ আয়াত দ্বারা দলীল দিয়ে তারা বলেন, এখানে لَنْ অব্যয়টি স্থায়ী নিষেধের অর্থে ব্যবহার হয়েছে এবং তা পরকালেও আল্লাহকে দেখা সম্ভব না হওয়ার বিষয় প্রমাণ করে। তারা নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারাও দলীল দিয়ে থাকে-
لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ অর্থাৎ, আল্লাহকে কোনো চক্ষু দেখতে পারে না, অথচ তিনি সকল চক্ষুকে দেখতে পারেন। (সূরা আনয়াম : আয়াত- ১০৩)
তাদের যুক্তি খণ্ডন :
এ আয়াত দুটিকে মুতাযিলারা তাদের মতের পক্ষের দলীল মনে করে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তাতে তাদের বিপক্ষ মতেরই দলীল রয়েছে। প্রথম আয়াতটি দ্বারা বিপক্ষ মতের দলীল কয়েকভাবে পেশ করা যায়। যেমন-
১. হযরত মুসা (আ) কর্তৃক আল্লাহকে দেখতে চাওয়ার দ্বারা প্রমাণিত হয়, আল্লাহকে দেখা সম্ভব। তা যদি সম্ভব না হতো, তাহলে মুসার মতো জলীলুল কদর রাসূলের কাছে তা গোপন থাকত না এবং তিনি তা চাইতেনও না ।
২. আল্লাহকে দেখা যদি একেবারেই অসম্ভব হতো, তাহলে আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ)-এর আবেদনকে ঠিক সেভাবেই প্রত্যাখ্যান করতেন। যেমন নূহ (আ)-এর পক্ষ থেকে তাঁর ছেলের নাজাতের ব্যাপারে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তাঁকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি তুমি জাহেলদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। (সূরা হুদ : আয়াত- ৪৯)
৩. মুসা (আ)-এর আবেদনের জবাবে মহান আল্লাহ সরাসরি এ কথা বলেননি যে, আমাকে দেখা যায় না বা আমাকে দেখা বৈধ নয় বা আমি দেখার যোগ্য নই; বরং আল্লাহ বলেন- অর্থাৎ, আমাকে কস্মিনকালেও তুমি দেখতে পাবে না।
এতে প্রমাণিত হয়, মানবীয় দুর্বলতার কারণে দুনিয়াতে থাকাবস্থায় চর্মচক্ষু দিয়ে আল্লাহকে দেখতে পারবে না বলেই মহান আল্লাহ মুসা (আ)-কে এ কথা বলেছেন। আল্লাহকে যে একেবারেই দেখা অসম্ভব, সেজন্য তিনি এ কথা বলেননি।
৪. মানবীয় দুর্বলতাই যে এর পথে মূল অন্তরায়, তা বোঝানোর জন্য আল্লাহ মুসা। (আ)-কে বললেন, পাহাড়ের দিকে তাকাও, তা যদি এত শক্ত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর তাজাল্লির সামনে নিজ অবস্থায় থাকতে না পারে, তাহলে তুমি পাহাড়ের তুলনায় অতীব দুর্বল মানুষ হয়ে আমাকে কিভাবে দেখতে পাবে?
৫. পাহাড়ের মতো নির্জীব পদার্থের সামনে আল্লাহর তাজাল্লি প্রকাশ করা যদি বৈধ হয়, তাহলে আল্লাহর রাসূল ও তাঁর অলীদের সামনে জান্নাতে তাঁর প্রকাশ হওয়া কেন অবৈধ হবে?
৬: لَنْ অব্যয়টি সবসময় নিষেধের অর্থ প্রকাশ করে বলে তারা যে দাবি করেছেন, দুটি কারণে তা সঠিক নয়-
ক. যদি তা সে রকম হতো, তাহলে সে নিষেধকে কোনো বস্তু অর্জিত হওয়া বা নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখার সাথে এর নিষেধকে সীমাবদ্ধ করা যেত না, অথচ তা কুরআনে সীমাবদ্ধ হয়ে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- فَلَنْ أَبْرَحَ الْأَرْضَ حَتَّى يَأْذَنَ لِي أَبِي أَوْ يَحْكُمَ اللهُ لِي۔
অর্থাৎ, পিতার অনুমতি অথবা আল্লাহ আমাকে কোনো নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কস্মিনকালেও আমি এ স্থান ত্যাগ করব না । (সূরা ইউসুফ : আয়াত- ৮০) এ আয়াতের মধ্যে এ অব্যয়টি পিতার অনুমতি অথবা আল্লাহর নির্দেশ অর্জনের দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে বর্ণিত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, অব্যয়টি কোনো পূর্বলক্ষণ ব্যতীত সবসময় চিরস্থায়ী নিষেধজ্ঞাপক অর্থ প্রকাশ করে না।
খ. মহান আল্লাহকে দেখা যদি সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব ব্যাপার হতো, তাহলে আল্লাহ মুসা (আ)-কে বলতেন, আমাকে দেখা যায় না; কিন্তু তা না বলে যখন বলেছেন, “আমাকে কস্মিনকালেও দেখতে পারবে না” প্রমাণিত হয়, আল্লাহকে দেখা একটি সম্ভবপর ব্যাপার, তবে তা এ পার্থিব জগতে সম্ভব না হলেও পরকালে নিশ্চয়ই সম্ভব হবে।
আর সেজন্যই আল্লাহ তায়ালা তাঁর দর্শনকে জান্নাতে মুমিনদের জন্য প্রমাণ করে বলেছেন-تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ অর্থাৎ, যেদিন তারা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সেদিন তাদের সাদর সম্ভাষণ হবে সালাম। (সূরা আহযাব : আয়াত-৪৪)
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, জান্নাতে মুমিনদের সাথে আল্লাহর সাক্ষাৎ হবে, আর সাক্ষাৎ হলে দেখাও হবে। কেননা দেখাবিহীন সাক্ষাৎ বোধগম্য নয় ।
দ্বিতীয় আয়াত দ্বারা আল্লাহর দর্শন সম্ভব হওয়া এভাবে প্রমাণ করা যায় যে, আল্লাহ এ আয়াতটি প্রশংসামূলকভাবে বলেছেন। আর একথা সর্বজনবিদিত যে, প্রমাণিত কোনো বৈশিষ্ট্য দিয়েই প্রশংসা করা হয়ে থাকে। যে বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত নয়, তার মধ্যে কোনো পূর্ণতা নেই, সেজন্য তা দিয়ে কোনো প্রশংসা করা যায় না ।
আল্লাহ যখন এ আয়াতটি প্রশংসার উদ্দেশ্যে বলেছেন, তাতে প্রমাণিত হয়, তিনি এর দ্বারা এটাই বলতে চেয়েছেন যে, তিনি এমন যে, তাঁকে দেখা গেলেও অন্যান্য বস্তুর ন্যায় তাঁকে কেউ পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পারবে না।