প্রশ্ন : ৷৷ ‘পথ জানা নাই” গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।
অথবা, শামসুদ্দীন আবুল কালাম বিরচিত পথ জানা নাই গল্পের নামকরণের সার্থকতা যাচাই কর।
উপস্থাপনা : শামসুদ্দীন আবুল কালাম বিরচিত ‘পথ জানা নাই’ একটি বিখ্যাত ছোটগল্প। লেখক এ গল্পের একটি সুন্দর নামকরণ করেছেন, যা গল্পটির কাহিনিকে বিশিষ্টতা দান করেছে। নামের মাধ্যমে যথার্থভাবে গল্পের মূল বক্তব্যের একটি দিক ফুটে উঠেছে। নিচে প্রশ্নালোকে আলোচ্য গল্পের নামকরণের সার্থকতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
নামকরণের গুরুত্ব : সাহিত্যশিল্পের দর্পণ হলো নামকরণ। নামকরণের মাধ্যমে শিল্পীর রুচিবোধ ফুটে ওঠে। তাই নামকরণ যথার্থ সুন্দর ও সার্থক হওয়া আবশ্যক। নামকরণ সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক Cavendis বলেন- A beautiful name is better than a lot of wealth.
আরও জানো : পথ জানা নাই গল্পের মূলভাব/ বিষয়বস্তু/সার-সংক্ষেপ
নামকরণের ভিত্তি : সাহিত্যিকগণ একটি সুন্দর ও সার্থক নামকরণের জন্য সাধারণত নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করেন-
- কেন্দ্রীয় চরিত্র;
- বিষয়বস্তু, স্থান;
- রচনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য;
- রূপক বা প্রতীকী নামকরণ;
- কাহিনির পরিণতি বা আবেগ।
আলোচ্য গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে লেখক রচনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের সূত্রটি অনুসরণ করে এর নাম ও রচনার মাঝে এক নিপুণ শৈল্পিক সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন।
পথ জানা নাই গল্পের নামকরণের সার্থকতা
১. নগরকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় মাউলতলা : মাউলতলা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি শান্ত নিভৃত পল্লি। নগরকেন্দ্রিক আধুনিক সভ্যতার আলো এখানে কোনোদিনই পৌঁছায়নি। এখানকার মানুষ যুগ যুগ ধরে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে অনাবিল আনন্দে বসবাস করেছে।
আরও জানো : পথ জানা নাই গল্পের আলোকে গহুরালির চরিত্র/কেন্দ্রীয় চরিত্র
কিন্তু বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় বণিক সভ্যতা বিশ্বের অনেক অঞ্চলকে যেমন গ্রাস করেছে, তেমনি শহর থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন এই মাউলতলা গ্রামেও তার থাবা বিস্তার করেছে। এ গ্রামের শহর-ফেরত যুবক ‘জোনাবালি’ মাউলতলাবাসীকে আধুনিকতার দিকে, শহরের দিকে তথা সভ্যতার দিকে নিতে চাইল ।
এজন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন ছিল শহরের সাথে সংযোগের জন্য একটি সড়ক । প্রথমত কেউ এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি, এমনকি গহুরালিও রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব মেনে নিতে আগ্রহী ছিল না। পরে জোনাবালির যুক্তিতে সে বুঝতে পারল, এ কেবল একটি সড়কই নয়; বরং নতুন জীবনের রাস্তা ।
তাই সে রাস্তার জন্য নিজের অল্প জমির প্রায় অর্ধেক অংশই দিতে রাজি হলো। সকলের প্রচেষ্টায় নির্মিত হলো সড়ক। সেইসাথে মধ্যযুগীয় অবস্থান থেকে মাউলতলা গ্রামটি উঠে আসল আধুনিক নগরকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় ।
আরও জানো : একটি তুলসী গাছের কাহিনী গল্পের নামকরণের সার্থকতা
২. শহরের উপকরণ বারবণিতা : নতুন রাস্তা দিয়ে গহুরালি শহরে যায়। কিন্তু সেখানকার মানুষের কোনো আন্তরিকতা নেই, মেহমানদারি নেই, সৌজন্যবোধ নেই, যা দেখে সে মর্মাহত হলো।
এরই মাঝে এক বারবণিতার মায়াময় আহ্বানে সে কিছুটা শান্তি পেতে চেয়েছিল, কিন্তু সে যখন তার সত্যিকার রূপ দেখল, তার টাকাকড়ি সব রেখে তাড়িয়ে দিল, তখন বুঝতে পারল, শহরের অন্যতম উপকরণ এ বারবণিতা। অর্থের বিনিময়ে এখানে ঘৃণিত সেবা পাওয়া যায় ৷
৩. সড়ক তৈরির কুফল : সড়ক নির্মিত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত মাউলতলা গ্রামবাসী কোনো কিছুর অভাব উপলব্ধি করেনি। এবারে যুদ্ধ ও মন্বন্তরের কারণে গ্রামের সবাই দিশেহারা। এ পথ ধরে ইতঃপূর্বে সরকারি কর্মচারীদের ঘুষের হাত প্রসারিত হয়েছে, অন্যদিকে মামলা-মকদ্দমা, মারামারি-হানাহানি চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে।
মানুষের শান্তির ঘরে আগুন লেগেছে। গহুরালির সংসারেও এসেছে অর্ধাহার, অনাহার। আগের মতো এখন তার আয় নেই। যেমন লেখকের ভাষায়, “দাম চড়িল সব জিনিসের কমিল কেবল জীবনের।” ধীরে ধীরে এ সিঁড়ি বেয়ে মন্বন্তর প্রবেশ করে মাউলতলা গ্রামেও ।
গ্রামের মানুষের মন থেকে প্রেম-ভালোবাসা তিরোহিত হয়, নৈতিক চরিত্রে আসে চরম অধঃপতন। গহুরালির স্ত্রী হাজেরা মিলিটারির দালালের হাত ধরে পালিয়ে যায়। আসগরউল্লাহর সোমত্ত কন্যা কুলসুম উধাও হয়ে যায় শহরের বাবুর্চিখানার কর্মচারী লুৎফরের সাথে, আগে যা কোনোদিন কল্পনাও করা যায়নি ।
৪. স্ত্রী হারিয়ে নিঃস্ব গহুরালি : গহুরালি ঘটনাচক্রে বন্ধুত্ব করে শহরের মিলিটারীর কোনো এক দালালের সাথে। উদ্দেশ্য আয়ের একটা পথ করা, কিন্তু একদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে গহুরালি তার সহজ-সরলা, পতিভক্তিপরায়ণ স্ত্রী হাজেরাকে আর খুঁজে পেল না।
পরে জানতে পারল, হাজেরা সেই দালালের সাথে পালিয়েছে। এ ঘটনার অনুভূতি ব্যক্ত করতে লেখক বলেন, “মন্বন্তরে গহুরালি নিঃস্ব হইয়াছিল বাহিরে, এবারে হইল অন্তরে।” সে অনুভব করল, এ রাস্তা তৈরি না হলে তার এত বড় ক্ষতি হতো না।
৫. ‘পথ জানা নাই’ কথার তাৎপর্য : এ গল্পের জোনাবালি মাউলতলাবাসীকে একটি সুখ- সমৃদ্ধির সন্ধান দিতে চেয়েছিল। শহরের সাথে তাই তারা সংযোগ সড়ক স্থাপন করেছিল, কিন্তু যে পথে তাদের শান্তি আসবে, সুখ আসবে, আসবে সমৃদ্ধি, সে পথ তাদের জানা নেই ।
উপসংহার : মানুষ সবসময় উন্নতির পথ খোঁজে, জ্ঞানের পথে ধাবিত হয় এবং সভ্যতার অনুসরণ করে। মাউলতলা গ্রামের লোকেরাও খুঁজেছিল সমৃদ্ধির পথ, শান্তির পথ। কিন্তু যে পথে সত্যিকারের শান্তি আসবে, সমৃদ্ধি আসবে সে পথ কারো জানা নেই। এ পথের দিশা একমাত্র স্রষ্টার হাতে। তাই লেখকও তার গল্পের নাম দিয়েছেন ‘পথ জানা নাই।