একটি আদর্শ সমাজ গড়ার জন্য প্রয়োজন কিছু আদর্শ মানুষের । আর আল্লাহর রাসূলের সংস্পর্শে তার এসব সাথী আদর্শ মানবে পরিণত হন। যার ফলে সম্ভব হয় একটি আদর্শ সমাজ উপহার দেওয়া। নবী-রাসূলগণের পরেই এ সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা। নিম্নে সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
সাহাবায়ে কেরামের পরিচয় :
আভিধানিক অর্থ : صَحَابَةٌ শব্দটি একবচন, বহুবচনে أَصْحَابٌ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো— সাথী, সঙ্গী, বন্ধু, সহচর, অনুসারী ইত্যাদি।
পারিভাষিক সংজ্ঞা : ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মানবজাতির মধ্যে এমন এক সম্মানিত জামাত যারা হযরত মুহাম্মদ (সা) কে নিজ চোখে দেখেছেন, তার রিসালাতের উপর ঈমান এনেছেন, তাকে ভালোবেসেছেন এবং ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন তাদেরকে সাহাবী বলা হয়।
আরও পড়ো : সাহাবা অর্থ কি?সংজ্ঞা, আখলাক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
কিভাবে সাহাবীগণের পরিচয় লাভ করা যাবে :
যেসব ব্যক্তি ঈমানের সাথে রাসূলুল্লাহ (স)-এর সাহচর্য লাভ করেছেন বা দেখেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন; তাদেরকে সাহাবী বলা হয়। সাহাবীদের পরিচয় লাভের পদ্ধতি বর্ণনায় ড. মাহমুদ আত ত্বহান পাঁচটি পর্যায় উল্লেখ করেছেন। যথা-
১. মুতাওয়াতির পর্যায় : সর্বজনস্বীকৃত মুতাওয়াতির পদ্ধতিতে। যেমন— চার খলিফা, আশারায়ে মুবাশশারা, যাদের সাহাবী হওয়াটা মুতাওয়াতির পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এদের ব্যাপারে কোনো সংশয় সন্দেহের অবকাশ নেই।
২. অধিক প্রসিদ্ধি : সাহাবী এমন ব্যক্তি হবেন যিনি সকলের মাঝে প্রসিদ্ধ এবং সাহাবী হিসেবে খ্যাত। যেমন- হযরত যিমাম ইবনে সালাবা, মুহকাশাহ ইবনে মুহসিন ।
৩. সাহাবী কর্তৃক সংবাদ প্রদান : কোনো সাহাবী কর্তৃক এভাবে সংবাদ প্রদান যে, অমুক ব্যক্তি সাহাবী ছিলেন। যেমন- হাম্মামা ইবনে আবি হাম্মাহ্ আদ দাওসী সম্পর্কে আবু মুসা আশয়ারী (রা) সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি সাহাবী ছিলেন।
আরো : সাহাবা কাকে বলে? সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা কোরআন হাদিসের আলোকে
৪. নির্ভরযোগ্য তাবেয়ীর সংবাদ প্রদান : কোনো নির্ভরযোগ্য তাবেয়ী কর্তৃক সাক্ষ্য দেয়া যে, অমুক ব্যক্তি সাহাবী ছিলেন ।
৫. ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির সাক্ষ্য : কোনো ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি নিজের পক্ষে এমর্মে সাক্ষ্য দেবে যে, আমি সাহাবী অথবা আমি রাসূলূল্লাহ (স)-কে দেখেছি; তবে উক্ত সাক্ষ্যদাতাকে অবশ্যই নির্ভরযোগ্য ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।
সাহাবীগণের সমালোচনা করার বিধান :
১. সাহাবীগণের সমালোচনা করা নিষেধ। কুরআন হাদীসের আলোকে আহলে হকের সর্বসম্মত মত অনুযায়ী এটা নিষিদ্ধ। সাহাবীদের সমালোচনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নবী করীম (স) ইরশাদ করেন-
قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اللهَ اللهَ فِي أَصْحَابِي، لَا تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضًا مِنْ بَعْدِي، فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّي أَحَبَّهُمْ، وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِي أَبْغَضَهُمْ۔
অর্থাৎ, মহানবী (স) বলেন, সাবধান! সাবধান! আমার সাহাবীদের সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় কর। আমার পর আমার সাহাবীদেরকে তোমরা সমালোচনার বস্তুতে পরিণত করো না। বস্তুত যে আমার সাহাবীদেরকে ভালোবাসল, সে আমার প্রতি ভালোবাসার কারণেই তাদেরকে ভালোবাসল, আর যে তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ রাখল, সে আমার প্রতি বিদ্বেষের কারণেই তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ রাখে।
আরো : নবী করীম (সা) এর: জন্ম, নাম, বংশ পরিচয় ও মর্যাদা
২. ইমাম আবু হানীফা (র) الفِقْهُ الأَكْبَرُ গ্রন্থে বলেছেন- لَا تَذْكُرْ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَّا بِخَيْرٍ অর্থাৎ, আমরা সাহাবীদের গুণ চর্চা করব, দোষ চর্চা করব না।
৩. ইমাম আবু যুরয়া (র) বলেছেন, যখন কোনো ব্যক্তিকে দেখবে, সে কোনো সাহাবীর সমালোচনা করছে, তাহলে নির্ঘাত মনে করবে সে যিনদীক বা ধর্মত্যাগী। কারণ আমাদের দৃষ্টিতে রাসূল (স) হক ও কুরআন হক। এ কুরআন ও হাদীস সাহাবায়ে কেরামই আমাদের নিকট পৌঁছিয়েছেন।
তারা চায় আমাদের এ সূত্রপরম্পরাকে বিক্ষত করতে, যাতে পরিণামে পূর্ণ কুরআন সুন্নাহই বাতিল বলে বিবেচিত হয়। সুতরাং এরাই সমালোচনার অধিক উপযুক্ত। কারণ এরা যিনদীক তথা ধর্মত্যাগী।
৪. মোল্লা আলী কারী (র) মিরকাতে লিখেছেন, আমাদের কোনো কোনো আলেম স্পষ্টই বলেছেন, যে ব্যক্তি হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রা)-কে মন্দ বলবে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।
৫. ইবনে নুজাইম (র) এ الأَشْبَاهُ وَالنَّظَائِرُ গ্রন্থের سِيرٌ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন, কোনো কাফের যদি তওবা করে, তবে তার তওবা কবুল হবে; কিন্তু ঐ কাফেরদের তওবা কবুল হবে না, যারা কাফের প্রমাণিত হয়েছে নবী করীম (স)-কে মন্দ বলার কারণে।
শায়খাইন (আবু বকর ও ওমর রা.)-কে মন্দ বলার কারণে কিংবা তাঁদের যে কোনো একজনকে মন্দ বলার কারণে, অথবা যাদু কিংবা নাস্তিকতার কারণে যারা কাফের হয়েছে, তাদের তওবা কবুল হবে না ।
৬. কাযী আয়ায (র) বলেছেন, যে কোনো একজন সাহাবীকে মন্দ বলাও কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত।
৯. মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, সাহাবায়ে কেরামকে মন্দ বলা জঘন্যতম হারামের অন্তর্ভুক্ত।
১০. মালেকী মাযহাবের কোনো কোনো ফকীহ বলেছেন, এমন ব্যক্তির শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড।
১১. তবে জমহুরের মাযহাব হলো, এমন ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে না; তবে তাযীর করা হবে।
পরিশেষে : আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সকল ইমাম ও আলেমের সর্বসম্মত মতানুসারে কোনো সাহাবীকে মন্দ বলা, সামান্যতম খারাপ ভাবা ও সমালোচনা করা পবিত্র কুরআন, হাদীস ও রাসূল (স)-এর সুন্নাতকে অবজ্ঞা করার শামিল।