হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

বাঙ্গালা ভাষা প্রবন্ধের মূল বক্তব্য/মূলভাব/বিষয়বস্তু

উপস্থাপনা : আধুনিক বাংলা গদ্য সাহিত্যের ভিত্তিনির্মাতা, গদ্য প্রতিভার শ্রেষ্ঠ শিল্পী বাংলা সাহিত্য জগতের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিরচিত ‘বাঙ্গালা ভাষা প্রবন্ধটি বাংলা গদ্য সাহিত্যের অনন্য উপমা।

এ প্রবন্ধে লেখক বাংলা গদ্য সাহিত্যের উৎকৃষ্ট ভাষারীতি কী হবে সে সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য অভিমত উপস্থাপন করেছেন। প্রবন্ধটি তিনি এমন এক সময়ে রচনা করেছেন যখন বাংলা গদ্য সাহিত্যে সংস্কৃতবহুল সাধু ভাষা ব্যতীত কথ্য বা চলিত ভাষা ব্যবহার করা ছিল রীতিমতো ঘৃণ্য।

সাহিত্য বলতে যা বোঝায় : Oxford Dictionary-তে বলা হয়েছে Literature is the pieces of writing that are valued as works of art. অন্য অর্থে বলা যায়, সাহিত্য হচ্ছে- চিন্তাধারা ও কল্পনার সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পিত লিখিত রূপ। মূলত মানবজীবনের সুখ- দুঃখ, হাসি-কান্নাকে লেখনীর মাধ্যমে বইয়ের পাতায় জীবন্ত করে তোলাই সাহিত্য। তাই সাহিত্যের ভাষা হতে হবে সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ।

বাংলা ভাষারীতির বৈচিত্র্য : পৃথিবীর অন্যসব ভাষার মতো বাংলা ভাষারও দুটি রূপ রয়েছে-১. লেখ্য ভাষা, ২. কথ্য ভাষা ।

লেখ্য ও কথ্য ভাষায় প্রভেদ লক্ষ করা যায়, আর এটা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলায় লিখিত ও কথ্যরীতিতে যতটা প্রভেদ লক্ষ করা যায়, অন্য ভাষায় ততটা নয় ।

আরও জানো : সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের মূলভাব/বিষয়বস্তু/সারমর্ম

গ্রন্থ রচনার ভাষা : প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা গদ্য সাহিত্যে দুটি পৃথক ভাষারীতি প্রচলিত থাকলেও বাংলা গদ্য সাহিত্য রচনায় সাধু ব্যতীত কথ্য ভাষার ব্যবহার কল্পনাও করা যেত, না। সাধু ভাষা সকলের বোধগম্য না হলেও এ ভাষাই সাহিত্যে ব্যবহৃত হতো।

গ্রন্থ রচনায় মুখের ভাষা আদৌ গ্রহণযোগ্য ছিল না। গদ্য সাহিত্যে তখন সংস্কৃত পণ্ডিতদের একচেটিয়া প্রভাব ছিল। তারা সংস্কৃতবহুল সাধু ভাষাতেই গ্রন্থ রচনা করতো। ফলে এ সাহিত্য সবসময় সাধারণ মানুষের বোধগম্য হতো না ।

কথ্য ভাষার বিপ্লব : সংস্কৃতবহুল সাধু ভাষায় গ্রন্থ রচিত হওয়ার ফলে তা বাংলা ভাষাভাষী সমাজে অপরিচিত ও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। সাধারণের মাঝে এর গ্রহণযোগ্যতা কমে আসে। নীরস, শ্রীহীন ও দুর্বল বলে পরিগণিত হতে থাকে সাধু ভাষা। তাই রক্ষণশীল, সংস্কৃতপ্রিয় পণ্ডিতদের বিরোধিতা করে প্যারীচাঁদ মিত্র (টেকচাঁদ ঠাকুর) এ বিষবৃক্ষের মূলে কুঠারাঘাত করেন।

তিনি সম্পূর্ণ কথ্য ভাষায় তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস গ্রন্থ ‘আলালের ঘরের দুলাল’ রচনা করেন। লেখকের ভাষায় “সেইদিন হইতে শুষ্ক তরুর মূলে জীবনবারি নিষিক্ত হইল।” অর্থাৎ সেদিন থেকে কথ্য ভাষায় গ্রন্থ রচনা শুরু হওয়ায় তা সাধারণ মানুষের জন্য সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল হলো। ওই গ্রন্থ রচনা করে প্যারীচাদ মিত্র প্রমাণ করেন, সংস্কৃত ভাষার দুর্বোধ্য শব্দভান্ডার বাংলা সাহিত্যের মূল উপাদান নয় ।

আরও জানো : রাজবন্দীর জবানবন্দী প্রবন্ধের মূল বক্তব্য / মূলভাব

প্রাচীনপন্থি ও নব্যপন্থি : প্যারীচাঁদ মিত্র কর্তৃক কথ্য ভাষার বিপ্লব সূচিত হলে বাংলা সাহিত্যের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যান-

১. প্রাচীনপন্থি বা সংস্কৃত ভাষার পক্ষপাতী।
২. নব্যপন্থি বা কথ্য ভাষার পক্ষপাতী।

সংস্কৃত ভাষার পক্ষপাতীরা সংস্কৃত শব্দ ছাড়া অন্য শব্দ বাংলা সাহিত্যে ব্যবহার করতে নারাজ। অন্যদিকে নব্যপন্থি বা কথ্য ভাষার পক্ষপাতীরা মনে করেন, সংস্কৃতানুকরণ নয়; বরং যে ভাষা বাংলা সমাজে প্রচলিত, যা সকল বাঙালি সহজে বুঝতে পারে তা-ই বাংলা সাহিত্যের ভাষা হওয়া উচিত।

প্রাচীনপন্থিদের বক্তব্য : প্রাচীনপন্থিদের মুখপাত্র রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয়ের মতে, কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচনা আদৌ উচিত নয়। তার যুক্তি, এ ভাষায় রচিত গ্রন্থ পিতা-পুত্রে একত্রে বসে অসঙ্কুচিত মুখে কখনো পড়া চলে না।

এ ভাষায় গম্ভীরতা নেই বলে পাঠ্য-পুস্তকে এর স্থান অবাঞ্ছনীয়। তার এ অভিমতের কারণ, তিনি ইংরেজি ভাষা জানতেন না। পশ্চিমা জ্ঞানের সাথে তার সম্যক পরিচয় ঘটেনি বিধায় চলিত ভাষা সম্পর্কে তিনি এরূপ মতামত ব্যক্ত করেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, তিনি (ন্যায়রত্ন মহাশয়) আবাল্য সংস্কারজনিত কারণেই শুধু সাধারণ মুখের ভাষা সাহিত্যে ব্যবহারের বিরোধিতা করেছেন।

আরও জানো : সংস্কৃতি কথা প্রবন্ধের মূলভাব / মূল বক্তব্য / বিষয়বস্তু

নব্যপন্থিদের বক্তব্য : নব্যপন্থিদের মাঝেও বিভিন্ন জনের বিভিন্ন অভিমত ছিল। তাদের অনেকে চলিত ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে বেশ আগ্রহী ছিলেন। আবার কেউ কেউ এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন। যেমন- নব্যপন্থিদের মুখপাত্র শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘কলিকাতা রিভিউ’তে বাংলা ভাষা বিষয়ক এক নিবন্ধে নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এতে দেখা যায়-

১. তিনি বাংলা ভাষায় লিঙ্গভেদ মানেন না ।
২. বহুবচনে ‘গণ’ শব্দ ব্যবহারে তার আপত্তি। বাংলায় সন্ধি তার চক্ষুশূল।
৪. তিনি তদ্ভব শব্দ ব্যবহারের পক্ষে।
৫. বাংলায় তিনি ‘জনৈক’ শব্দ লিখতে দেবেন না
৬. মাথাকে ‘মস্তক’ বা বামনকে ‘ব্রাহ্মণ লেখা যাবে না।
৭. তিনি রূপান্তরিত শব্দের বদলে তৎসম শব্দ ব্যবহার করতে নারাজ।

বঙ্কিমের অভিমত ও সমন্বয় সাধন : সংস্কৃতবাদী প্রাচীনপন্থিদের বক্তব্যের ব্যাপারে বঙ্কিমচন্দ্র বলেন, “শুধু সাধু ভাষায় গ্রন্থ রচনা করা চলবে, কথ্য ভাষায় চলবে না”- এ অভিমত ঠিক নয়; বরং কথ্য ভাষায়ও সাহিত্য রচিত হওয়া উচিত। এর ফলে পাঠক রুচি পরিবর্তনের সুযোগ পাবে। নব্যপন্থিদের যুক্তির ব্যাপারে লেখকের অভিমত হলো, সাহিত্যের ভাষা কোনো আইন মেনে চলে না। কাজেই ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে গোঁড়ামি পরিহার করতে হবে।

প্রাচীনপন্থি ও নব্যপন্থি উভয় দলের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিজ্ঞ অভিমত তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য মানুষকে জ্ঞানদান । কাজেই যে ভাষা অধিকাংশ লোকের বোধগম্য ও পরিচিত, সে ভাষাতেই গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিত। অকারণে প্রচলিত শব্দের উচ্ছেদ অনুচিত এবং তা সম্ভবও নয়। তিনি সাহিত্য রচনায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। যারা শুধু সংস্কৃত পূজারী তাদেরকে লেখক সংস্কৃত ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়েছেন।

বাংলা গদ্যরীতি সম্পর্কে লেখকের অভিমত : লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষার উচ্চতা ও সামান্যতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন সরলতা ও স্পষ্টতা। যে রচনা পড়ামাত্র সকলে বুঝতে পারে, তা-ই উৎকৃষ্ট রচনা।

তাই গ্রন্থ রচয়িতাকে সর্বপ্রথম দেখতে হবে, তিনি যা বলতে চান তা কোন ভাষার শব্দ ব্যবহার করলে সর্বাপেক্ষা সহজ ও সুন্দর হবে। প্রয়োজনে ইংরেজি, ফারসি, আরবি, সংস্কৃত ইত্যাদি যে-কোনো ভাষার শব্দের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। আর এভাবেই বাংলা ভাষায় সর্বোৎকৃষ্ট রচনা নির্মাণ করা সম্ভব।

উপসংহার : সাহিত্য হলো মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাই সাহিত্যের ভাষা হবে সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ঝরনার মতো প্রবহমান, যাতে তা সব মানুষের বোধগম্য হয়। কারণ সাহিত্য যদি মানুষের বোধগম্য না হয় তাহলে সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। প্রবন্ধের মূল বক্তব্যে প্রবন্ধকার এ বিষয়টিই তুলে ধরতে চেয়েছেন।

শিক্ষাগার

প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

মাহমুদুল হাসান

শিক্ষাগত যোগ্যতা
গণিতে অনার্স ও মাস্টার্স

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফাজিল সম্পন্ন

গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা

বিশেষ দক্ষতা

বাংলা সাহিত্য • গণিত • ইসলামিক শিক্ষা

অভিজ্ঞতা

শিক্ষকতা ও ৫+ বছর কন্টেন্ট রাইটিং

আমাদের লক্ষ্য

শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা। ২০২৩ সাল থেকে লাখো শিক্ষার্থী শিক্ষাগার থেকে উপকৃত হচ্ছে।

Leave a Comment