মহান আল্লাহ যুগে যুগে সঠিক পথের নির্দেশনার জন্য অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন ৷ তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আল্লাহ এ সকল প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলায় তাদেরকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী মুজিযা দিয়েছিলেন।
মুজিযা আভিধানিক অর্থ : মু’জিযা (مُعجِزَةٌ) শব্দটি আরবি । এর অর্থ – অক্ষমকারী, অপারগকারী ইত্যাদি।
সংজ্ঞা : নবীগণ তাদের নবুয়তের দাবী প্রমাণ করতে যে সকল অলৌকিক কর্ম বা নিদর্শন প্রদর্শন করেন সেগুলোকে মুজিযা বলা হয়।
মুজিযা এর দৃষ্টান্ত :
সকল নবী রাসূলই আল্লাহর পক্ষ থেকে মুজিযাপ্রাপ্ত ছিলেন যেমন- ১. মুসা (আ)-এর লাঠি সর্পে পরিণত হওয়া, ২. ঈসা (আ) কর্তৃক মৃতকে জীবিত করা, ৩. ইবরাহীম (আ) জ্বলন্ত অগ্নিতে নিরাপদে থাকা, ৪. আসহাবে কাহাফ-এর ঘটনা, ৫. নবী মুহাম্মদ (স)-এর ওপর অবতীর্ণ আল কুরআন একটি চিরন্তন মুজিযা ইত্যাদি ।
আরও : মুজিজা শব্দের অর্থ, সংজ্ঞা, রাসূল (সা) এর প্রধান মুজিজা
মুজিযা যাদের জন্য নির্দিষ্ট :
মুজিযা কাদের জন্য নির্দিষ্ট, এ ব্যাপারে মুহাক্কিক আলেমগণ বলেন- মুজিযা নবী রাসূলদের থেকে প্রকাশিত হয়, অন্য কারো থেকে নয় । এ ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিস ও মুফাসসির একমত যে, মুজিযা নবী রাসূলগণের জন্যই নির্দিষ্ট। কেননা এগুলো তাঁদের পক্ষ থেকেই প্রকাশিত হয়। তাদের ব্যতীত অন্য কোনো মানুষের পক্ষ থেকে প্রকাশিত অসাধারণ ঘটনা তথা নিদর্শন মুজিযা বলা যায় না; বরং কারামত, ইসতিদরাজ ইত্যাদি বলা হয়।
মুজিযার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য :
মুজিযার হাকীকত তথা তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক ও যুক্তিযুক্ত। যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বাতিলের অযৌক্তিক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন এবং সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ মুজিযার হাকীকতসমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
১. মুজিযা আল্লাহর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ : আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ এবং আল্লাহর নির্দেশেই মুজিযা প্রকাশিত হয়ে থাকে। যা বিভ্রান্ত মানুষের অন্ধকারের পর্দা দূর করে দিয়ে সত্যপথের দিশা দান করে। যেমন মহান আল্লাহর বাণী-
قُلْ إِنَّمَا الْأَيَاتُ عِندَ اللهِ .
২. ভ্রান্ত বিশ্বাসের জবাব : এক শ্রেণির মানুষ বিশ্বাস করত, পৃথিবী প্রকৃতির নিয়মে চলছে মুজিযা এ ভ্রান্ত বিশ্বাসের জবাব দিয়েছে। প্রকৃতি মহান আল্লাহর অনন্য সৃষ্টি। তাঁর সৃষ্টিতে অলৌকিকত্ব বা ব্যতিক্রম করার ক্ষমতা রয়েছে। যেমন মহান আল্লাহর বাণী-
١ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
٢ وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآيَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ لِكُلِّ أَجَلٍ كِتَابٌ.
আরও : মুজিযা ও কারামতের সংজ্ঞা, অর্থ ও পার্থক্য
৩. আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশ পালন : কাফেররা নবীগণকে প্রমাণ উপস্থাপন করতে বললে তাঁরা বলতেন- আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তোমাদের নিকট প্রমাণ তথা মুজিযা উপস্থিত
করা আমাদের কাজ নয় ।
৪. নবুয়তের দাবির সত্যতা প্রমাণ : নবীগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত মুজিযার মাধ্যমে নবুয়ত ও রিসালাতের সত্যতা প্রমাণ করেন, এতে মানুষের ঈমান মযবুত হয়। যেমন পবিত্র কুরআনে এসেছে-
وَقَسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ إِيمَانِهِمْ لَئِنْ جَاءَتْهُمْ آيَةٌ لَيُؤْمِنُنَّ بِهَا
অর্থাৎ, তারা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে শপথপূর্বক বলে যে, যদি তাদেরকে অলৌকিক নিদর্শন দেখানো হয়, তাহলে তারা ঈমান আনয়ন করবে।
৫. দাওয়াতী কাজের সহায়তা : নবী রাসূলগণ আল্লাহপ্রদত্ত দাওয়াতী কাজ করতে গেলে কঠিন প্রতিকূলতার স্বীকার হন। আল্লাহ তায়ালা তখন মুজিজা এর মাধ্যমে তাদের দাওয়াতী কাজে সাহায্য করেন। এমনকি তাঁদের শক্তি বৃদ্ধি করে সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেন। যেমন মহান আল্লাহর বাণী-
فَعَزَّزْنَا بِثَالِثٍ فَقَالُوا إِنَّا إِلَيْكُمْ مُرْسَلُونَ
৬. বিরুদ্ধবাদীদের মোকাবেলা করা : নবীগণকে শত্রুদের চ্যালেঞ্জ প্রতিহত করতে আল্লাহ মুজিযা প্রদান করেন। তারা এ মুজিযার মাধ্যমে কাফেরদের মোকাবেলা করেছেন। যেমন মুসা (আ) ফিরাউনের যাদুর ওপর মুজিযা প্রদর্শন করেছেন এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন-
قَالَ الْقِهَا يَا مُوسَىٰ فَالْقِهَا فَإِذَا هِيَ حَيَّةٌ تَسْعَىٰ قَالَ خُذْهَا وَلَا تَخَفْ سَنُعِيدُهَا سِيرَتَهَا الْأُولَىٰ
৭. আবেদন পূরণ করা : অমুসলিমরা কোনো বিষয়ের প্রমাণ চাইলে কিংবা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনার আবেদন করলে আল্লাহ নবী রাসূলগণের মাধ্যমে মুজিযা প্রদর্শনের মাধ্যমে কাফের মুশরিকদের আবেদন পূরণ করেন। যেমন আল কুরআনে এসেছে-
إِذْ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَنْ يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ
এমনকি এজন্যই আল্লাহ তায়ালা আসহাবে কাহাফের ঘটনা বর্ণনা করে একটি সূরা অবতীর্ণ করেন, যাতে তারা এ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে এবং ঈমানদার হতে পারে। যেমন মহান আল্লাহর বাণী-
قَالَ رَبِّي أَعْلَمُ بِعَدْتِهِمْ مَا يَعْلَمُهُمْ إِلَّا قَلِيلٌ فَلَا تُمَارِ فِيهِمْ إِلَّا مَرَاءً ظَاهِرًا وَلَا تَسْتَفْتِ فِيهِمْ مِنْهُ أَحَدًا
৮. ঈমান আনয়নে উদ্বুদ্ধ করা : সকল যুগের মানুষকে ঈমান আনয়নের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা নবী রাসূলগণকে মুজিযা প্রদান করেছিলেন।
৯. ভণ্ডনবী থেকে হেফাযত করা : নবীগণকে মুজিযার মাধ্যমে ভুয়া নবুয়তী এবং ভণ্ডনবীর দাবি থেকে হেফাযত করা হয়েছে।
১০. নবীগণের বিশেষ মর্যাদা প্রকাশ : মুজিযা নবীগণের বিশেষ ক্ষমতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার প্রমাণ। সাধারণ ও অবিশ্বাসী মানুষের যা সাধ্যের বাইরে, নবীগণের জন্য তা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হযরত ঈসা (আ) কর্তৃক মৃতকে জীবিত করা, কুষ্ঠরোগ ও জন্মান্ধকে ভালো করা এবং নূহ (আ)-এর নৌকা ইত্যাদি।