মহানবী (স) ও তাঁর নবুয়তী জীবন সম্পর্কে জানা, বোঝা এবং সে অনুযায়ী কার্যপরিচালনার জন্য হাদীসের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যদিকে হাদীস পবিত্র কুরআন বোঝার পথকে সহজ করে দেয়, যা পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবেও অতি পরিচিত। কাজেই কুরআনের সাথে হাদীসের সম্পর্ক অতি নিবিড়। নিম্নে এ সংক্রান্ত আলোচনা পেশ করা হলো ।
শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে হাদিসের গুরুত্ব :
শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস রাসূল (স)-এর মুখনিঃসৃত বাণী বা হাদীস। আর এ হাদিসের গুরুত্ব নিরূপণে পবিত্র কুরআন, হাদীস এবং বিভিন্ন মনীষী যে মতামত ব্যক্ত করেছেন নিম্নে তা উপস্থাপন করা হলো-
১. কুরআনের দৃষ্টিতে হাদিসের গুরুত্ব : মহাগ্রন্থ আল কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হাদিসের গুরুত্বের কথা বর্ণনা করেছেন এবং এর অনুকরণ ও অনুসরণকে মানুষের জন্য অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছেন। কখনো কখনো রাসূল (স)-এর অনুসরণকেই আল্লাহ তায়ালার অনুসরণের জন্য যথেষ্ট বলে ঘোষণা করেছেন। যেমন কুরআনে এসেছে-
وَمَا أَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
অর্থাৎ, আর রাসূল (স) তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন, তা ধারণ কর এবং তিনি যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর আর আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বশীলদের।
আরো জানো : হাদিস সংকলনের ইতিহাস বিস্তারিত – pdf
২. রাসূলের দৃষ্টিতে হাদিসের গুরুত্ব : রাসূল (স) মানুষের হেদায়াতের জন্য কুরআনের পাশাপাশি হাদীসের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। যেমন বিদায় হজ্জে রাসূল (স) ইরশাদ করেন-
تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ رَسُولِهِ
অর্থাৎ, আমি তোমাদের নিকট এমন দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ পর্যন্ত তা তোমরা দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে কখনো বিভ্রান্ত হবে না; আর বিষয় দুটি হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের হাদীস। এখানে হেদায়াতের মাধ্যম হিসেবে রাসূল (স) হাদীসের ওপর কুরআনের মতোই গুরুত্বারোপ করেছেন। এছাড়া অন্যান্য হাদীসেও এর গুরুত্ব পাওয়া যায়। যেমন রাসূল (স) বলেন-
مَنْ أَحَبَّ سُنَّتِي فَقَدْ أَحَبَّنِي وَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي
৩. শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস : শরীয়তের দৃষ্টিতে পবিত্র কুরআনের পরই হাদীসের স্থান। সুতরাং শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম। আর হেদায়াতের উৎস মহাগ্রন্থ আল কুরআনের নির্যাস হলো হাদীস ৷ কারণ হাদীস হচ্ছে মহান আল্লাহর পরোক্ষ বাণী । এ সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে-
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ
অর্থাৎ, রাসূল (স) নিজ প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না; বরং তাঁর নিকট প্রেরিত অহী ছাড়া এসব আর কিছুই নয় । সুতরাং হাদীসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য ।
আরো জানো : হাদিস বর্ণনাকারীর স্তর কয়টি ?বেশি হাদিস বর্ণনাকারী ৭ সাহাবী
৪. কুরআনের ব্যাখ্যা : মূলত রাসূল (স)-এর অমিয় বাণী আল হাদীস হলো মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ব্যাখ্যা। যেমন- নামায আদায়ের কথা কুরআনে বলা হলেও এর বিস্তারিত আলোচনা হাদীসেই পাওয়া যায়।
৫. পরকালে নাজাতের মাধ্যম : রাসূল (স)-এর হাদীসের ওপর আমল পরকালে নাজাত পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। কারণ হাদীসের মাধ্যমে শরীয়তের যাবতীয় বিধান তথা হালাল হারাম, আদেশ নিষেধ, ভালো মন্দ ইত্যাদির সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায় ৷ ফলে তদনুযায়ী আমলের মাধ্যমে পরকালে জান্নাতলাভ সহজ হয় ।
৬. নবী জীবনের খতিয়ান : হাদীসে রাসূল (স)-এর কথা, কাজ, কোনো ব্যাপারে মৌনসম্মতি, আদেশ নিষেধ ইত্যাদি বিষয়ে অত্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় । এদিক থেকে চিন্তা করলে মূলত হাদীসের মধ্যে আমরা রাসূলের জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই। সুতরাং রাসূলের জীবনের খতিয়ান বা প্রতিচ্ছবি হিসেবে হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম।
৭. হেদায়াতলাভের মাধ্যম : হাদীস হলো হেদায়াতলাভের অন্যতম মাধ্যম। এ সম্পর্কে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র) বলেন, হাদীস অন্ধকারের মধ্যে আলোকবর্তিকাস্বরূপ, এটা সর্বদিক উজ্জ্বলকারী পূর্ণচন্দ্র। সুতরাং যে হাদীসের অনুসারী হবে, সে হেদায়াত লাভ করবে।
আরো জানো : সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী- নাম, হাদিস সংখ্যা ও অবদান
৮. কুরআন বোঝার সহায়ক : মূলত হাদীস কুরআন বোঝার সহায়ক এবং ক্ষেত্রবিশেষে পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যায় হাদীসের সহায়তা অনিবার্য হয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন নীতিকে বাস্তবে রূপায়ণ করা হয়েছে।
৯. কুরআনের পরই হাদীসের স্থান : পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতে এবং হাদীসে কুরআনের পরই হাদীসের স্থান দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ইসলামের খ্যাতিমান মনীষীগণও একমত ।
কুরআনের সাথে হাদিসের সম্পর্ক :
কুরআনের সাথে হাদীসের সুগভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। নিম্নে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের মধ্যকার সম্পর্ক উপস্থাপন করা হলো-
১. এক ও অভিন্ন উৎস : মূলত মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদীস একই উৎস থেকে উৎকলিত। এটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি অবতীর্ণ, যা প্রত্যক্ষ অহী হিসেবে সমাদৃত; আর অন্যটি পরোক্ষ অহী হিসেবে স্বীকৃত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ
অর্থাৎ, মহানবী (স) নিজ খেয়াল খুশিমতো কোনো কিছুই বলেন না; বরং তাঁর নিকট প্রেরিত বিষয়গুলো অহী ছাড়া আর কিছুই নয় ।
২. উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের অভিন্নতা : উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের অভিন্নতা মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদীসের সম্পর্কের এক অন্যতম দিক। উভয়েরই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করা, যাতে মানবসমাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। আর এজন্যই মহানবী (স) বিদায় হজ্জে কুরআন ও হাদীসের কথা উল্লেখ করেছেন ।
৩. হাদীস কুরআনের প্রতিচ্ছবি : প্রকৃতপক্ষে হাদীস হলো আল কুরআনের প্রতিচ্ছবি। পবিত্র কুরআনের গুরুগম্ভীর, মৌলিক ও তাত্ত্বিক কথাই বিস্তারিতভাবে হাদীসে ফুটে উঠেছে ।
৪. পারস্পরিক সুসম্পর্ক : মূলত কুরআন ও হাদীসের মাঝে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বিদ্যমান। হাদীস কুরআন মাজীদের ব্যাখ্যাকারী। এদিক থেকে কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে হাদীসের গুরুত্ব যেমন অনস্বীকার্য তেমনি কুরআন ছাড়াও হাদীস মূল্যহীন। তাই একের সাথে অপরের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ।
৫. বিধানগত সম্পর্ক : কুরআন ও হাদীস একই বিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ভালো মন্দ, হালাল হারাম, আদেশ নিষেধ ইত্যাদি যাবতীয় বিধান নিয়ে উভয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। যেমন রাসূল (স)-এর এমন কোনো হাদীস পাওয়া যাবে না, যা কুরআনের বিধানের পরিপন্থি।
৬. প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে : দুনিয়ার সফলতা ও আখেরাতের মুক্তির জন্য উভয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কুরআনকে বাদ দিয়ে যেমন কেউ সঠিক পথে থাকতে পারে না, তেমনি হাদীসকে ছেড়েও কেউ হেদায়াত পেতে পারে না। তাই উভয়ের প্রয়োজন অপরিহার্য।
৭. মূল ও শাখা : পবিত্র কুরআনকে মূল হিসেবে সাব্যস্ত করলে হাদীসকে শাখা হিসেবে ধরতে হবে। মূলত উভয়ের মধ্যে মূল ও শাখার সম্পর্ক। যেমন কুরআনে যাকাতের কথা থাকলেও এর পরিমাণ, প্রদানের সময় ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা হাদীসেই পাওয়া যায়।
৮. উভয়ের অমান্যকারী কাফের : কুরআন ও হাদীস উভয়ের অমান্যকারী কাফের। শরীয়তের এ হুকুম উভয়ের মধ্যকার সুগভীর সম্পর্ককে আরো সুস্পষ্ট করে তোলে।
৯. কুরআনের পরই হাদীসের স্থান : মূলত আল কুরআনের পরই হাদীসের স্থান। অন্যদিকে হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যা। হাদীসের মাধ্যমে আমরা কুরআনকে সহজ সরল ও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। তাই একের সাথে অপরের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পরিশেষে : মূলত সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবন পরিচালনার জন্য হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম। হাদীসের জ্ঞান ব্যতিরেকে কুরআন বোঝা অসম্ভব; আল কুরআন ব্যতীত হাদীস মূল্যহীন। সুতরাং একের সাথে অন্যের সম্পর্ক সুনিবিড়।