ঈমানে মুফাসসালে যে সাতটি বিষয়ের ওপর ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে, কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান (اَلْإِيمَانُ بِالْكُتُبِ) তন্মধ্যে তৃতীয়। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা যেমন মুমিন হওয়ার জন্য জরুরি তেমনি আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনাও জরুরি ।
কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান (اَلْإِيمَانُ بِالْكُتُبِ) -এর প্রকারভেদ :
ঈমানের পঞ্চম রোকন হলো আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান। কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন দু’ভাবে হয়ে থাকে। যথা-
১। কিতাবসমূহের প্রতি মোটামুটি ধরনের ঈমান (الإِيمَانُ بِالْكُتُبِ مُجْمَلًا)
২। কিতাবসমূহের প্রতি বিস্তারিত ঈমান (الإِيمَانُ بِالْكُتُبِ مُفَصَّلًا)
আরও জানতে দেখুন : আসমানী কিতাব কি?কাকে বলে ও কয়টি। কুরআন বিকৃতি থেকে মুক্ত ব্যাখ্যা
নিম্নে এ দু’প্রকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
১। কিতাবসমূহের প্রতি মোটামুটি ধরনের ঈমান (الإِيمَانُ بِالْكُتُبِ مُجْمَلًا): একজন মানুষকে এমর্মে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী ও রাসূলগণের ওপর শরীয়ত দান করতে গিয়ে অনেক কিতাব ও সহীফা নাযিল করেছিলেন। এর কতিপয়ের বর্ণনা কুরআনে দিয়েছেন।
এছাড়া আরো অনেক কিতাব রয়েছে, যার বর্ণনা কুরআনে দেননি, এসবের নাম ও সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ অবগত নয়। কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ، وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ، وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِنْ رَبِّهِمْ، لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ، وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ
অর্থাৎ, তোমরা বল, আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করলাম এবং আমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে, তার প্রতিও ঈমান আনয়ন করলাম এবং নবীগণের প্রতি তাঁদের রবের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল, তার প্রতিও ঈমান আনয়ন করলাম। (সূরা বাকারা : আয়াত- ১৩৬)
কুরআনের প্রতি ঈমান আনয়নের অর্থ হচ্ছে, তা আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকৃতি দেয়া এবং তাতে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তা অনুসরণ করা। এটি কুরআনের ওপর বিশ্বাসের অতিরিক্ত বিষয় যা অন্যান্য কিতাবের বেলায় প্রযোজ্য নয় ।
আরও জানতে দেখুন : আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাসের অর্থ,উপকারিতা ও বিভিন্ন দিক
২। কিতাবসমূহের প্রতি বিস্তারিত ঈমান (الإِيمَانُ بِالْكُتُبِ مُفَصَّلًا) : আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিস্তারিত ঈমানের অর্থ হচ্ছে, কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে যেসব কিতার ও সহীফার বর্ণনা এসেছে, সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস করা । তন্মধ্যে রয়েছে-
ক. হযরত ইবরাহীম ও মুসা (আ)-এর সহীফা : তাঁদের দু’জনের সহীফার বর্ণনা সূরা গাশিয়ার সর্বশেষ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, হযরত মুসা (আ)-এর ওপর তাওরাত ছাড়াও কিছু সহীফা অবতীর্ণ হয়েছিল।
খ. তাওরাত : যা হযরত মুসা (আ)-এর ওপর পাথরের ফলকে লিখিত অবস্থায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَكَتَبْنَا لَهُۥ فِي ٱلْأَلْوَاحِ مِن كُلِّ شَىْءٍ مَّوْعِظَةً وَتَفْصِيلًا لِّكُلِّ شَىْءٍ
অর্থাৎ, আর আমি তাঁকে সবকিছুর বিশদ বর্ণনা ও উপদেশস্বরূপ ফলকের মধ্যে সবকিছু লিখে দিয়েছিলাম। (সূরা আরাফ : আয়াত – ১৬৫)
খ্রিস্টানদের পরিভাষায় ঈসা (আ)-এর পূর্বে বনি ইসরাঈলের সকল নবী, বিচারক ও বাদশাহদের সংবাদ সংবলিত সকল কিতাবকে তারা তাওরাত হিসেবে গণ্য করে থাকে। যেগুলোকে বর্তমানে তারা পুরাতন যুগের কিতাব বা Old Testament নামকরণ করে থাকে।
আর ইহুদিদের পরিভাষায় পাঁচখানা গ্রন্থের সমষ্টিকে তাওরাত বলা হয়, যেগুলোকে মুসা (আ) নিজ হাতে লিখেছিলেন বলে তারা মনে করে। সে গ্রন্থগুলোর নাম হচ্ছে- ১. সিফিরুত তকবীন, ২. সিফিরুল খুরূজ, ৩. সিফিরুল লাবিবিয়ান, ৪. সিফিরুল আদাদ, ৫. সিফিরুত তাসনিয়া।
গ. যাবুর : এ বিশ্বাস পোষণ করতে হবে যে, যাবুর নামের এ কিতাব আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদ (আ)-এর ওপর অবতীর্ণ করেছিলেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, আর আমি দাউদকে যাবুর দান করেছিলাম। (সূরা নিসা : আয়াত- ১৬৩)
ঘ. ইঞ্জিল : এ বিশ্বাস পোষণ করতে হবে যে, ইঞ্জিল নামের এ গ্রন্থটি আল্লাহ তায়ালা হযরত ঈসা (আ)-এর ওপর অবতীর্ণ করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, অতঃপর আমি তাঁদের পশ্চাতে আমার অন্যান্য রাসূলগণকে ক্রমান্বয়ে পাঠাতে থাকলাম, আর তাঁদের পর ঈসা ইবনে মারইয়ামকে প্রেরণ করলাম এবং তাঁকে ইঞ্জিল প্রদান করলাম ।
ঙ. কুরআন : এ বিশ্বাস পোষণ করতে হবে যে, মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে শেষনবী ও রাসূল মুহাম্মদ (স)-এর ওপর।, যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-
অর্থাৎ, মহিমান্বিত সত্তা তিনিই যিনি ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন তাঁর বিশিষ্ট বান্দার ওপর, যাতে তিনি সমগ্র জগদ্বাসীর জন্য ভয় প্রদর্শনকারী হতে পারেন । (সূরা আল ফুরকান : আয়াত- ১) ফুরকান দ্বারা এখানে কুরআনকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। হক ও বাতিলের মধ্যে তা পার্থক্য সৃষ্টি করে বলেই কুরআনকে ফুরকান নামকরণ করা হয়েছে।
মুহাম্মদ (স) যাতে মানুষের নিকট তা থেমে থেমে পাঠ করতে পারেন, এজন্য তা ধীরে ধীরে প্রয়োজন ও বিবিধ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুদীর্ঘ তেইশ বছরের মধ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছিল।