হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

কাররামিয়াদের পরিচয়, উৎপত্তির ইতিহাস,আকিদা বা মূলনীতি

উপস্থাপনা : ধর্মতত্ত্বভিত্তিক সম্প্রদায়সমূহের মাঝে কাররামিয়া সম্প্রদায়ের নামও উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টীয় দশম শতকে এ মতবাদের আবির্ভাব ঘটে। নিম্নে তাদের পরিচয়, উৎপত্তি ও আকিদা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

কাররামিয়াদের পরিচয় :

কাররামিয়া দলটির প্রতিষ্ঠাতা আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে কাররাম সিজিস্তানীর দিকে সম্পৃক্ত করে এ দলটিকে কাররামিয়া বলা হয়। কথিত আছে, তিনি ১৯০ হিজরী মোতাবেক ৮০৬ খ্রিস্টাব্দে সীস্তান/সিজিস্তান-এর অন্তর্গত যারানজ (-১)-এর নিকটবর্তী একটি স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এজন্য তার পদবী হয় সিজিস্তানী। যারা তার মতবাদের অনুসরণ করত, তারা কাররামিয়া নামে পরিচিত।

আরও পড়ুন : কাদিয়ানী কারা? এবং এদের মতাদর্শ আলোচনা কর

কাররামিয়াদের উৎপত্তি :

দলটির মতবাদে আল্লাহর প্রতি মানবত্ব আরোপ ও আল্লাহকে মানবগুণসম্পন্ন বলা তথা নরাত্বারোপবাদী এর চিন্তাভাবনা থাকায় এ দলটিকে মুজাসসিমা মুশাববিহা ও সাদৃশ্যবাদী দলভুক্ত হিসেবে গণ্য করেছেন।শুরুতে ইবনে কাররাম সিজিস্তানে তার স্বরচিত গ্রন্থ عذاب القبر-এর মতবাদ প্রচার শুরু করেন।

যার মধ্যে মুনকার নাকীর ফেরেশতাদ্বয় ও কিরামান কাতিবীনকে অভিন্ন বলে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এ কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়ায় স্থানীয় গভর্নর তাকে সিজিস্তান থেকে বহিষ্কার করেন। পরে তিনি গুরজিস্তান ও খোরাসানের সাধারণ মানুষের মধ্যে তার মতবাদ প্রচার করতে থাকেন।

এ প্রচারকালে তিনি সুন্নী ও শিয়া উভয় দলকে আক্রমণ করতে থাকেন ।এখান থেকে তিনি তাঁতী ও নিম্নশ্রেণির অনুসারীদেরকে নিয়ে নিসাপুরে উপস্থিত হলে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদের আশঙ্কায় সেখানকার গভর্নর তাকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন।

আরও পড়ুন : কাদিয়ানী মতবাদ কি? তাদের আকিদা ও আকিদার মূলনীতি

সুদীর্ঘ ৮ বছর কারাভোগের পর ২৫১ হিজরী মোতাবেক ৮৬৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান। তারপর নিসাপুর ত্যাগপূর্বক জেরুযালেমে গমন করেন এখানেই বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। ২৫৫ হিজরীর সফর মাস মোতাবেক ৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

কাররামিয়াদের শেষ শক্তিশালী আশ্রয় ছিল মধ্য আফগানিস্তানের পর্বতবেষ্টিত অঞ্চল ঘুর। ঘুরী সুলতান গিয়াসউদ্দীন মুহাম্মদ এবং তার ভাই মুইজউদ্দীন মুহাম্মদ-এর কাররামিয়া মতবাদের সাথে একাত্মতার সুবাদে এমনটি হয়েছিল। পরবর্তীতে এতদঞ্চলে মুঘল আক্রমণের পর কাররামিয়াদের তৎপরতার আর কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না

কাররামিয়াদের আকিদার মূলনীতি :

কাররামিয়াদের অভিনব আকিদার সংখ্যা অগণিত। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নরূপ-

১. ইবনে কাররামের স্বরচিত গ্রন্থ ‘আযাবুল কবরে’ মুনকার নাকীর নামক ফেরেশতাদ্বয় ও কিরামান কাতিবীনকে অভিন্ন বলে দেখানো হয়েছে।

২. তারা আল্লাহর প্রতি মানবত্ব আরোপ ও আল্লাহকে মানুষের সাথে সাদৃশ্য বিধান করে। ইবনে কাররাম মনে করতেন, আল্লাহ এমন এক শরীরী সত্তা, যার সীমা ও প্রান্ত রয়েছে দুই দিক থেকে, নিচের দিক থেকে এবং তাঁর যে অংশ আরশের সাথে সংযুক্ত সেই দিক থেকে।

ইবনে কাররাম তার ‘আযাবুল কবর’ গ্রন্থের ভূমিকায় আল্লাহকে জওহার তথা মূলসত্তা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আবদুল কাহের বাগদাদীর মতে, এভাবে তিনি খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের দিকে অগ্রসর হন। কারণ খ্রিস্টানরা আল্লাহকে এ তথা মূলসত্তা বলে আখ্যায়িত করেছেন ।

আরও পড়ুন : জাহমিয়াদের পরিচয়, উৎপত্তির ইতিহাস ও আকিদার বিবরণ

৩. তারা আল্লাহ তায়ালার ভার (ওজন) আছে, বলে মনে করত। আল্লাহর বাণী اذا السماء فطرت -এর ভিত্তিতে তারা বলত, আসমান ফেটে যাবে আল্লাহ তায়ালার ভারে।

৪. ইবনে কাররাম الرحمن على العرش استوى এর ব্যাখ্যায় বলত, আরশের সাথে আল্লাহ তায়ালার শারীরিক দোয়ার সম্পর্ক বিদ্যমান, আরশ হলো আল্লাহর অবস্থানের স্থান ।

৫. তারা মনে করত, আল্লাহর সত্তা অনিত্ব গুণাবলির আধার। ইচ্ছা, অনুভূতি, দর্শন, বাকশক্তি এগুলো হলো অনিত্ব বিষয় (حادث), আর আল্লাহ তায়ালা হলেন এসব অনিত্ব বিষয়ের আধার ( محل حوادث)

৬. তাদের ধারণা, আল্লাহ তায়ালার সর্বপ্রথম সৃষ্টি এমন প্রাণবিশিষ্ট কোনো শরীরী সত্তা হওয়া উচিত, যা উপদেশ গ্রহণ করতে সক্ষম। এর বিপরীত কোনো জড়বস্তুকে প্রথমে সৃষ্টি করা হেকমত পরিপন্থি ।এ বক্তব্যের ভিত্তিতে যে হাদীসে বলা হয়েছে আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে লাওহে মাহফুযে কেয়ামত পর্যন্ত সবকিছু লিখে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন, তা প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায় ।

৭. কাররামিয়াগণ মনে করত, যে শিশুদের ব্যাপারে আল্লাহর জানা আছে যে, বড় (বালেগ) হলে তারা ঈমান আনত, তাদের মৃত্যু ঘটানো আল্লাহর হেকমত অনুসারে সম্ভব নয় ।

৮. কাররামিয়াগণ বলত, যেসব গুনাহের কারণে সততা রহিত হয়ে যায় বা হৃন্দ জারি হয়, এমন পাপ থেকে নবীগণ মাসুম তথা নিষ্পাপ ছিলেন। এর চেয়ে নীচু পর্যায়ের পাপ থেকে তারা মাসুম ছিলেন না।

৯. তারা বলত, ঈমান হলো শুধু মুখে স্বীকৃতি প্রদানের নাম। অন্তরের বিশ্বাস না থাকলেও চলে, আমল না থাকলেও চলে। এ কারণে তাদের ধারণা ছিল, একবার কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স)-এর প্রতি ঈমানের সাক্ষ্য প্রদান করলে তার ঈমান চিরস্থায়ী হয়ে যায়, এমনকি মনেপ্রাণে রিসালাতকে অস্বীকার করলেও তার ঈমান বিনষ্ট হয় না।

কেবল মুরতাদ হলেই তার ঈমান বিনষ্ট হয়। এমন হলে মুনাফিকদের সম্পর্কে জাহান্নামের তলদেশে থাকার হুঁশিয়ারি প্রদানের কোনো হেতু ছিল না। কারণ তারা মুখে ঈমান আনয়নের কথা ব্যক্ত করত। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে-إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ فِى الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ . অর্থাৎ, মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে।

১০. খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের ব্যাপারে তাদের মত ছিল, একমাত্র জাতির সর্বসম্মত মতের ভিত্তিতেই তা হতে হবে।

এ ব্যাপারে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মত হলো, পূর্ববর্তী খলিফা কর্তৃক মনোনয়নের পদ্ধতিও বিশুদ্ধ। যেমন হযরত ওমর (রা) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) কর্তৃক মনোনীত হয়েছিলেন।

পরিশেষে : কাররামিয়ারা তাদের মতবাদ প্রচারে মুসলমানদের ওপর তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। শাহরাস্তানীর মতে, কাররামিয়াদের ১২টি উপদল ছিল; কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর তাদের কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। কারো মতে, প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর তাদের সকল কর্মতৎপরতা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। সত্যপন্থিদের মতে, তারা ছিল বাতিল ফেরকা।

Leave a Comment