পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু / মূল বক্তব্য নিজের ভাষায় বর্ণনা কর।
অথবা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত পুঁইমাচা গল্পের মূলভাব / মূল সুর তোমার নিজের ভাষায় লেখ।
উপস্থাপনা : প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন-বিশ্লেষণ, প্রকৃতি বর্ণনা ও করুণ রসাত্মক রচনা পাঠক হৃদয়কে সহজেই আকৃষ্ট করে। ‘পুঁই মাচা’ গল্পটিও একটি করুণ রসাত্মক ছোটগল্প। এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘পুঁই মাচা’ গল্পের কাহিনি। এখানে বাঙালি পরিবারের অভাব-অনটনক্লিষ্ট জীবনের বাস্তবচিত্র ফুটে উঠেছে।
পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু / মূলভাব/ মূল বক্তব্য/ মূল সুর
সহায়হরির সংসার : সহায়হরি চাটুয্যে নিম্নবিত্ত এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। স্ত্রী অন্নপূর্ণা এবং চার মেয়ে ক্ষেন্তি, পুঁটি, রাধী ও লক্ষ্মীকে নিয়ে তার সংসার। সহায়হরি উদাসীন অসচেতন প্রকৃতির মানুষ। তার জীবিকা অর্জনের সুনির্দিষ্ট কোনো অবলম্বন ছিল না। তাদের বড় মেয়ে ক্ষেন্তির আশীর্বাদের পর বিয়ে ভেঙে যায়।
সেও বাবার মতো উদাসীন, অসচেতন। আর ছোট মেয়েগুলোর সংসার সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই নেই। তবে গৃহকর্ত্রী অন্নপূর্ণা খুবই সংসার সচেতন। সংসারের দায়দায়িত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনিই গুরুত্বের সাথে পালন করেন ।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের ক্ষেন্তির চরিত্র বিশ্লেষণ কর
সহায়হরির উদাসীনতা : সহায়হরি চাটুয্যে একজন অসচেতন উদাসীন মানুষ। সংসারের কোনো দায়দায়িত্ব পালন করেন না তিনি। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে গল্প-গুজব করেন আর মাছ শিকার করে সময় কাটান। সংসারের কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে কিংবা কীভাবে সংসার চলছে, এ ব্যাপারে তার কোনো চিন্তা নেই।
বড় মেয়ে ক্ষেন্তির বয়স পনেরো ছাড়িয়ে যাচ্ছে। একবার আশীর্বাদ হওয়ার পর বিয়ে ভেঙে যায় তার। এ নিয়ে আশেপাশে নানা গুজব রটলেও সেদিকে সহায়হরির কোনো খেয়াল নেই। সমাজপতিরা তাকে চণ্ডীমণ্ডপে ডেকে নিয়ে একঘরে করার হুমকি দিলেও তার উদাসীনতার ঘোর কাটে না ।
সহায়হরির সন্তানপ্রেম: ‘পুঁই মাচা’ গল্পে হতভাগ্য সহায়হরি একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ। সমাজ-সংসার সম্পর্কে উদাসীন হলেও সহায়হরি সন্তানদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত দরদি তিনি তার কন্যাদের ভালো খাওয়ানোর জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে কিংবা চুরি করতেও দ্বিধা করেননি।
বড় মেয়ে ক্ষেন্তির প্রতি তার ছিল গভীর ভালোবাসা। অভাবের কারণে আদরের মেয়ে ক্ষেন্তিকে চল্লিশোর্ধ পাত্রের কাছে বিয়ে দিতে বাধ্য হওয়ায় তার হৃদয় ব্যথায় ভরে উঠেছিল।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের সমাজ বাস্তবতার পরিচয় দাও
অন্নপূর্ণার মাতৃহৃদয় : সহায়হরির স্ত্রী অন্নপূর্ণা এক আদর্শ মাতার প্রতিচ্ছবি। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চরম অভাব-অনটনের মাঝেও সংসার আগলে রেখেছেন । সন্তানদের শাসন ও ভালোবাসায় বড় করে তুলেছেন।
রায়দের ফেলে দেওয়া পুঁইশাক তুলে আনার জন্য প্রথমে ক্ষেন্তিকে বকা দিয়েও পরে তা-ই কুড়িয়ে এনে রান্না করে নিজ হাতে মেয়েকে খাইয়েছেন । তিনি পুঁইশাকের চচ্চড়ি, নারকেলের পিঠা ইত্যাদি তৈরি করে মেয়েদের খাওয়াতেন।
সন্তান বাৎসল্য : বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁই মাচা’ গল্পের অন্যতম উপকরণ হলো সন্তান বাৎসল্য। সহায়হরি অন্নপূর্ণা দম্পতির সহজ-সুন্দর ও গভীর সন্তান-বাৎসল্য গল্পটিকে মহিমান্বিত করেছে।
তাদের দারিদ্র্যের সংসারে অনেক কিছুরই অভাব ছিল। কিন্তু স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসার অভাব ছিল না। চারটি মেয়ে মা- বাবার স্নেহ-ভালোবাসা পেয়ে অনেক না পাওয়াকে ভুলেছিল। এ ব্রাহ্মণ দম্পতির সন্তান- বাৎসল্য পাঠককে মুগ্ধ করে।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর
সামাজিক সম্পর্ক : ‘পুঁই মাচা’ গল্পে কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, সহায়হরি যে সমাজে বাস করতো সে সমাজের মানুষের মাঝে ছিল পারস্পরিক ভালোবাসা। সামাজিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। পরস্পর পরস্পরের প্রতি ছিল অত্যন্ত উদার।
এজন্য সহায়হরি অনায়াসে তারক খুড়োর কাছ থেকে খেজুর রস চেয়ে আনতে চান। সহায়হরির স্ত্রী অন্নপূর্ণা দুর্গাদের বাড়ি গিয়ে নবান্ন মেখে দিয়ে আসেন। খেদিদের বাড়ি গিয়ে ক্ষেন্তি পাটিসাপটা পিঠা খেয়ে আসে। রায় কাকার বাড়ি থেকে পুঁইশাক চেয়ে আনে ক্ষেন্তি ।
সামাজিক জটিলতা : কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পুঁই মাচা’ গল্পে সমাজ- বাস্তবতার এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। তৎকালীন হিন্দু সমাজে ব্যাপক কুসংস্কার বিদ্যমান ছিল। সহায়হরি চাটুয্যে একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ। বিবাহযোগ্য কন্যাকে যথাসময়ে বিয়ে দিতে না পারায় সমাজপতিরা তাকে একঘরে করার ভয় দেখান। সমাজপতি কালীময় ঠাকুর সহায়হরিকে ডেকে শাসিয়ে দেয়।
এসব সামাজিক অনুশাসনের ফলে সহায়হরি ক্ষেন্তিকে চল্লিশোত্তর এক চামারের সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু পণের আড়াইশ টাকা বাকি থাকায় ক্ষেন্তিকে তারা বাপের বাড়ি যেতে দেয়নি। অবশেষে ক্ষেস্তি সমাজের বলি হয়ে বছর পূর্ণ না হতেই মৃত্যুর সুধা পান করে ।
কিশোর মনস্তত্ত্ব : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁই মাচা’ গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য প্রধান উপকরণ হচ্ছে কিশোর মনস্তত্ত্বের পরিচর্যা। এ গল্পে ক্ষেন্তি, পুঁটি, রাধী ও লক্ষ্মী নামের চার শিশু-কিশোরী আছে। তারা একই পরিবারের সহোদরা বোন। ক্ষেন্তি সবার বড়। সে একটু অধিকমাত্রায় ভোজনপটু মেয়ে; বিশেষভাবে সে পুঁইশাক ও পিঠা খেতে পছন্দ করে।
মা এ কথা জানে বলে ক্ষেন্তিকে খাবার সময় পুঁইশাক ও পিঠা বেশি দেয়। ক্ষেন্তি সহজ-সরল কিশোরী বালিকা। মা-বাবাকে সে ভয় ও শ্রদ্ধা করে। তার মাঝে কৈশোরের চপলতা জাজ্বল্যমান। পুঁইশাক খেতে ভালোবাসে বলে সে স্ব-উদ্যোগে বোনদের নিয়ে পুঁই মাচা তৈরি করে। শিশু-কিশোরদের এসব মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো গল্পকার নিপুণভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন।
ক্ষেন্তির স্বপ্ন : ক্ষেন্তি জন্মগ্রহণ করে সহায়হরির দরিদ্র সংসারে। পুঁইশাক ভালোবাসে বলে সে নিজেই বাড়ির খোলা জমিতে একটি শাক-সবজির বাগানের পরিকল্পনা করে। সেখানে পুঁইগাছ লাগানোর জন্য ক্ষেন্তি প্রথমেই একটি দুর্বল পুঁই চারা সংগ্রহ করে।
অন্যান্য শাক- সবজির চিন্তা এখনো তার মনের মাঝেই লালিত রয়েছে। তার বিশ্বাস, এ পুঁই গাছ একদিন বড় হবে এবং পর্যাপ্ত শাক হবে, কিন্তু পুঁই গাছ বড় হলেও ক্ষেন্তি তার শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে আসতে পারেনি। তার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায় ।
নিষ্ঠুর যৌতুকপ্রথা : ‘পুঁই মাচা’ গল্পে লেখক দীর্ঘদিনের সামন্ততন্ত্রের ফসল অভিশপ্ত যৌতুকপ্রথার বীভৎস চিত্র তুলে ধরেছেন। শ্বশুরের অর্থলিপ্সাই ক্ষেন্তিকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করেছে। পণের টাকা দিতে না পারায় ক্ষেন্তি চিরমমত্বের পিতৃগৃহে আর ফিরে আসতে পারেনি।
বাবার দারিদ্র্যের কারণে ক্ষেন্তিকে শ্বশুর বাড়িতে নানা দুর্নাম সহ্য করতে হয়েছে। ক্ষেন্তির বসন্ত হলে তার গহনাগুলো খুলে রেখে দূর সম্পর্কীয় পিসির হাতে তুলে দিয়েছে। দরিদ্র পিতার কন্যা ক্ষেন্তিকে অবশেষে অযত্ন অবহেলায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।
বেদনাদায়ক স্মৃতি : ক্ষেন্তির বিয়ের পর এক বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। দরিদ্র পিতা সহায়হরি বিয়ের আনতে গিয়ে পণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাকে আনতে পারেনি। প্রতিবেশী বিষ্ণু সরকারের কাছে এ দুঃখবোধ প্রকাশ করতে গিয়েই সহায়হরি তার পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ তোলেন।
এরপর যখন পৌষ-পার্বণ আসে তখন পিঠা বানাতে গিয়েই অন্নপূর্ণার কথা মনে পড়ে। তার সবই আছে, শুধু পিঠাপাগল মেয়েটি নেই। খেতে বসে হঠাৎ করেই পুঁটি বলে ওঠে, “দিদি পিঠা বড় ভালোবাসতো।” সাথে সাথেই কেঁপে ওঠে অন্নপূর্ণা। তার দৃষ্টি চলে যায় উঠানের কোণের দিকে, যেখানে ক্ষেন্তির লাগানো পুঁই গাছের শীর্ণ চারাটি মাচা জুড়ে বেড়ে উঠেছে।
উপসংহার : ‘পুই মাচা’ একটি সংবেদনশীল হৃদয়বিদারক সামাজিক ছোটগল্প। লেখক অভ্যন্ত স্বচ্ছ অনুভূতি ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে সহায়হরির পরিবারের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার চিত্র মনোরমভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পটিতে এদেশের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক দুর্গতি, স্নেহের প্রাবল্য, অন্ধ ধার্মিকতা, স্বার্থকেন্দ্রিক সমাজের হৃদয়হীন অনুশাসন প্রভৃতি ফুটে উঠেছে।