প্রশ্ন : প্রমথ চৌধুরীর যৌবনে দাও রাজটিকা প্রবন্ধের মূলভাব /মূল বক্তব্য / বিষয়বস্তু তোমার নিজের ভাষায় লেখ।
অথবা, ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধ অবলম্বনে প্রমথ চৌধুরীর যৌবন-বন্দনার স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।
উপস্থাপনা : বাংলা সাহিত্যের বিদগ্ধ সমালোচক ও মননশীল প্রাবন্ধিক, চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরী বিরচিত ‘যৌবনে দাও রাজটিকা একটি সুপ্রসিদ্ধ ও বহুল আলোচিত প্রবন্ধ । প্রবন্ধের প্রতিটি বাক্যে তিনি প্রাণ-প্রাচুর্যের অধিকারী যৌবনের জয়গান গেয়েছেন এবং যৌবনকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় বলে আখ্যায়িত করে এর ললাটে রাজটিকা পরানোর প্রস্তাব করেছেন।
মূলত এটি যৌবনবন্দনামূলক একটি প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে লেখক দেহ ও মনে যৌবনের সমন্বয় সাধনের আহ্বান জানিয়ে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন।
যৌবনে দাও রাজটিকা প্রবন্ধের মূলভাব/যৌবন-বন্দনার স্বরূপ
যৌবনের স্বরূপ/ধর্ম : বলা হয়- Youth is the season of hope, enterprise and energy, to a nation as well as an individual. অর্থাৎ যৌবন হচ্ছে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে আশা, উদ্যম ও কর্মশক্তির শ্রেষ্ঠ সময়। তাই যৌবন মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। যৌবনে মানুষ সুস্থ, সবল, সাহসী ও উদ্যমী থাকে। যৌবনের গতি উচ্ছল, চঞ্চল ও দুর্বার।
এ সময়ে মানুষ সৃষ্টির প্রেরণায় উজ্জীবিত হয় এবং আবিষ্কারের নেশায় মত্ত থাকে। যৌবন হলো অফুরন্ত শক্তি ও অবিরাম কর্মক্ষমতার আধার। যৌবনে মানুষের দেহ ও মন ষোলকলায় পূর্ণ থাকে। তাই যৌবনের মধ্যে আছে প্রাণচাঞ্চল্য আর সৃষ্টির প্রেরণা। যৌবনকে বয়সের ফ্রেমে বেঁধে রাখা যায় না। লেখক মানবজীবনের পূর্ণ অভিব্যক্তিকে যৌবন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
আরও জানো : সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের মূলভাব/বিষয়বস্তু/সারমর্ম
মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠা : মানবজীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময় যৌবন। যৌৱন একদিকে যেমন ভোগ করতে পারে, তেমনি ত্যাগও করতে পারে। কিন্তু বার্ধক্য ভোগ ও ত্যাগ কোনোটাই করতে পারে না। প্রাবন্ধিক যৌবনকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন- দৈহিক যৌবন ও মানসিক যৌবন। দৈহিক যৌবন ক্ষণস্থায়ী ও সংকীর্ণ, কিন্তু মানসিক যৌবন দীর্ঘস্থায়ী ও প্রশস্ত।
দৈহিক যৌবনের লীলাখেলা শুধু ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ, তাই এটি অন্যের দেহে সঞ্চার করা যায় না; কিন্তু মানসিক যৌবন অপরের দেহেও সঞ্চার করা যায়। তাই প্রাবন্ধিক মানসিক যৌবনকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।
যৌবন ক্ষণস্থায়ী : যৌবন ক্ষণস্থায়ী, অনিত্য। এজন্য এর প্রতি মানুষের প্রবল আকর্ষণ। তবে এ যৌবন হলো ব্যক্তিগত যৌবন। সামগ্রিকভাবে সমাজের যৌবন নিত্য বা ক্ষণস্থায়ী নয় সমাজজীবনে যৌবন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব কিছু নয়।
আরও জানো : সংস্কৃতি কথা প্রবন্ধের মূলভাব / মূল বক্তব্য / বিষয়বস্তু
যৌবনকে মানবজীবনের পূর্ণ অভিব্যক্তি বিবেচনা করে তা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যৌবনে মানুষের সকল ইন্দ্রিয় সবল ও সজাগ হয়ে ওঠে, ফলে সে সৃষ্টির প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়। যৌবনের সাধনা, সৃষ্টি, ত্যাগ, মহিমা ইত্যাদি ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধন করে।
প্রকৃত যৌবনের স্বরূপ : প্রবন্ধকার প্রমথ চৌধুরী প্রকৃত যৌবন বলতে সে শক্তিকে বুঝিয়েছেন, যা অমর অবিনশ্বর। তার মতে, প্রকৃত যৌবন হচ্ছে মনের যৌবন- যা বয়সের ছকে বাঁধা নয়। কেননা দৈহিক যৌবন অন্যের মধ্যে সংক্রমিত করা যায় না, কিন্তু মনের চেতনায় যে যৌবন তা লাখো কোটি প্রাণে সঞ্চার করা যায়। তাই এ মানসিক যৌবন দেশ ও কালের ফ্রেমে বন্দি নয়, তা কালোত্তীর্ণ ও বিশ্বজনীন।
যৌবনবন্দনার স্বরূপ : বলা হয়- Youth is the most important time of human life. কিন্তু তাই বলে যৌবনকে বয়সের মাপকাঠিতে, সময় বা কালের ফ্রেমে বেঁধে রাখা ঠিক নয়। মনের যৌবনই প্রকৃত যৌবন। যার মনে যৌবন নেই তার দৈহিক যৌবন মূল্যহীন। দেহের যৌবন এক দেহ থেকে অন্য দেহে সঞ্চার করা যায় না, কিন্তু মনের যৌবন অন্য মনে সঞ্চার করা সম্ভব।
তাই সমাজে এ মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে ফাল্গুন একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না, কিন্তু সমগ্র সমাজে ফাল্গুন চিরদিন বিরাজ করে। আমরা সমগ্র সমাজকে একটি ব্যক্তি হিসেবে দেখলেও আসলে মানবসমাজ হচ্ছে বহু ব্যক্তির সমষ্টি। যে সমাজে বহু ব্যক্তির মানসিক যৌবন আছে, সে সমাজেরই যৌবন আছে।
প্রবন্ধকারের দৃষ্টিতে যৌবন : প্রবন্ধকার মনে করেন, যৌবন মানবজীবনের সর্বোত্তম ও দুর্লভ সময় ৷ যৌবন মানবজীবনে পূর্ণতা আনে। যৌবন দুরন্ত, শক্তির উৎস, কর্মক্ষম সৃষ্টির প্রেরণায় পরিপূর্ণ। যৌবনের ধর্ম কেবল ভোগ ও বাসনা নয়; ত্যাগ এবং সৃষ্টিও বটে। যৌবনে সকল ইন্দ্রিয় সক্রিয় এবং সকল অনুভূতি তীক্ষ্ণ থাকায় প্রেরণা হয়ে ওঠে প্রবল ।
যৌবনই জাতির ললাটে সৌভাগ্য ও সাফল্য বয়ে আনে। যৌবনশক্তিতে বলীয়ান হয়ে মানুষ দেশ ও জাতির অসংখ্য কল্যাণ সাধন করতে পারে। লেখক মনে করেন, যৌবন সৃষ্টির গৌরবে ভাস্বর, ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল। তাই প্রবন্ধকার যৌবনের কপালে রাজটিকা পরানোর কথা বলেছেন ।
প্রাবন্ধিকের দৃষ্টিতে দেহ ও মনের যৌবন : দেহ ও মনের যৌবনের পার্থক্য সম্পর্কে প্রাবন্ধিক বলেছেন, “দেহ ও মনের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের ওপর মানবজীবন প্রতিষ্ঠিত হলেও দেহমনের পার্থক্যের ওপরেই আমাদের চিন্তারাজ্য প্রতিষ্ঠিত। দেহের যৌবনের সঙ্গে মনের যৌবনের একটা যোগাযোগ থাকলেও দৈহিক যৌবন ও মানসিক যৌবন স্বতন্ত্র !
এই মানসিক যৌবন লাভ করতে পারলেই আমরা তা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারব। দেহ সংকীর্ণ ও পরিচ্ছিন্ন; মন উদার ও ব্যাপক। একের দেহের যৌবন অপরের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেবার জো নেই; কিন্তু একের মনের যৌবন লক্ষ লোকের মনে সংক্রমণ করে দেওয়া যেতে পারে।”
বিশ্লেষণ : দেহ ও মন পরস্পর নির্ভরশীল হলেও দেহের ওপর মনের প্রভাব অত্যধিক । সমাজকে সজাগ, সচল ও সজীব করতে হলে মনের যৌবন আবশ্যক । সমাজে নতুন মন ও প্রাণের নিত্য জন্মলাভ একান্ত আবশ্যক। যে যৌবন সমাজে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করে সে মানসিক যৌবনকে লেখক রাজটিকা পরিয়ে দিতে বলেছেন। দেহের যৌবনের স্থায়িত্ব যেহেতু কম ও সীমিত, সেহেতু মনের চিরস্থায়ী যৌবনের পরিচর্যা করাই যুক্তিযুক্ত।
যৌবনে রাজটিকা পরানোর উপায় : যৌবনে রাজটিকা পরানোর অর্থ হলো, যৌবনকে গুরুত্ব দেওয়া, একে ধরে রাখা এবং সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। যৌবনে এ রাজটিকা পরানো যায় কেবল চেতনাগত বিকাশের মাধ্যমে। চেতনাগত বিকাশের মধ্য দিয়েই দৈহিক যৌবন মানসিক যৌবনে পরিণত হয়। কেননা আমাদের দেহ ও মনের মধ্যে গভীর আন্তঃসংযোগ রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে মানসিক যৌবনের ললাটে যারা রাজটিকা দিতে আপত্তি করেন, তারা হয় জড়বাদী না হয় মায়াবাদী। সাধারণত জড়বাদী ও মায়াবাদীদের পরস্পরবিরোধী মতবাদের ধারক-বাহক বলে মনে করা হলেও বস্তুত তারা অভিন্ন। যৌবনে রাজটিকা দিতে তারা বিমুখ। কেননা তারা জড়তার পূজারী। এটাই ‘যৌবনে দাও রাজটিকা প্রবন্ধের মূল কথা ।
উপসংহার : সমাজের প্রত্যেকের উচিত আত্মচেতনায় বলীয়ান হয়ে মানসিক যৌবনকে চাঙ্গা করা। কারণ মানসিক যৌবন না থাকলে ক্ষণস্থায়ী শারীরিক যৌবন অর্থহীন এবং এ যৌবন সমাজের কল্যাণে এতটুকু ব্যয় হবে না। যে সমাজে যৌবন নেই সে সমাজের মেরুদণ্ড নেই। যে সমাজের যৌবন আছে সে সমাজ প্রগতির পথে এগিয়ে যায়। তার গতি কেউ রোধ করতে পারে না।