হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

টিস্যু কালচার: সংজ্ঞা,পদ্ধতি,গুরুত্ব,ধাপ,ব্যবহার, সুবিধা

জীবপ্রযুক্তির পদ্ধতিগুলোর মধ্যে টিস্যু কালচার একটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। একটি টিস্যুকে জীবাণু মুক্ত পুষ্টিবর্ধক কোনো মিডিয়ামে বর্ধিতকরণ প্রক্রিয়াই হলো টিস্যুকালচার। টিস্যুকালচার উদ্ভিদ বিজ্ঞানের একটি অপেক্ষাকৃত নতুন শাখা।

টিস্যু কালচার কি ?

টিস্য কালচার এক ধরনের জীবপ্রযুক্তি। এই প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের সজীব টিস্যুর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ কেটে এনে পুষ্টিকর জীবাণুমুক্ত মিডিয়ামে সঠিক তাপমাত্রা রাখা হয়।

টিস্যু কালচার কাকে বলে ?

বিচ্ছিন্ন কোন টিস্যু সম্পূর্ণ জীবানুমুক্ত অবস্থায় পুষ্টি মাধ্যমে আবাদ করে পূর্ণাঙ্গ চারা উদ্ভিদ সৃষ্টি করাকে টিস্যুকালচার বলে ।

আরও দেখো: রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ:সংজ্ঞা,ধাপ,গুরুত্ব,প্রযুক্তি চিত্র সহ

টিস্যু কালচার পদ্ধতি :

১। এক্সপ্লান্ট নির্বাচন : রোগমুক্ত ও উন্নত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উদ্ভিদ থেকে Explant পৃথক করে নেওয়া হয় ।

২। কালচার মাধ্যম তৈরিকরণ : প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান নির্দিষ্ট মাত্রায় মিশ্রিত করে তৈরি খাদ্য তার মধ্যে কোনো কিছুকে বৃদ্ধিলাভ করতে দেওয়া হলে তাকে আবাদ মাধ্যম (culture medium) বলে । উদ্ভিদের পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের মুখ্য ও গৌণ উপাদান, ভিটামিন, সুক্রোজ, ফাইটোহরমোন প্রভৃতি নিয়ে কালচার মাধ্যম প্রস্তুত করা হয়।

মাধ্যমটি জমাট বাঁধার জন্য অবশ্যই জমাট বাঁধার উপাদান (Solidifying agent) যেমন— ১% অ্যাগর (Agar) বা জিলোটিন যোগ করতে হয় এবং pH সাধারণত ৫.৬–৬ এর মধ্যে রাখা হয় ।

৩। জীবাণুমুক্তকরণ : কালচার মাধ্যমে সহজেই জীবাণু জমতে পারে। তাই কালচার মাধ্যমকে কনিক্যাল ফ্লাস্ক বা টেস্টটিউবে ঢেলে মুখ তুলা দিয়ে বন্ধ করে Autoclave নামক নির্বীজকরণ যন্ত্রে উপস্থিত জীবাণুকে মেরে জীবাণুমুক্ত করা হয়।

মাধ্যমটিকে ১২১° সে. তাপমাত্রায় ১৫ 1b/sq.inch চাপে ২০ মিনিট রাখলে জীবাণুসমূহ মারা যায়। কিন্তু কোনো কোনো মিডিয়াম উচ্চ তাপে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে জীবাণুমুক্ত করতে মাইক্রোফিল্টার (Microfilter) ব্যবহার করা হয়।

আরও দেখো: জীবপ্রযুক্তি কি? কাকে বলে। এবং এর গুরুত্ব বা অবদান

৪। মিডিয়ামে এক্সপ্লান্ট স্থাপন : এক্সপ্লান্ট (Explant) -কে নির্জীব করে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত পরিবেশে (Laminar air flow চেম্বারে) ফ্লাস্ক বা টেস্টটিউবের মিডিয়ামে স্থাপন করা হয়।

৫। কেলাস সৃষ্টি ও সংখ্যা বৃদ্ধি : মিডিয়ামে এক্সপ্লান্ট স্থাপন করার পর একে আলো ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখা হয়, কিছুদিন পর এক্সপ্লান্ট-এর টিস্যু বার বার বিভাজিত হয়ে কোষপিণ্ডে পরিণত হয় যাকে কেলাস বলে। পরবর্তীতে কেলাস থেকে অসংখ্য মুকুল সৃষ্টি হয়।

৬। চারা উৎপাদন : কেলাস থেকে সৃষ্ট মুকুলে মূল থাকে না। তাই মুকুলগুলোকে মূল সৃষ্টিকারী পুষ্টি মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয় । প্রতিটি মুকুলে পর্যাপ্ত মূল সৃষ্টি হয়ে পূর্ণাঙ্গ চারায় পরিণত হয়।

৭। টবে চারা স্থানান্তর : মুকুলে পর্যাপ্ত মূল সৃষ্টি হলে মুকুলকে কালচার মিডিয়াম থেকে নিয়ে সাবধানতার সাথে টবে স্থানান্তর করা হয় ।

আরও দেখো: জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কী? কাকে বলে। এবং এর ব্যবহার

৮। প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা মাঠ পর্যায়ে স্থানান্তর : টবে চারা রোপণের পর টবটিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রাখা হয়, যাতে চারাটি ধীরে ধীরে বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। পরবর্তীতে চারাগুলো যখন সজীব ও সবল হয়ে ওঠে তখন চারাগুলোকে প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা মাঠে স্থানান্তর করা হয়।

টিস্যু কালচার প্রযুক্তির ধাপ সমূহ :

১. মাতৃউদ্ভিদ নির্বাচন : উন্নত গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ অংশকে এক্সপ্ল্যান্টের জন্য নির্বাচন করা হয়।

2. আবাদ মাধ্যম তৈরি : উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যকীয় খনিজ পুষ্টি, ‘ভিটামিন, ফাইটোহরমোন, সুক্রোজ এবং অ্যাগার সঠিক মাত্রায় মিশিয়ে আবাদ মাধ্যম তৈরি করা হয় ।

৩. জীবাণুমুক্ত আবাদ প্রতিষ্ঠা : আবাদ মাধ্যমকে অটোক্লেভ যন্ত্রে জীবাণুমুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে জমাট বাধা আবাদ মাধ্যমে এক্সপ্ল্যান্টগুলোকে স্থাপন করা হয় এবং নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখা হয় । ফলে ক্যালাস ও অনুচারা উৎপন্ন হয় ।

৪. মূল উৎপাদক মাধ্যমে স্থানান্তর : অনুচারা সমূহকে মূল উৎপাদনকারী আবাদ মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয়।

৫. প্রাকৃতিক প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা মাঠ পর্যায়ে স্থানান্তর : মূলযুক্ত চারাগুলোকে প্রথমে ল্যাবরেটরিতে মাটি ভরা পাত্রে এবং পরবর্তীতে প্রাকৃতিক পরিবেশে সাবধানতা ও নযরদারীর সাথে মাটিতে লাগানো হয় ।

টিস্যু কালচার প্রযুক্তির গুরুত্ব :

উদ্ভিদ প্রজননে : ভ্রূণ কালচারের মাধ্যমে উদ্ভিদ প্রজনন বিদ্যার অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়। বিশেষ করে আন্তঃপ্রজাতি সংকরের ক্ষেত্রে ভ্রূণ পূর্ণতা লাভ না করায় সংকর উদ্ভিদ পাওয়া সম্ভব হয় না। এসব ক্ষেত্রে সংকরায়নের পর ভ্রূণকালচার করা হয়।

ফলে ভ্রূণ আর নষ্ট হয় না এবং পরবর্তীতে এ ভ্রূণ বিকাশ লাভ করে পূর্ণাঙ্গ সংকর উদ্ভিদ উৎপাদন করে। এছাড়া টিস্যু কালচারের মাধ্যমে পরাগরেণু এবং পরাগধানী কালচারের মাধ্যমে হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উৎপাদন করা সম্ভব। Poaceae, Solanaceae ও Brassicaceae গোত্রের হ্যাপ্লয়েড হ্যাপ্লয়েড লাইন প্রতিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে।

উন্নত জাত উদ্ভাবনে : টিস্যুকালচার প্রযুক্তিতে ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ তৈরি করা সম্ভব। আগাছা নাশকরোধী, পতঙ্গরোধী, হিমক্ষতরোধী, লবণাক্ত, খরারোধী, উন্নতমানের ফসলী উদ্ভিদ প্রভৃতি টিস্যুকালচার প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভাবন করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। সোমাকোনাল ভ্যারিয়েশনের মাধ্যমে উন্নতজাত যেমন- AdhI নামক গম উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে।

নিরোগ চারা উৎপাদনে : টিস্যুকালচার প্রযুক্তি দ্বারা ভাইরাস, ট্রাকটেরিয়া ও ছত্রাকমুক্ত চারা উৎপাদন সম্ভব। উদ্ভিদের শীর্ষস্থ ভাজক কলা আবাদ করে বেশ কিছু উদ্ভিদের রোগমুক্ত চারা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।

উদ্ভিদ সংরক্ষণে : বর্তমানে অনেক বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য টিস্যুকালচার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ স্বল্প সময়ে উল্লিখিত উদ্ভিদ থেকে চারাগাছ উৎপাদন এ প্রযুক্তি ব্যবহারেই সম্ভব।

মেরিস্টেম কালচার : মেরিস্টেম কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারাগাছ রোগমুক্ত হয়ে থাকে, কারণ মেরিস্টেম টিস্যুতে কোনো রোগ-জীবাণু থাকে না ।

হ্যাপ্লয়েড লাইন : পরাগরেণু এবং পরাগধানী কালচার এর মাধ্যমে হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উৎপাদন করা সম্ভব।
পরিশেষে বলা যায় যে, টিস্যুকালচার প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম।

টিস্যু কালচার প্রযুক্তির ব্যবহার :

১. এ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে উদ্ভিদাংশ থেকে কম সময়ের মধ্যে একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অসংখ্য চারা সৃষ্টি করা যায়।

২. রোগমুক্ত, বিশেষ করে ভাইরাসমুক্ত চারা উৎপাদন করা যায়।

৩. এ পদ্ধতিতে সারা বছরই চারা উৎপাদন করা যায়।

8. কম সময়ে কম জায়গার মধ্যে অধিক চারা উৎপাদন করা যায়।

৫. বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে টিস্যুকালচার একটি নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার হয় ।

৬. ভ্রূণ থেকে কালচার পদ্ধতিতে সরাসরি উদ্ভিদ সৃষ্টি করা যায় ।

৭. নতুন প্রকৃতির/ প্রজাতির উদ্ভিদ উদ্ভাবনে টিস্যুকালচার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

৮. টিস্যুকালচারের মাধ্যমে জোজোবা নামক বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে।

৯. দেশি-বিদেশি অর্কিডের চারা ছাড়াও চন্দ্রমল্লিকা, গ্লাডিওলাস, লিলি, কার্নেশন প্রভৃতি ফুল উৎপাদনকারী উদ্ভিদের চারা উৎপাদন করা হয়েছে।

১০. বিভিন্ন কাঠ উৎপাদনকারী উদ্ভিদ, ডাল জাতীয় শস্য প্রভৃতি উৎপাদিত হচ্ছে টিস্যুকালচার প্রযুক্তির মাধ্যমে।

উদ্ভিদের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন ও রোগমুক্ত, সতেজ চারা উৎপাদনে টিস্যুকালচার প্রযুক্তির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

টিস্যু কালচার প্রযুক্তির সুবিধা সমূহ:

১. অল্প জায়গার প্রয়োজন : টিস্যুকালচারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র আকৃতির বেশি সংখ্যক চারা তৈরি করা হয় ফলে তেমন কোনো জায়গার প্রয়োজন পড়ে না ।

২. বছরের সব সময় উৎপাদন : টিস্যুকালচারের মাধ্যমে বছরের সব সময়ই নতুন চারা উৎপাদন করা সম্ভব ।

৩. ভাইরাসমুক্ত চারা তৈরি : উদ্ভিদের যে অংশ টিস্যুকালচারে ব্যবহার করা হয় তা ভাইরাসমুক্ত হলে সেখান থেকে যে চারাগুলো তৈরি হবে তা সম্পূর্ণ ভাইরাসমুক্ত হবে ।

৪. নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ : টিস্যুকালচার প্রক্রিয়াটি যেহেতু একটি গবেষণাগারে হয়ে থাকে সেহেতু উৎপন্ন চারা উদ্ভিদগুলোর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রভাব যেমন- আলো, তাপ, পুষ্টিমাধ্যম, বৃদ্ধি হরমোন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

৫. অল্প পরিশ্রম : টিস্যুকালচারের মাধ্যমে অধিক হারে চারা উৎপাদন ও বৃদ্ধির জন্য সেচ, আগাছা দমন, কীটনাশক ছিটানো ইত্যাদি শ্রমসাপেক্ষে কাজের প্রয়োজন হয় না।

৬. সমস্যা মুক্ত থাকা : সঠিক বীজ সংগ্রহ ও মজুদ করার সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা যায় ৷

৭. বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ উৎপাদন ও সংরক্ষণ : বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে টিস্যুকালচার নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃত।

Leave a Comment

error: Content is protected !!