ফিকহশাস্ত্রের ইতিহাসে যেসব ব্যক্তিত্ব এ ধরায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে আল্লামা আবুল হোসাইন কুদুরী (র) অন্যতম। তাঁর রচিত ‘মুখতাসারুল কুদূরী’ শীর্ষক ফিকহ গ্রন্থটি সর্বযুগের আলেমগণের নিকট একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত ও প্রশংসনীয় হয়েছে। ফিকহশাস্ত্রে তাঁর এ অসামান্য অবদানের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। নিম্নে এ মহামনীষীর জীবনালেখ্য, তাঁর রচিত কুদূরী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য ও নামকরণের কারণ আলোচনা করা হলো ।
আল্লামা আবুল হোসাইন কুদূরীর গ্রন্থ প্রণেতার জীবনী :
১. নাম ও বংশ পরিচয় : তাঁর নাম আহমদ। উপনাম আবুল হোসাইন। পিতার নাম মুহাম্মদ। পুরো নাম আবুল হোসাইন আহমদ ইবনে আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে জাফর ইবনে হামাদান আল বাগদাদী আল কুদূরী। তবে কুদূরী নামে তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন।
২. মাযহাবী পরিচয় : তিনি হানাফী ফিকহ সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন। হানাফী ফিকহ ও তার মূলনীতি প্রসঙ্গে তিনি প্রচুর গবেষণা করেন এবং এ শাস্ত্রের একজন ইমামরূপে আখ্যায়িত হন। এজন্য তাঁকে الفقيه الحنفي বলা হতো ।
৩. জন্ম ও শৈশবকাল : তিনি বাগদাদের উপকণ্ঠে এক জনাকীর্ণ পল্লীতে ৩৬২ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই শৈশবকাল অতিবাহিত করে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন । এজন্যই তাঁকে বাগদাদী বলা হয়।
আরো পড়ুন : ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর জীবনী ও ফিকহে শাফেয়ীর বৈশিষ্ট্যাবলি-pdf
৪. উচ্চশিক্ষা গ্রহণ : প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি তৎকালীন খ্যাতিমান ফকীহ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া আল জুরজানীর সাহচর্যে গমন করেন এবং তাঁর নিকট ইলমে তাফসীর, হাদীস এবং ফিকহশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। অতঃপর ইমাম কুদূরী পাঁচটি মাধ্যমে ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী (র) থেকে ইলমে ফিকহের গভীর জ্ঞান লাভ করেন।
৫. কর্মজীবন : তিনি ইলমে ফিকহ ও উসূলে ফিকহে অসাধারণ জ্ঞান লাভ করে এ দুটি শাস্ত্র শিক্ষাদান ও গ্রন্থ রচনায় স্বীয় জীবন উৎসর্গ করেন।
৬. তাঁর রচনাবলি : ‘আল মুখতাসারুল কুদূরী’ তাঁর অমর কীর্তি। এছাড়াও তিনি নিন্মোক্ত গ্রন্থাবলি রচনা করেন-
ক. তাজরীদ : এটি সাত খণ্ডবিশিষ্ট অনন্য বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ। এতে হানাফী ও শাফেয়ীদের মতবিরোধপূর্ণ মাসয়ালাসমূহের বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং যুক্তি প্রমাণ দ্বারা হানাফী মতবাদকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
খ. মাসায়েলুল খিলাফ : এ গ্রন্থে ইমাম আবু হানীফা (র) ও তাঁর ছাত্রদের মাঝে বিভেদপূর্ণ মাসয়ালাসমূহের যৌক্তিক পর্যালোচনা করা হয়েছে।
গ. আততাকরীব : এতে দলীল প্রমাণসহ ইলমে ফিকহের মাসয়ালাসমূহের আলোচনা করা হয়েছে।
ঘ. শরহে মুখতাসারুল কারখী : এটি একটি বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ ।
ঙ. শরহে আদাবুল কাযী : এটা কোনো মূল গ্রন্থ নয়; বরং একটি বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখ্যাগ্রন্থ।
আরো পড়ুন : ইমাম মালেক রহঃ এর জীবনী – pdf
৭. ফিকহশাস্ত্রে তাঁর অবস্থান : তিনি পঞ্চম স্তরের ফকীহদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এ স্তরের ফকীহদেরকে ‘আসহাবে তারজীহ’ বলা হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ আলেম তাঁকে ইমাম কাযীখান (র)-এর সমপর্যায়ের গণ্য করে তৃতীয় স্তরের ফোকাহায়ে কেরামের অন্তর্ভুক্ত করেন। উমদাতুর রেয়ায়া গ্রন্থেও তাঁকে ‘আসহাবে তাখরীজ’ তথা তৃতীয় স্তরের ফোকাহায়ে কেরামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইরাকে হানাফী মাযহাবের বিস্তৃতি ইমাম কুদূরীর উল্লেখযোগ্য অবদান।
৮. গুণাবলি : তিনি সত্যবাদী, বিশ্বস্ত, আল্লাহভীরু ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সকল শ্রেণির মানুষ তাঁকে অত্যধিক শ্রদ্ধা ও ভক্তি করত ।
৯. ইন্তেকাল ও দাফন : আল্লামা কুদূরী (র) ৪২৮ হিজরীর ৬ রজব ৬৬ বছর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন। তাঁকে প্রথম বাগদাদের প্রধান সড়ক মোহনায় দরবে আবিখালফ নামক স্থানে সমাহিত করা হয়। পরে সেখান থেকে স্থানান্তরিত করে মহাত্মা আবু বকর আল খাওয়ারিজমীর পাশে কবরস্থ করা হয়।
কুদূরী নামকরণের কারণ :
গ্রন্থকার বাগদাদের ‘কুদূর’ নামক গ্রামে বসবাস করতেন বলে তাঁকে কুদূরী শব্দের সাথে সম্পৃক্ত করে কুদূরী বলা হতো। কারো কারো মতে, তাঁর পূর্বপুরুষের কেউ এ তথা হাঁড়ি পাতিলের ব্যবসায় করত বলে তাঁকে কুদূরী বলা হয়। তাঁর রচিত গ্রন্থকে মুখতাসারুল কুদূরী নামকরণ করা হয়েছে। এ নামকরণ যথার্থ ও যুক্তিযুক্ত হয়েছে।
আরো পড়ুন : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর জীবনী – pdf
কুদূরী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য :
কুদূরী গ্রন্থটি তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে যুগ যুগ ধরে ফোকাহায়ে কেরাম এবং সাধারণ জনগণের নিকট সমাদৃত হয়ে আসছে। এ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ-
১. রচনাকাল থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় হাজার বছরের অধিক সময় এ বরকতময় গ্রন্থটি দীনি মাদরাসাসমূহের পাঠ্য তালিকাভুক্ত রয়েছে। এতে প্রায় বারো হাজার জরুরি ফিকহী মাসায়েল সন্নিবেশিত হয়েছে।
২. ‘কাশফুয যুনূন’ গ্রন্থকার উল্লেখ করেছেন, অন্ততপক্ষে এটা তো আমাদের মানতেই হবে যে, এর অধ্যয়নকারীর ওপর গ্রন্থকারের তাকওয়া ও পবিত্রতার ছাপ অবশ্যই পড়বে।
৩. ‘আল জাওয়াহেরুল মাযিয়্যা’ গ্রন্থকার তাঁর ভাই মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে নাসরুল্লাহ ইবনে সালেম ইবনে আবিল ওয়াফা আল কারশী সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি এ গ্রন্থের হাফেয ছিলেন ।
অলৌকিক বৈশিষ্ট্য : আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (র) তাঁর রচিত ‘শরহে হেদায়া’ গ্রন্থে কুদূরী গ্রন্থকার সম্পর্কে এক অলৌকিক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, কুদূরী গ্রন্থকার গ্রন্থটি রচনা শেষে পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে হজ্জের সফরে যান। সেখানে তাওয়াফ শেষে আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করেন, “হে আল্লাহ! এ গ্রন্থে যদি কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে থাকে, তবে আমাকে তা অবগত করুন।” অতঃপর তিনি গ্রন্থটি আদ্যপ্রান্ত এক একটি পাতা উল্টিয়ে দেখলেন, পাঁচ অথবা ছয়টি স্থানে লিখিত বক্তব্য মুছে দেয়া আছে, যা ভুল ছিল। এটা নিঃসন্দেহে তাঁর কারামত ।
উপসংহার : মুখতাসারুল কুদূরী গ্রন্থটি সমগ্র মুসলিম মিল্লাতে ফিকহশাস্ত্রের এক অমূল্য রত্ন হিসেবে স্বীকৃত। আর এটি রচনা করে ইমাম কুদূরী (র) ফিকহশাস্ত্রে এক অতুলনীয় ও অপরিহার্য অধ্যায় সংযোজন করে গেছেন । যার সেবা বিশ্ববাসীকে সত্যিই ঋণী করেছে।
আরও পড়ুন : গোসল অর্থ কি?কত প্রকার।গোসলের ফরজ কয়টি।গোসল ফরজ হওয়ার কারণ