হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

পাদটীকা গল্পের নামকরণের সার্থকতা

প্রশ্ন : ॥ সৈয়দ মুজতবা আলীর পাদটীকা গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার
কর।

উপস্থাপনা : বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত রম্যলেখক, সুসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ নামক অনন্য সাধারণ গল্পটি তার ‘চাচাকাহিনী’ গ্রন্থ থেকে উৎকলিত। এ গল্পে তৎকালীন সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকজীবনের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। নিচে ‘পাদটীকা’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করা হলো :

সাহিত্যে নামকরণের রীতিনীতি : বলা হয়- Literature is the mirror of life. আর সাহিত্যের দর্পণ হলো নামকরণ। কেননা নামকরণের মধ্য দিয়েই সাহিত্যকর্মের মূলভাব ফুটে ওঠে। তাই প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক Cavendis বলেন- A beautiful name is better than a lot of wealth.

আরও জানো : পাদটীকা গল্পের মূলভাব/বিষয়বস্তু/ মূল বক্তব্য/ সার-সংক্ষেপ

নামকরণের ভিত্তি : প্রবন্ধ, কবিতা বা গল্পের নামকরণের মধ্য দিয়ে সাহিত্যিকের অভীষ্ট লক্ষ্য, ভাব ও বক্তব্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তাই সাহিত্যে নামকরণের ক্ষেত্রে লেখককে বিচক্ষণতার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হয়। যেমন-

  • রচনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য;
  • রূপক বা প্রতীকী ব্যঞ্জনা;
  • ‘পাদটীকা’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা
  • কেন্দ্রীয় চরিত্র;
  • স্থান ও কাল;
  • নায়ক-নায়িকা, কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম ইত্যাদি ।

‘পাদটীকা’ নামকরণ : ‘পাদটীকা’ গল্পের নামকরণে গল্পকার সৈয়দ মুজতবা আলী প্রথম পদ্ধতিটিই অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুসারে গল্পটির নামকরণ করেছেন ‘পাদটীকা’।

‘পাদটীকা’র পরিচিতি : পাদটীকার ইংরেজি প্রতিশব্দ Foot note. জটিল প্রবন্ধের শেষে পৃষ্ঠার নিচে বিশ্লেষণমূলক লিখিত টীকাকে ‘পাদটীকা’ বলা হয়। আলোচ্য ‘পাদটীকা’ গল্পে গল্পকার ‘পাদ’ অর্থ পা এবং টীকা’ অর্থ বিশেষ বিশ্লেষণ; এই অর্থ গ্রহণ করেছেন। সুতরাং ‘পাদটীকা’ অর্থ দাঁড়ায় পায়ের বিশেষ বিশ্লেষণ।

আরও জানো : পথ জানা নাই গল্পের নামকরণের সার্থকতা

‘পাদটীকা’ গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য : ব্রিটিশ শাসনামলে সংস্কৃত শিক্ষার পীঠস্থান টোলসমূহ বন্ধ হয়ে গেলে সংস্কৃত পণ্ডিতগণ দারিদ্র্য ও হতাশার মধ্যে দিনাতিপাত করেন। গল্পে এ হতাশার চিত্র সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

লেখক যে স্কুলে পড়তেন সে স্কুলের পণ্ডিত মশাই ছিলেন সংস্কৃত ভাষার একনিষ্ঠ সাধক। তিনি বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন এবং স্কুলে বাংলা ব্যাকরণের শুধু সংস্কৃত অংশটুকুই পড়াতেন। পড়ানোর চেয়ে বকতেন বেশি এবং তার চেয়েও বেশি ঘুমাতেন দুই পা টেবিলে তুলে ।

পণ্ডিত মশাই লেখককে খুব স্নেহ করতেন। তাই সর্বদা কটুবাক্য বর্ষণ করতেন তার প্রতি। অনার্য, শাখামৃগ, দ্রাবিড়সম্ভূত ইত্যাদি ছাড়া তিনি সম্বোধন করতেন না লেখককে। পণ্ডিত মশাইয়ের গাত্রবর্ণ ছিল শ্যাম। মাসে একদিন দাড়ি-গোঁফ কামাতেন এবং হাঁটুজোকা ধুতি পরতেন।

গায়ে যে চাদর তিনি ব্যবহার করতেন তা দড়ি বলে ভ্রম হতো। ক্লাসে এসে একটা অজুহাত নিয়ে বকতে শুরু করতেন। আর যেদিন কোনো অজুহাত খুঁজে পেতেন না সেদিন কৃৎ-তদ্ধিত আলোচনা করে মূর্খদের বিদ্বান করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থতার কথা বলতেন।

পণ্ডিত মশাই সারাজীবন খালি গায়ে স্কুলে আসতেন। সেবার লাট সাহেব স্কুল পরিদর্শনে এলে তিনি একটি ফুলহাতা গেঞ্জি পরেন এবং অনভ্যাসের কারণে নানা বিপত্তির শিকার হন। লাট সাহেব ক্লাসে এসে পণ্ডিত মশাইয়ের সাথে করমর্দন করায় তিনি বিগলিত হয়ে লাট সাহেবকে বারবার সালাম জানান ।

তিনদিন ছুটির পর পণ্ডিত মশাই ক্লাসে এসে বললেন, লাট সাহেবের সাথে যে কুকুরটি এসেছিল সেটির তিনটি ঠ্যাং আছে। সেই কুকুরের জন্য মাসিক খরচ পঁচাত্তর টাকা। আর পণ্ডিত মশাইয়ের আট সদস্যবিশিষ্ট পরিবার চলে মাসিক পঁচিশ টাকা বেতনে। পণ্ডিত মশাই জানতে চাইলেন, তার পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের কয়টি ঠ্যাংয়ের সমান? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ক্ষমতা কারো ছিল না ।

সমগ্র ক্লাস নিস্তব্ধ। পণ্ডিত মশাইয়ের মুখ লজ্জা, তিক্ততা ও ঘৃণায় বিকৃত হয়ে উঠেছে। ছাত্ররা বুঝতে পেরেছে, তিনি তাদের সাক্ষী রেখে আত্মঅবমাননার কী নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন! ক্লাসের সেই নিস্তব্ধতার নিপীড়ন স্মৃতি কখনো ভুলবার নয়।

নামকরণের সার্থকতা যাচাই : মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক পণ্ডিত মশাই জীবনের ওপর প্রবল বিতৃষ্ণা নিয়ে বেঁচেছিলেন। তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র পঁচিশ টাকা, যা কিনা লাট সাহেবের কুকুরের একটি পায়ের খরচের সমান।

কুকুরের একটি পায়ের সাথে নিজেকে তুলনা করে তিনি আত্মঅবমাননার নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখলেন এবং সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন শিক্ষক জীবনের দুরবস্থার চিত্র।অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের প্রতি লক্ষ রেখেই গল্পকার এ গল্পের নামকরণ করেছেন ‘পাদটীকা’। সুতরাং এ নামকরণ সার্থক হয়েছে।

উপসংহার : ‘পাদটীকা’ গল্পের নামকরণে সৈয়দ মুজতবা আলী অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে সংস্কৃত পণ্ডিতদের প্রতি অবহেলার চিত্র তিনি কুকুরের একটি পায়ের সাথে তুলনা করে ফুটিয়ে তুলেছেন। অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের ওপর ভিত্তি করে তিনি আলোচ্য গল্পের নামকরণে যথার্থ সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন ।

শিক্ষাগার

প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

মাহমুদুল হাসান

শিক্ষাগত যোগ্যতা
গণিতে অনার্স ও মাস্টার্স

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফাজিল সম্পন্ন

গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা

বিশেষ দক্ষতা

বাংলা সাহিত্য • গণিত • ইসলামিক শিক্ষা

অভিজ্ঞতা

শিক্ষকতা ও ৫+ বছর কন্টেন্ট রাইটিং

আমাদের লক্ষ্য

শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা। ২০২৩ সাল থেকে লাখো শিক্ষার্থী শিক্ষাগার থেকে উপকৃত হচ্ছে।

Leave a Comment