মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মুখনিঃসৃত অমিয় বাণীই হচ্ছে হাদীস। এ হাদীস গ্রহণ কিংবা বর্জন প্রশ্নে হাদীসের সনদ ও মতন এবং বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণালাভের জন্য যেসব বিষয় খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার দাবি রাখে, সেসব বিষয় জানার জন্য উসুলুল হাদিস (أُصُولُ الحَدِيثِ) সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা একান্ত অপরিহার্য ।
উসুলুল হাদিস(أُصُولُ الحَدِيثِ) এর পরিচয়:
উসুলুল হাদিস-এর সংজ্ঞা দু’ভাবে দেয়া যায় । যথা-
১। تَـعْرِيفٌ إِضَافِيٌّ তথা সম্বন্ধবাচক সংজ্ঞা।
২। تَـعْرِيفٌ لَقَبِيٌّতথা পদবিবাচক সংজ্ঞা ।
নিম্নে উভয় সংজ্ঞা পৃথকভাবে উপস্থাপন করা হলো ।
১। تَـعْرِيفٌ إِضَافِيٌّ তথা সম্বন্ধবাচক সংজ্ঞা :
أُصُولُ الحَدِيثِ একটি مُرَكَّبْ বা যৌগিক শব্দ, যা দুটি শব্দ দ্বারা গঠিত হয়েছে। একটি হলো أُصُولُ আর অপরটি হলো
الحَدِيثِ; নিম্নে উভয়ের পৃথক পৃথক সংজ্ঞা প্রদান করা হলো ।
ক. أُصُولُ-এর আভিধানিক অর্থ : আরবিতে أُصُولُ শব্দটি أَصْلٌ-এর বহুবচন। অভিধানে শব্দটি কয়েকটি অর্থে ব্যবহার হয়। যেমন-
১. মূল, গোড়া, শিকড় বা ভিত্তি।
২.আল্লামা রাগেব ইস্পাহানী (র)-এর মতে, أُصُولُ শব্দের অর্থ হলো মূল। যেমন আল্লাহর বাণী- أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ
৩. উৎস, ভিত্তি, জন্ম, সৃষ্টি।
আরও জানো : হাদিস(حَدِيثٌ) অর্থ, সংজ্ঞা, প্রকারভেদ,উদ্দেশ্য ও আলোচ্য বিষয়
খ. أُصُولُ-এর পারিভাষিক সংজ্ঞা : أُصُولُ শব্দটি أَصْلٌ এর বহুবচন। পরিভাষায় أَصْلٌ শব্দটি চারটি অর্থে ব্যবহার হয়। যথা-
১. رَاجِعْ তথা অগ্রগণ্য। যেমন- সুন্নাতের তুলনায় কিতাবুল্লাহ্ অগ্রগণ্য।
২. قَاعِدَةٌ তথা নিয়ম। যেমন – ফায়েল মারফু হওয়া এটা আরবি ব্যাকরণের একটি নিয়ম।
৩. دَلِيلٌ তথা প্রমান। যেমন – أَقِيمُوا الصَّلَاةَ أَصْلٌ لِوُجُوبِ الصَّلَاةِ অর্থাৎ তোমরা নামাজ কায়েম কর। আয়াতটি নামাজ ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ।
৪। اِسْتِصْحَابٌ তথা মৌলিক অবস্থা। যেমন – পানির মৌলিক অবস্থা হচ্ছে পবিত্রতা।
গ. الحَدِيثِ এর আভিধানিক অর্থ : حَدِيثِ শব্দটি اِسْمٌ তথা বিশেষ্য। একবচন, বহুবচনে أَحَادِيثُ মূল অক্ষর ح – د – ث জিনসে صَحِيحٌ; এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে –
১. কথা , বাণী।
২. উপদেশ।
৩. কাহিনী , ঘটনা।
৪. সংবাদ বা খবর ইত্যাদি ।
ঘ. الحَدِيثِ এর পারিভাষিক সংজ্ঞা :
১। নবী করীম (সাঃ) এর কথা, কাজ ও মৌনসমর্থন অনুরূপ সাহাবী ও তাবেয়ীদের কথা, কাজ ও মৌনসমর্থন কেও হাদিস বলে।
২। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (র) বলেন – الْحَدِيثُ هُوَ أَقْوَالُ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَفْعَالُهُ وَتَقْرِيرَاتُهُ অর্থাৎ, নবী করীম (স) এর কথা, কাজ ও মৌনসম্মতিকে হাদিস বলে।
আরও জানো : কুরআন ও হাদীসের : অর্থ , সংজ্ঞা ও পার্থক্য
২। تَـعْرِيفٌ لَقَبِيٌّ তথা পদবিবাচক সংজ্ঞা :
ক। যে সকল নিয়ম পদ্ধতির জ্ঞানের মাধ্যমে হাদীসকে গ্রহণ ও বর্জনের বিষয়ে হাদিসের সনদ ও মতনের যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে জানা যায় তাকে উসুলুল হাদিস বলা হয়।
২. কতিপয় আলেম বলেন – هُوَ عِلْمٌ يُعْرَفُ بِهِ أَحْوَالُ السَّنَدِ وَالمَتْنِ অর্থাৎ, যা দ্বারা সনদ ও মতনের অবস্থা জানা যায় তাই উসূলে হাদিস।
উসুলুল হাদিসের আলোচ্য বিষয় :
أُصُولُ الحَدِيثِ এর এর আলোচ্য বিষয় হচ্ছে السَّنَدُ وَالْمَتْنُ مِنْ حَيْثُ القَبُولُ وَالرَّدُّ অর্থাৎ হাদিসকে গ্রহণ ও বর্জনের বিষয়ে হাদিসের সনদ ও মতনই হচ্ছে উসূলুল হাদিস এর আলোচ্য বিষয়। মোট কথা أُصُولُ الحَدِيثِ এর আলোচ্য বিষয় দুটি। যথা – ১. হাদিসের সনদ। ২. হাদিসের মতন।
উসুলুল হাদিসের উদ্দেশ্য :
উদ্দেশ্যবিহীন প্রত্যেকটি কাজই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কাজেই উসূলুল হাদিসের একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। আর তা হচ্ছে – مَعْرِفَةُ الصِّحَةِ وَالضُّعْفِ مِنَ الاَحَادِيثِ অর্থাৎ, সহীহ ও দুর্বল হাদীস সম্পর্কে অবগতি অর্জন করা ।
আরও জানো : সনদ ও মতন: অর্থ, সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও উদাহরণ সহ বিস্তারিত
উসুলুল হাদিস এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ :
উসূলুল হাদিসের উৎপত্তি ও উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন-
১. কুরআনে এসেছে- يَايُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَأَ فَتَبَيَّنوا
২. হাদীস শরীফে এসেছে-
١- نَظَرَ اللَّهُ امْرَأَ سَمِعَ مِنَّا شَيْئًا فَبَلَغَهُ كَمَا سَمِعَهُ قَرُبَ مِبْلَغٍ أَوْعَى مِنْ سَامِعٍ
٢- فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهِ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ – وَرُبَّ حَامِلٍ فِقْهِ لَيْسَ بِفَقِيهٍ
আলোচ্য আয়াতে কারীমা ও হাদীসের ওপর বিশ্লেষণপূর্বক সাহাবায়ে কেরাম অন্যের কাছ থেকে হাদীস সংকলন ও গ্রহণের ক্ষেত্রে বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেন। তবে সাহাবীগণের সমসাময়িক যুগের বর্ণনাকারীগণের অধিকাংশই ضَابِطٌ ও عَادِلٌ ছিলেন এবং হাদীসের সনদ, মতন ও এতদসংক্রান্ত বিশুদ্ধতা ও ত্রুটি সম্পর্কে তাঁরা অবগত ছিলেন বিধায় হাদীসের যাচাইবাছাই প্রক্রিয়া নির্ধারণে উসূলে হাদীসের উদ্ভাবনে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তবে প্রচেষ্টা তখন থেকেই শুরু হয়েছে।
কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে ইলমে হাদীসের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের কারণে হাদীসের বিশুদ্ধতা ও দুর্বলতা নিরূপণে যখন সমস্যার উদ্রেক হয়, তখন হাদীস বর্ণনার হাকীকত, শর্তাবলি, প্রকারভেদ, আহকামাত, বর্ণনাকারীদের অবস্থা এবং তৎসংশ্লিষ্ট শর্তাবলি সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে এ সংক্রান্ত বিষয়ে পুস্তক প্রণয়নের আবশ্যকতা দেখা দেয়। ফলে এ ব্যাপারে অনেক প্রখ্যাত আলেম ও হাদীসবিশারদ এগিয়ে আসেন। যেমন-
১। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে উসুলে হাদীসের সংকলন ও বিকাশ : হাদীসের বিশুদ্ধতা ও দুর্বলতা নিরূপণ করে হাদীস সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা লাভ করার জন্য হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে তৎকালীন সময়ের প্রখ্যাত আলেম ও হাদীসবিশারদ কাযী আবু মুহাম্মদ হাসান ইবনে আবদুর রহমান ইবনে খাল্লাদ আর রামাহুরমুখি উসূলে হাদীস বিষয়ে المُحَدِّثُ الفَاصِلُ بَيْنَ الرَّاوِي وَالوَاعِي নামক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
তারই ধারাবাহিকতায় আৰু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ নিসাপুরী বিষয়ের ধারাবাহিকতা ছাড়াই বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বিষয়কে সংযোজিত করে مَعْرِفَةُ عُلُومِ الحَدِيثِ নামক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
২. হিজরী পঞ্চম শতাব্দীতে উসূলে হাদীসের বিকাশ : مَعْرِفَةُ الحَدِيثِ গ্রন্থে যেসব বিষয় বাদ পড়েছে, সেসব বিষয়ের উল্লেখসহ হিজরী পঞ্চম শতাব্দীতে আবু নুয়াইম আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ আল আসবাহানী উসূলে হাদীস সম্পর্কে المُسْتَخْرَجُ عَلَى مَعْرِفَةِ عُلُومِ الحَدِيثِ নামক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় আৰু বকর আহমদ ইবনে আলী ইবনে সাবেত আল খতীব আল বাগদাদী (র) উসূলে হাদীস বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসার জবাব সংবলিত দুটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। আর তা হলো-
١- الْكِفَايَةُ فِي عِلْمِ الرِّوَايَةِ
٢- الْجَامِعُ لِأَخْلَاقِ الرَّاوِي وَآدَابِ السَّامِعِ
৩। হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীতে উসুলে হাদীসের বিকাশ : কাযী আয়ায ইবনে মুসা হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীতে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে الإِلْمَاعُ إِلَى مَعْرِفَةِ أُصُولِ الرِّوَايَةِ وَتَقْيِيدِ السَّامِعِ নামক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। এটিতে উসূলে হাদীসের সব বিষয়কে শামিল করা হয়নি। এটা ছিল كَيْفِيَّةُ التَّحَمُّلِ وَالأَدَاءِ সংক্রান্ত একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ।
৪। হিজরী সপ্তম শতাব্দীতে উসূলে হাদীসের বিকাশ : হিজরী সপ্তম শতাব্দীতে প্রখ্যাত হাদীসবিশারদ ইবনুস সালাহ (র) عُلُومُ الحَدِيثِ নামক উসূলে হাদীস বিষয়ে একটি আধুনিক গ্রন্থ রচনা করেন, যা مُقَدِّمَةُ ابْنِ الصَّلاحِ নামে প্রসিদ্ধ ।
৫। হিজরী নবম শতাব্দীতে উসুলে হাদীসের বিকাশ : এ শতাব্দীতে আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী (র) تَدْرِيبُ الرَّاوِي فِي شَرْحِ تَقْرِيبِ النَّوَوِي নামক উসূলে হাদীসের ওপর আধুনিক আঙ্গিকে গ্রন্থ রচনা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আল্লামা হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (র) نُخْبَةُ الفِكْرِ فِي مُصْطَلَحِ أَهْلِ الأَثَرِ নামক উসূলে হাদীস বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এটি সংক্ষিপ্ত হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে স্থান পেয়েছে এবং গ্রন্থটি তারতীব অনুযায়ী লেখা হয়েছে।
৬। হিজরী একাদশ শতাব্দীতে উসুলে হাদীসের বিকাশ : হিজরী একাদশ শতাব্দীতে ওমর ইবনে মুহাম্মদ আল বাকুনী (র) الْمَنْظُومَةُ البِيقُونِيَّةُ নামক উসূলে হাদীসের ওপর একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। যা খুবই উপকারী গ্রন্থ হিসেবে তৎকালীন সময়ে প্রসিদ্ধিলাভ করেছে।
৭. হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীতে উসূলে হাদীসের বিকাশ : হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীতে মুহাম্মদ জামালুদ্দিন কাসেমী (র) قَوَاعِدُ التَّحْدِيثِ নামে উসূলে হাদীসের ওপর সর্বাধুনিক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।