হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

সালোকসংশ্লেষণের গুরুত্ব পয়েন্ট আকারে ও প্রভাবক সমূহ

সালোকসংশ্লেষণের গুরুত্ব :

সালোকসংশ্লেষণ একটি জটিল জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সূর্যালোক ও জীবনের মধ্যে সেতুবন্ধনের সৃষ্টি হয়েছে । তাই এই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে এর গুরুত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো –

১। উদ্ভিদের জন্য খাদ্য প্রস্তুত : বাঁচতে হলে খাদ্যের প্রয়োজন। সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় এ খাদ্য প্রস্তুত করে থাকে । সবুজ উদ্ভিদ যদি খাদ্য প্রস্তুত করতে না পারত তবে পৃথিবীতে কোন উদ্ভিদই বাঁচতে পারত না।

২। প্রাণীকূলের জন্য খাদ্য সরবরাহ : আমরা মানুষ, নিজের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারি না। আমাদের প্রয়োজনীয় সকল খাদ্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবুজ উদ্ভিদ থেকে পেয়ে থাকি। আর যেহেতু সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তার খাদ্য প্রস্তুত করে, কাজেই পৃথিবীর সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর খাদ্য প্রস্তুত হয় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ।

৩। সৌরশক্তির বন্ধন : একমাত্র সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমেই সৌরশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত হয়ে খাদ্যের মধ্যে আবদ্ধ থাকে । সবুজ উদ্ভিদ ব্যতীত প্রাণীদের দ্বারা এই কাজ সম্ভব নয় ।

৪। CO2 এর শোষণ : সালোকসংশ্লেষণে যে CO2 অপরিহার্য তা জীবজগতের বিশেষ করে প্রাণীকূলের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বায়ুমন্ডলে এর আধিক্য মৃত্যুর সংকেত বয়ে আনে। আর একমাত্র সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায়ই বায়ুমন্ডল হতে এই ক্ষতিকর CO2 এর শোষণ ঘটে।

৫। অক্সিজেন উৎপাদন : সবুজ উদ্ভিদ যতক্ষণ সূর্যালোক পায়নি ততক্ষণ সালোকসংশ্লেষণ চালিয়ে 02 উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে ।

৬। বায়ুমন্ডলের শোধন : একদিকে CO2 অপসারণ, অন্যদিকে 02 সরবরাহ বজায় রেখে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বায়ুকে শোধন ও নির্মল করে।

৭। দৈহিক বৃদ্ধি : সালোকসংশ্লেষণের ফলে উদ্ভিদ দেহে খাদ্য সঞ্চিত হয়, ফলে দেহের বৃদ্ধি ঘটে।

৮। মানব সভ্যতা : সবুজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ হয় বলেই মানুষ বেঁচে আছে। কিন্তু এই বেঁচে থাকার বাইরেও মানব সভ্যতায় সালোকসংশ্লেষণের অবদান অসীম। কয়লা, পেট্রোল, রেয়ন, সেলোফেন, রাবার, কাগজ, ওষুধ-পথ্য সবকিছূই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার ফল।

সালোকসংশ্লেষণের প্রভাবক সমূহ :

অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মত সালোকসংশ্লেষণও কয়েকটি প্রভাবক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । প্রভাবকগুলোকে দুভাগে ভাগ করা হয়, যথা-ক. বাহ্যিক প্রভাবক ও খ. অভ্যন্তরীণ প্রভাবক।

ক. বাহ্যিক প্রভাবক

উদ্ভিদের দেহের বাইরের পরিবেশগত যেসব প্রভাবক সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে সেগুলো নিম্নরূপ :

১. আলো : আলো সালোকসংশ্লেষণের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। ক্লোরোফিল গঠনের জন্য আলে অপরিহার্য । আলোর প্রভাবে ক্লোরোফিল উত্তেজিত হয়ে পানির সালোকবিভাজন ঘটিয়ে সালোকসংশ্লেষণে সহায়তা করে। আলোর উপস্থিতিতে পত্ররন্ধ্র কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণের জন্য খোলা থাকে ।

সালোকসংশ্লেষণে উৎপন্ন শর্করায় যে শক্তি সঞ্চিত হয় তাও আলো থেকে আসে। আলোর তীব্রতার বৃদ্ধিতে সালোকসংশ্লেষণের হার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অতিরিক্ত তীব্র আলোতে সালোকসংশ্লেষণের হার হ্রাস পায়।আলোকরশ্মির সাত রঙীয় বর্ণালীর কেবল লাল, কমলা, নীল ও বেগুনী অংশ থেকে ফোটন নামক আলোককণা সালোকসংশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়। সালোকসংশ্লেষণের হার সরাসরি আলোর স্থায়িত্বকালের ওপর নির্ভলশীল।

২. কার্বন ডাইঅক্সাইড : কার্বন ডাইঅক্সাইড সালোকসংশ্লেষণের একটি মৌলিক কাঁচামাল। তাই কার্বন ডাইঅক্সাইড ছাড়া সালোকসংশ্লেষণ হয় না। অন্যান্য অবস্থা অনুকূল থাকলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের সরবরাহ বৃদ্ধিতে সালোকসংশ্লেষণের হারও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড বিষক্রিয়া দ্বারা সালোকসংশ্লেষণ হ্রাস করতে
পারে।

৩. তাপমাত্রা : প্রায় প্রতিটি উদ্ভিদের জন্য এমন একটি সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আছে যার বাইরে সালোকসংশ্লেষণ ব্যাহত হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫°সে.-এর নিম্ন এবং ৪৫°সে.-এর ঊর্ধ্ব তাপমাত্রায় সালোকসংশ্লেষণ হয় না।

সাধারণত ৩৫°সে. থেকে ৩৭°সে. তাপমাত্রা সালোকসংশ্লেষণের জন্য অনুকূল। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থেকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মধ্যে প্রতি ১০°সে. তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সালোকসংশ্লেষণের হার প্রায় ২.২-২.৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

৪. পানি : পানি সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার অপরিহার্য উপাদান । কারণ শর্করা তৈরির উদ্দেশ্যে CO2-কে বিজারণের জন্য প্রয়োজনীয় H2 আয়ন পানি থেকেই আসে। তবে উদ্ভিদ কর্তৃক শোষিত পানির খুব সামান্য অংশই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। তাই সালোকসংশ্লেষণের হারে হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পানির প্রভাব ততটা উল্লেখযোগ্য নয় ।

তবে অতিরিক্ত পানি ঘাটতির ফলে রক্ষীকোষের রসস্ফীতি কমে গিয়ে পত্ররন্ধ্র বন্ধ হলে সালোকসংশ্লেষণ একেবারেই বন্ধ হতে পারে । তাছাড়া অতিরিক্ত পানি ঘাটতির ফলে এনজাইমের সক্রিয়তা বিনষ্ট হয়েও সালোকসংশ্লেষণ বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে।

৫. অক্সিজেন : বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়লে সালোকসংশ্লেষণের হার কমে; অক্সিজেনের পরিমাণ কমলে সালোকসংশ্লেষণের হার বাড়ে। তবে অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে সালোকসংশ্লেষণ সম্পূর্ণভাবেই বন্ধ হয় ।

৬. খনিজ পদার্থ : ক্লোরোফিলের প্রধান উপকরণ হচ্ছে নাইট্রোজেন ও ম্যাগনেশিয়াম যা উদ্ভিদ লবণ হিসেবে গ্রহণ করে । লোহার অনুপস্থিতিতে আবার ক্লোরোফিল সংশ্লেষণ করতে পারে না। এদের অভাবে পাতা হলদে হয়ে যায় (যা ক্লোরোসিস নামে পরিচিত)। মাটিতে এসব খনিজের অভাব হলে সালোকসংশ্লেষণ হার কমে যায়।

৭. রাসায়নিক পদার্থ : বাতাসে ক্লোরোফরম, হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেন বা কোন বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ ব্যাঘাত ঘটে বা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

খ. অভ্যন্তরীণ প্রভাবক

নিম্নবর্ণিত অভ্যন্তরীণ প্রভাবক সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

১. ক্লোরোফিল : সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াটি ক্লোরোপ্লাস্টের অভ্যন্তরে ঘটে থাকে। বেশি হারে ক্লোরোফিলের উপস্থিতির অর্থ বেশি হারে সালোকসংশ্লেষণ। তবে কোষে খুব বেশি পরিমাণ ক্লোরোফিল থাকলে এনজাইমের অভাব দেখা দিতে পারে, তখন সালোকসংশ্লেষণ হ্রাস পায় ।

২. পাতার বয়স : নবীন এবং বয়স্ক পাতায় ক্লোরোফিল কম থাকে বলে সালোকসংশ্লেষণের হারও কম হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্লোরোপ্লাস্টের সংখ্যাও বাড়ে, ফলে সালোকসংশ্লেষণের হার বেড়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। মধ্যবয়সী পাতায় সবচেয়ে বেশি সালোকসংশ্লেষণ ঘটে ।

৩. পাতার অন্তর্গঠন : পত্ররন্ধ্রের সংখ্যা বেশি হলে গ্যাসের আদান-প্রদান বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া মেসোফিল কোষের বিন্যাস ও তার আকৃতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মেসোফিল কোষগুলোর মাঝে বায়ুকুঠুরী বেশি থাকলে CO2 গ্রহণ বেশি হয়।

৪. শর্করার পরিমাণ : কোষে উৎপাদিত শর্করা দ্রুত উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে পরিবাহিত হয়। সালোকসংশ্লেষণ চলাকালীন সময়ে শর্করার পরিবহন কম হলে তা সেখানে জমে থাকে। বিকেলে পাতায় বেশি শর্করা জমা হয় বলে সালোকসংশ্লেষণ গতি মন্থর হয়।

৫. এনজাইম : সালোকসংশ্লেষণের জন্য প্রচুর সংখ্যক এনজাইমের প্রয়োজন হয়। সংশ্লেষণ, ঘনত্ব, তাপমাত্রা, পানি, সাবস্ট্রেটের উপস্থিতি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে এনজাইমের কার্যপদ্ধতি। এর কোনো একটির তারতম্য ঘটলে সালোকসংশ্লেষণের গতি কম-বেশি হয়ে থাকে ।

Leave a Comment