হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

পুঁইমাচা গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর

প্রশ্ন : ৷৷ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুঁইমাচা গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।

অথবা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুঁইমাচা গল্পের নামকরণ কি যুক্তিযুক্ত হয়েছে? তোমার মতের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন কর।

অথবা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুঁইমাচা গল্পের নামকরণ কি যুক্তিযুক্ত হয়েছে? আলোচনা কর।

উপস্থাপনা : ‘পুঁই মাচা’ গল্পটি বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব, সমাজ ও পারিবারিক জীবনের শাশ্বত চিরন্তন চিত্র অঙ্কনকারী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ ছোটগল্প। তাঁর এ ছোটগল্পটির নামকরণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

বলা হয়- Literature is the mirror of life. আর সাহিত্যের দর্পণ হলো নামকরণ। তাই সাহিত্যের নামকরণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো-

নামকরণের রীতি : সাহিত্যে নামকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক Cavendis বলেছেন- A beautiful name is better than a lot of wealth. অর্থাৎ একটি সুন্দর নাম অঢেল সম্পদের চেয়ে উত্তম।

মূলত নামকরণের মধ্য দিয়েই রচনার মূলভাব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তেমনি ‘পুঁই মাচা’ নামকরণের মধ্য দিয়ে ‘পুঁই মাচা’ গল্পের অন্তর্নিহিত করুণ ভাব ফুটে উঠেছে।

আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু /মূলভাব/মূল বক্তব্য/মূল সুর

নামকরণের ভিত্তি : সাহিত্যিকগণ নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো নিজেদের সাহিত্যকর্মের নামকরণ করেন না; বরং এর একটা সুনির্দিষ্ট ভিত্তি রয়েছে। সাধারণত নামকরণের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয় তা হলো-

  • গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য
  • রূপক বা প্রতীকী ব্যঞ্জনা
  • স্থান, কাল বা নায়ক-নায়িকার নাম
  • প্রধান চরিত্র
  • মূলভাব বা রচনার বিষয়বস্তু

পুঁই মাচা গল্পের নামকরণ : বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁই মার্চা’ গল্পটিতে ক্ষুদ্র একটি পুঁই মাচা বিশাল স্থান দখল করে আছে। এ পুঁই মাচার সাথে জড়িয়ে আছে দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত একটি পরিবারের জীবন-যন্ত্রণা এবং ভোজনপটু পুঁইশাকপ্রিয় একটি মেয়ের স্মৃতি।

সে আজ বেঁচে নেই, কিন্তু তার অস্তিত্বের স্বাক্ষরস্বরূপ রয়ে গেছে পুঁই মাচাটি। পুঁই ডাঁটার লাবণ্যময় নধর দেহের সাথে সেই মেয়েটির অবুঝ-অবোধ মনের স্নিগ্ধতা একাকার হয়ে গেছে। এ কারণে লেখক গল্পটির নাম দিয়েছেন ‘পুই মাচা’।

আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের ক্ষেন্তির চরিত্র বিশ্লেষণ কর

পুঁইশাক পরিচিতি : পুঁই বাংলার সর্বজনপরিচিত সবুজ-শ্যামল সুস্বাদু একটি শাক। গ্রামবাংলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বাঁশের কঞ্চি দ্বারা তৈরি মাচায় পুঁইশাক চাষ করা হয়। এ শাক খেতে সুস্বাদু এবং এতে অধিক খাদ্যপ্রাণ আছে। এ গল্পের প্রধান চরিত্র ক্ষেন্তি পুঁইশাক খেতে খুবই পছন্দ করতো ।

অন্যের ফেলে দেওয়া পুঁইশাক কুড়িয়ে আনায় সে মায়ের বকুনি খেয়েছে বটে; কিন্তু তবুও তার পুঁইপ্রীতি কমেনি। বাড়ির উঠানের এক পাশে কিছু জায়গা পরিষ্কার করে ক্ষেন্তি একটি পুঁই মাচা তৈরি করেছিল। ক্ষেন্তি তার পুঁইক্ষেতে পুঁতেছিল শীর্ণকায় একটি পুঁই চারা। এ পুঁই মাচাটির স্মৃতিই পরবর্তীতে গল্পের একটি বিশেষ স্থান দখল করেছে।

মাচার গুরুত্ব : পুঁই মাচা গ্রামবাংলার একটি অতি সামান্য বিষয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে পুঁই মাচা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। পুঁই মাচা এ গল্পে হয়ে উঠেছে এক অসামান্য বস্তু। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্ষেন্তির সাথে পুঁই মাচার গভীর যোগসূত্র রয়েছে।

আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের সমাজ বাস্তবতার পরিচয় দাও

ক্ষেন্তি ও পুঁই মাচা : সহায়হরি চাটুয্যের বড় মেয়ের নাম ক্ষেন্তি। সে ছিল ভোজনপটু। পুঁইশাক তার খুবই প্রিয়। একবার অরন্ধনের পূর্বদিন পুঁইশাক রান্না হলে ক্ষেন্তি তার মা অন্নপূর্ণাকে বলেছিল, সে একাই অর্ধেক খাবে। পুঁইশাকপ্রিয় এ মেয়েটি একদিন ওপাড়ার রায়দের ফেলে দেওয়া অর্ধ পাকা পুঁই ডাঁটার বোঝা বাড়িতে আনার কারণে মায়ের বকুনি খেয়েছিল।

তার মা রাগ করে ছোট মেয়েকে পুঁই ডাঁটাগুলো ফেলে দিতে বলেছিলেন। পরে অন্নপূর্ণা মেয়ে ক্ষেন্তির কথা ভেবে গোপনে তার কিছু অংশ রান্না করে তাকে খেতে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ক্ষেন্তি তাদের বাড়ির উঠানের এক কোণে মাচা তৈরি করে শীর্ণকায় একটি পুঁইচারা রোপণ করে। কিন্তু পুঁই মাচাটি যখন লাবণ্যময় নম্বর ডগায় ভরে উঠল, তখন ক্ষেন্তি আর বেঁচে নেই ।

পুই মাচার প্রভাব : সহায়হরির বড় মেয়ে ক্ষেন্তি অত্যন্ত যত্ন করে তার বাগানে খুবই শীর্ণকায় একটি পুঁই চারা লাগিয়েছিল। পুঁইভক্ত ক্ষেন্তি খুব চেষ্টা-সাধনা দ্বারা তার আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রিয় পুঁই চারাটি বাঁচিয়ে তুলেছিল। একসময় গাছটি অনেক বড় হয়, কচি নধর পুঁই শাকে ভরে ওঠে সমগ্র মাচা, কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! যার একান্ত শ্রম ও সাধনায় এ পুঁই গাছটি; সেই ক্ষেপ্তি আজ নেই।

বছর ঘুরে আবার পৌষ-পার্বণ ফিরে এসেছে, কিন্তু ফিরে আসেনি ক্ষেন্তি। সে আজ আর পিঠা খেতে চাচ্ছে না। ফিরে দেখছে না তার নিজের হাতে লাগানো পুঁই মাচাটি। তাই এ পুঁই মাচাটি অন্নপূর্ণা ও বোনদের হৃদয়ে প্রবল প্রভাব ফেলেছিল।

আরও জানো : হুজুর কেবলা গল্পের মূলভাব / মূল বিষয়/মূল বক্তব্য

গল্পের মূল কাহিনি : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁই মাচা’ গল্পের প্রধান চরিত্র ক্ষেন্তি নামের ভোজনবিলাসী একটি মেয়ে। সে মায়ের প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে ভীত-সন্ত্রস্ত, শান্ত অথচ বাবার প্রশ্রয়ে সদা চঞ্চলা বালিকা। ঘরে তার মন বসে না। বনে-বাদাড়ে, ফল- ফলাদির গাছতলায় তার ঘোরাফেরা।

পিতা সহায়হরি নিজেও কন্যার মতোই উদাসীন। পুঁই শাকের প্রতি ক্ষেন্তির আলাদা একটা লোভ রয়েছে। সে প্রতিবেশী রায়দের ফেলে দেওয়া পুঁইশাক কুড়িয়ে এনেছে। এজন্য সে মায়ের বকুনিও খেয়েছে। অবশ্য মেয়ের প্রতি গভীর দরদবোধ থেকে পরবর্তীতে মা সেগুলোর কিছু অংশ রান্না করে তাকে খেতে দিয়েছে।

সে উঠানে একটি পুঁইগাছ রোপণ করেছিল, কিন্তু’ গাছটি বড় হওয়ার আগেই তার বিয়ে হয়ে যায়। শ্বশুরালয়ের পরিবেশ তার জন্য অনুকূল ছিল না। একপর্যায়ে বসন্ত রোগে সে মারা যায়। ক্ষেন্তির পরিবারের সবাই তার অকাল মৃত্যুতে বেদনাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তবুও তার সব স্মৃতি ধারণ করে রাখে তার লাগানো পুঁই গাছটি ।

নামকরণের সার্থকতা : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত ‘পুঁই মাচা; গল্পটির বিচার বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাই, গল্পের পুরো অবয়বে রয়েছে এদেশের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক দুর্গতি, স্নেহের প্রাবল্য, অন্ধ ধার্মিকতা ও স্বার্থকেন্দ্রিক সমাজের নিষ্ঠুর হৃদয়হীন অনুশাসন । এ সবই গল্পকে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা।

পুঁই ডাটার আড়ালে আমরা চিরন্তন হয়ে থাকতে দেখি এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্ষেন্তিকে। রস সিঞ্চনে যেমন পুঁই ডাটা বেড়ে ওঠে, ঠিক তেমনি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ক্ষেন্তির প্রতি সদয় থাকলে ক্ষেন্তিও বেড়ে উঠত সতেজ জীবনে; অকালে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হতো না তাকে।

এ গল্পের শেষ স্তবকের মাধ্যমে নামকরণের সার্থকতা পূর্ণভাবে ফুটে ওঠে। “যেখানে বাড়ির সেই লোভী মেয়েটির স্মৃতি পাতায় পাতায়, শিরায় শিরায় জড়াইয়া তাহার কত সাধের নিজের হাতে পোঁতা পুঁই গাছটি মাচা জুড়িয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে।” সুতরাং বলা যায়, গল্পের অন্তর্নিহিত ভাবের সাথে ‘পুঁই মাচা’ নামকরণ যথার্থ ও সার্থক হয়েছে।

উপসংহার : সুন্দর নামকরণের মধ্য দিয়ে কোনো বিষয়ের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই নামকরণ হচ্ছে একটি শিল্প। জীবনের প্রতিকৃতি জীবনের মাধ্যমেই দেখিয়েছেন লেখক। সহায়হরি ও অন্নপূর্ণা দম্পতির আদরের মেয়ে ক্ষেন্তির সেবা-যত্নে বেড়ে ওঠা পুঁই গাছটি হারিয়ে যাওয়া একটি জীবনস্মৃতি হিসেবে সবার হৃদয়পটে জাগরূক থেকেছে। সুতরাং এ গল্পের নামকরণ ‘পুঁই মাচা’ যথার্থ ও সার্থক হয়েছে।

শিক্ষাগার

প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

মাহমুদুল হাসান

শিক্ষাগত যোগ্যতা
গণিতে অনার্স ও মাস্টার্স

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফাজিল সম্পন্ন

গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা

বিশেষ দক্ষতা

বাংলা সাহিত্য • গণিত • ইসলামিক শিক্ষা

অভিজ্ঞতা

শিক্ষকতা ও ৫+ বছর কন্টেন্ট রাইটিং

আমাদের লক্ষ্য

শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা। ২০২৩ সাল থেকে লাখো শিক্ষার্থী শিক্ষাগার থেকে উপকৃত হচ্ছে।

Leave a Comment