উপস্থাপনা : ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও শিখা গোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সাহিত্যিক জীবনের শুরু। তিনি যুক্তিবাদী, বিশ্লেষণধর্মী এবং মুক্তবুদ্ধিদৃপ্ত একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তার প্রবন্ধ সাহিত্য অত্যন্ত রুচিশীল ও পরিচ্ছন্ন।
‘সংস্কৃতি কথা’ তার অমর সৃষ্টি। এতে তিনি সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিমান লোকের স্বরূপ বিশ্লেষণ, ধর্মের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক ও বৈপরীত্য নির্ণয় এবং সভ্যতা ও মতবাদের সূক্ষ্ম আলোচনা দৃষ্টান্ত সহকারে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করেছেন।
সংস্কৃতি : সংস্কৃতির ইংরেজি প্রতিশব্দ Culture. Oxford Dictionary-তে Culture বলতে বোঝানো হয়েছে— The customs and beliefs, art, way of life: সংস্কৃতি মানে কৃষ্টি, উৎকর্ষ, চিৎপ্রকর্ষ ইত্যাদি।
পরিভাষায় কারো মতে, সংস্কৃতি হলো সভ্যতার নির্যাস ।
কারো মতে- Culture is to know the best that has been thought and said in the world. অর্থাৎ, সংস্কৃতি হচ্ছে উত্তমকে জানা, যা পৃথিবীতে বলা ও ভাবা হয়েছে। কারো মতে- Culture is a complete picture of life. অর্থাৎ, সংস্কৃতি হচ্ছে জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র।
প্রবন্ধকার মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মতে, সংস্কৃতি মানে জীবনের Values তথা মূল্যবোধ সম্বন্ধে ধারণা। সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা, প্রকৃতি-সংসার ও মানব-সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা; প্রচুরভাবে গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।
আরও জানো : যৌবনে দাও রাজটিকা প্রবন্ধের মূলভাব /সারমর্ম
ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বরূপ : লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, “ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার হলো শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা-সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি।” সাধারণ মানুষ ধর্মের ভেতর দিয়ে এগুলো পেয়ে থাকেন এবং নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
আর শিক্ষিত মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কালচারের মাধ্যমে এগুলোর সন্ধান করেন এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণ মানুষ ধর্মীয় নিয়ম-নীতি বা বাইরের বিধি-নিষেধের মধ্যেই জীবন চালনা করেন, কিন্তু কালচার্ড বা সংস্কৃতিমান ব্যক্তি বাইরের ধর্ম নয়; বরং তার ভেতরের সূক্ষ্ম চেতনার মাধ্যমেই চালিত হয়ে থাকেন।
সংস্কৃতির উদ্দেশ্য : সাহিত্য, শিল্প, সংগীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়- উপায় বা মাধ্যম। সংস্কৃতির উদ্দেশ্য ব্যক্তির নিজেকে অর্থাৎ ‘আমিত্ব’-কে পুনর্জন্ম দেওয়া। লেখকের ভাষায়, নিজের ভেতর একটা ঈশ্বর বা আল্লাহ সৃষ্টি করা। যিনি তা করতে পারেন তিনিই প্রকৃত কালচার্ড বা সংস্কৃতিমান। যারা বাইরের ধর্মকে গ্রহণ করে তারা আল্লাহকে জীবন-প্রেরণারূপে না পেয়ে ঠোঁটের বুলিরূপে পায়।
আরও জানো : রাজবন্দীর জবানবন্দী প্রবন্ধের মূল বক্তব্য / মূলভাব
তারা ভেতরের চেতনা না জাগিয়ে শুধু নরকের ভয় অথবা কল্পনার স্বর্গ পাওয়ার মানসে আল্লাহকে স্মরণ ও ধর্মের সাধনা করে। অন্যদিকে সংস্কৃতিমান ব্যক্তি নরকের ভয় বা স্বর্গলাভের আশা ব্যতিরেকেই সব অন্যায় নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও ঘৃণা করে। তারা ভেতরের চেতনায় তাড়িত হয়ে সৌন্দর্যের জন্য, আনন্দের জন্য, মানবকল্যাণের জন্য, আত্মবিকাশের জন্য সংস্কৃতির সাধনা করে।
সংস্কৃতির কাজ : সংস্কৃতি মানুষের মনের মাঝে একটি নিজস্ব জীবনদর্শনের জন্ম দেয়; সমাজ-মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত করে। শিক্ষা-দীক্ষা ও সৌন্দর্য সাধনার সাহায্যে সে সমাজের বুকে বিচরণ করে নিজেকে গড়ে তোলে। সংস্কৃতির কাজ হচ্ছে মানুষকে বিশেষভাবে, পরিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা ।
সংস্কৃতি ব্যক্তিতান্ত্রিক : লেখকের মতে, “কালচার সমাজতান্ত্রিক নয়; ব্যক্তিতান্ত্রিক। নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো, এটাই কালচারের আদেশ।” ব্যক্তির পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাজের পরিবর্তন সাধিত হয়। সে কারণেই আগে ব্যক্তি পরে সমাজ। ব্যক্তিকে তুলনা করা যায় নদীর সঙ্গে আর সমাজকে সমুদ্রের সঙ্গে।
নদী যেমন সমুদ্রে মিশে পূর্ণতা পায়, তেমনি ব্যক্তিও সমাজের মধ্যে খুঁজে পায় আপন জীবনের সার্থকতা। তাই প্রয়োজনে সংস্কৃতিমান ব্যক্তি সমাজের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত থাকে সমাজ দশের মধ্যে এক হওয়ার আর কালচার দশের মধ্যে এগারো হওয়ার আদেশ দেয়। দশের অধিকের মধ্য থেকেই নিজেকে নিজের মতো করে, পূর্ণাঙ্গ সুন্দর করে গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজের সর্বোত্তম সেবার শিক্ষা দেয় সংস্কৃতি
ধর্ম ও সংস্কৃতির পার্থক্য : নিজের চিন্তা-ভাবনা ও কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করে ধর্ম বিশ্বাসের সমতা স্থাপন করে মানুষের স্বাতন্ত্র্য লুপ্ত করতে চায় বলে অনেক সময় ধর্ম কালচারের পরিপন্থী। ধর্ম চায় মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে; মানুষকে বিকশিত করতে নয়। আর কালচারের উদ্দেশ্য জীবনের বিকাশ, পতন বা পাপ থেকে রক্ষা নয়।
ধর্ম সাধারণত ইন্দ্রিয় সাধনার পরিপন্থী, কিন্তু কালচার ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবন সাধনার মাধ্যমে নব জন্মদানের পক্ষপাতী। তাছাড়া ধার্মিকের চেয়ে কালচার্ড লোকের বন্ধন অনেক বেশি। ধর্মের কয়েকটি মোটা বন্ধন থাকলেও অসংখ্য সূক্ষ্ম চিন্তার বাঁধনে ফ্রি থিংকিং বা মুক্তচিন্তার মাধ্যমে মানুষের কালচারের বন্ধন হয় অন্তহীন।
সংস্কৃতির কেন্দ্র নারী : ধর্মের মাঝে বৈরাগ্যের বীজ উপ্ত রয়েছে। তাই কোনো কোনো ধর্ম নারীকে দেখেছে বিষের চোখে, কিন্তু ইন্দ্রিয়ের সাধনাবলে সংস্কৃতির কেন্দ্র হচ্ছে নারী। নারীকে উৎস করেই শিল্প-সাহিত্য গড়ে উঠেছে। জীবনের শক্তি, সাহস ও সাধনার প্রেরণা আসে নারী থেকে । নারীর প্রতি অত্যাচার, অবিচারের পরিবর্তে তাকে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ করে জীবনকে সুন্দর করে উপভোগ করাই কালচারের ধর্ম।
যৌন ব্যাপারে অতিরিক্ত কড়া শাসনের ফলে মানুষ যেন নিষিদ্ধ বস্তুর জন্য আরো বেশি আগ্রহী হয়ে থাকল। সংযম-শিক্ষার পথ হলো প্রেম। যে প্রেমের মূল্য উপলব্ধি করতে পেরেছে সে-ই সংযমী হতে পেরেছে। আর যে প্রেমের মূল্য উপলব্ধি করতে পারে না তার কাছে সংযম মানে আত্মপীড়ন ।
সংস্কৃতির বিচিত্র পথ : সংস্কৃতিমান মানুষ হওয়ার কোনো ধরাবাঁধা পথ নেই। কারণ সংস্কৃতির পথ বিচিত্র। প্রত্যেক সংস্কৃতিমান ব্যক্তিরই পথ আলাদা। যত সংস্কৃতিমান মানুষ, সংস্কৃতির তত পন্থা। তারা প্রত্যেকেই আলাদা মানুষ, স্বতন্ত্র সত্তা। তারা নিজের পথ নিজেই তৈরি করেন। কল্যাণের ব্যাপারে তারা সাম্যকে অস্বীকার করলেও প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, চিন্তার ব্যাপারে বৈচিত্র্যের পক্ষপাতী। তবে পথের ভিন্নতা থাকলেও লক্ষ্য তাদের একই । সকলেই অমৃত তথা আত্মাকে চায় ।
সংস্কৃতিমানদের দৃষ্টিতে প্রগতি ও সভ্যতা : লেখকের মতে, সাধারণ লোকের কাছে প্রগতি আর সভ্যতার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই, কিন্তু সংস্কৃতিমান ব্যক্তি তা স্বীকার করে না। সভ্যতা শুধু প্রগতি নয় আরো কিছু। প্রগতির সাথে সৌন্দর্যের সম্বন্ধ, প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপিত না হলে সভ্যতা হয় না । সভ্যতা সৃষ্টি করতে হলে চিরন্তনকে স্পর্শ করতে হবে।
সংস্কৃতি উন্নততর জীবনব্যবস্থার নির্মাতা : সংস্কৃতির কাজ হচ্ছে মানুষকে পূর্ণভাবে বিকশিত করে তার মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। সংস্কৃতি মানুষকে উদার, কর্মপরায়ণ, প্রেমিক ও স্বাতন্ত্র্যবোধের অধিকারী করে গড়ে তোলে। সংস্কৃতি উন্নততর জীবনব্যবস্থার নির্মাতা। সংস্কৃতি সত্যকে ভালোবাসা, সৌন্দর্যকে ভালোবাসা, ভালোবাসাকে ভালোবাসা, বিনালাভে ভালোবাসা শিক্ষা দিয়ে থাকে। সংস্কৃতি তাই উন্নততর জীবনের সোনালি সোপানের দিশা দেয় ।
উপসংহার : মানবজীবনকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা ও প্রগতির সংস্পর্শে পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত করার সর্বোত্তম মাধ্যম হলো সংস্কৃতি। ধর্ম ও মতবাদের শৃঙ্খল ডিঙিয়ে মূল্যবোধকে আশ্রয় করে গভীর প্রেম ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উন্মেষে বিচিত্র জীবনধারায় নিজেকে সুন্দর ও সার্থকভাবে গড়ে তোলাই হচ্ছে ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধের মূল উপজীব্য।