নিষেকের পূর্বশর্ত হলো স্ত্রী ও পুং উভয় জননকোষের পূর্ণতা প্রাপ্তি । নিষেক প্রক্রিয়া বিশেষভাবে নির্দিষ্ট। কেবলমাত্র একই প্রজাতির পরিণত শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মধ্যে এটি সংঘটিত হয়। এটি সাধারণত অপরিবর্তনশীল। একবার নিষিক্ত হলে পুনরায় আর নিষিক্ত করা যায় না।
নিষেক কাকে বলে?
যৌন প্রজননের জন্য নিষেক প্রয়োজন। এটি একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। যৌন প্রজননে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনকে নিষেক বলে।
নিষেকের প্রকারভেদ :
নিষেক প্রধানত ২প্রকার। যথা –
১. বহিঃনিষেক (External Fertilization)
২. অন্তঃনিষেক (Internal Fertilization)।
বহিঃনিষেক : যে নিষেক ক্রিয়া প্রাণিদেহের বাহিরে সংঘটিত হয় তাকে বহিঃনিষেক বলা হয় । সাধারণত যে সকল প্রাণী পানিতে বসবাস করে এমন সব প্রাণীর মধ্যেই এ ধরনের নিষেক সীমাবদ্ধ। যেমন- বিভিন্ন ধরনের মাছ। তবে এর ব্যতিক্রম ও রয়েছে, যেমন- হাঙ্গর এবং কয়েক প্রজাতির মাছ।
আরও পড়ুন : প্রজনন, যৌন ও অযৌন জনন সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, পার্থক্য
অন্তঃনিষেক : স্ত্রী দেহের জননাঙ্গে যে নিষেক ক্রিয়া সংঘটিত হয় তাকে অন্তঃনিষেক বলা হয় । সাধারণত মিলনের মাধ্যমে পুরুষ প্রাণীটি তার শুক্রাণু স্ত্রী জননাঙ্গে প্রবেশ করিয়ে এ ধরনের নিষেক ঘটায়। ডাঙায় বসবাসকারী যে সকল প্রাণী রয়েছে তাদের অধিকাংশ প্রাণীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অন্তঃনিষেক ।
নিষেকের গুরুত্ব :
জীবজগতে নিষেক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জৈবনিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় পুং ও স্ত্রীগ্যামেটের মিলন ঘটে এবং গ্যামেট দুটোর সাইটোপ্লাজম ও নিউক্লিয়াসের সংযুক্তি ঘটে। নিষেকের ফলে হ্যাপ্লয়েড গ্যামেটের মিলনের ফলে ডিপ্লয়েড জাইগোট তৈরি হয় এবং জাইগোট ভ্রূণ উৎপন্ন করে।
ভ্রূণের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য নিষিক্ত ডিম্বাণুতে আমিষ সংশ্লেষণ ও বিপাকীয় কার্যবলি বৃদ্ধি পায়। নিষেকের মাধ্যমে প্রজাতিতে জিনের সংমিশ্রণ ঘটে। এর ফলে নতুন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাতের সৃষ্টি হয় যা বিবর্তনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়।
নিষেকের ফলে ডিম্বক বীজে পরিণত হয় এবং গর্ভাশয় ফলে রূপান্তরিত হয়। বীজ উদ্ভিদের বংশ রক্ষা করে। এ বীজ সৃষ্টি না হলে অনেক সপুষ্পক উদ্ভিদই হয়ত বিলুপ্ত হয়ে যেত। উদ্ভিদের ফল ও বীজ প্রাণিকুলের খাদ্য যোগায়। বিশেষ করে মানুষ খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের ফল ও বীজের উপর নির্ভরশীল।
আরও পড়ুন : অঙ্গজ প্রজনন কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি উদাহরণ সহ
এজন্য নিষেক উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও প্রাণিকুল ও মানুষের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। নিষেক ক্রিয়া না ঘটলে উদ্ভিদ হ্যাপ্লয়েড অবস্থা থেকে ডিপ্লয়েড অবস্থায় ফিরে আসতে পারত না। হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ অনুর্বর বলে উদ্ভিদের বিলুপ্তির সম্ভাবনা দেখা দিত।
নিষেকের তাৎপর্য :
নিষেকের ফলে ফুলের গর্ভাশয় ফলে পরিণত হয় এবং ডিম্বকসমূহ বীজ-এ পরিণত হয় । বীজ উদ্ভিদের বংশ রক্ষা করে এবং বংশ বৃদ্ধি করে। বীজের সৃষ্টি না হলে হয়ত উদ্ভিদকূল বিলীন হয়ে যেত। অন্যভাবে বলা যায়, নিষেক না ঘটলে উদ্ভিদকূল বিলীন হয়ে যেত।
আবার উদ্ভিদের ফল এবং বীজ খেয়ে প্রাণিকূল বিশেষ করে মানবজাতি বেঁচে আছে। নিষেক না ঘটলে ফল এবং বীজের সৃষ্টি হত না। ফলে খাদ্যের অভাবে প্রাণিকূল বিশেষ করে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যেত। কাজেই নিষেক ক্রিয়ার তাৎপর্য অপরিসীম ।
নিষেক ক্রিয়া : আকার-আকৃতি ও প্রকৃতিগত পার্থক্যমণ্ডিত একটি পুংগ্যামেট যখন একটি স্ত্রীগ্যামেট এর সাথে মিলন ঘটে তখন এ প্রক্রিয়াকে নিষেক ক্রিয়া বা গর্ভাধান বলে।
নিষেক প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা :
i. গর্ভমুণ্ডে পরাগরেণুর অঙ্কুরোদগম : পরাগরেণু যখন উপযুক্ত গর্ভমুণ্ডে পতিত তখন সেখান থেকে তরল পদার্থ শোষণ করে আকারে বড় হয় ও অঙ্কুরিত হয়। অর্থাৎ পরাগরেণুর অভ্যন্তরে যে পাতলা প্রাচীর রয়েছে তা প্রসারিত হয়ে রন্ধ্রপথে নলরূপে বেরিয়ে আসে ।
ii. পরাগনালিকার গর্ভাশয়মুখী যাত্রা ও শুক্রাণু সৃষ্টি : পরাগনালিকাটি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে গর্ভমুণ্ড হতে গর্ভদণ্ডের ভিতরের দিক দিয়ে গর্ভাশয় পর্যন্ত পৌঁছায় এবং গর্ভাশয়ের যে স্তর রয়েছে সেটি ভেদ করে ডিম্বক পর্যন্ত পৌঁছে। ইতোমধ্যে পরাগনালিকার অভ্যন্তরে অবস্থিত জনন নিউক্লিয়াসটি মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় দুটি পুংগ্যামেট বা শুক্রাণু সৃষ্টি করে ।
পরাগনালিকাটি অধিকাংশ উদ্ভিদেই ডিম্বকরন্ধ্র পথে ডিম্বকে প্রবেশ করে (ব্যতিক্রম Casuarina-ঝাউ, এরা ডিম্বকমূল দিয়ে প্রবেশ করে)। সাধারণত শুক্রাণুসহ একটি মাত্র নালিকাই ডিম্বকে প্রবেশ করে।
আরও পড়ুন : পার্থেনোজেনেসিস সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, উদাহরণ, গুরুত্ব
iii. পরাগনালিকার ডিম্বকস্থ ভ্রূণথলিতে প্রবেশ ও শুক্রাণু নিক্ষিপ্তকরণ : পরাগনালিকা ডিম্বকে প্রবেশের পাশাপাশি ডিম্বকে অবস্থিত স্ত্রীরেণু হতে ডিম্বাণু সৃষ্টি হয়। ডিম্বাণু ভ্রূণথলিতে অবস্থান করে এবং পরাগনালিকা ভ্রূণথলিতে প্রবেশের পর সহকারী কোষের মাধ্যমে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছে। অবশেষে পরাগনালিকার অগ্রভাগ প্রসারিত হয়ে ফেটে পুংগ্যামেট ভ্রূণথলিতে নিক্ষিপ্ত হয়।
iv. ভ্রূণথলিতে ডিম্বাণু এবং গৌণ নিউক্লিয়াসের সাথে শুক্রাণুর মিলন : পরাগনালিকা হতে ভ্রূণথলিতে নিক্ষিপ্ত দুটি পুংগ্যামেটের একটি ডিম্বাণুর সাথে মিলিত ও একীভূত হয়ে যায় অর্থাৎ নিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন করে। এ ধরনের মিলনকে সিনগ্যামী বলে। নিষেকের ফলে ডিপ্লয়েড (2n) জাইগোট উৎপন্ন হয়। অপর পুংগ্যামেটটি সেকেন্ডারি নিউক্লিয়াসের সাথে মিলিত ও একীভূত হয় অর্থাৎ ত্রিমিলন ঘটায়।
দ্বি-নিষেক :
সংজ্ঞা : একই সময়ে ডিম্বাণুর সাথে একটি পুংগ্যামেটের মিলন ও সেকেন্ডারি নিউক্লিয়াসের সাথে অপর পুংগ্যামেটের মিলন প্রক্রিয়াকে দ্বি-নিষেক বলে।
এক্ষেত্রে একটি পুংগ্যামেট ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয় এবং অপর একটি পুংগ্যামেট সেকেন্ডারি নিউক্লিয়াসের সাথে মিলিত হওয়ার ফলে ডিম্বাণু জাইগোটে (2n) পরিণত হয়। কিন্তু সেকেন্ডারি নিউক্লিয়াস ট্রিপ্লয়েড (3n) অবস্থাপ্রাপ্ত হয়। নিষেক ক্রিয়া সম্পন্নের পর বিভিন্ন ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে ডিম্বাশয় ফল ও ডিম্বক ত্বকে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন : ডিম্বক কাকে বলে?কত প্রকার ও কি কি এবং ডিম্বকের গঠন
নিষেক ও দ্বিনিষেক পার্থক্য :
নিষেক ক্রিয়া | দ্বি-নিষেক ক্রিয়া |
---|---|
১. স্ত্রীগ্যামেট তথা ডিম্বাণুর সাথে একটি পুংগ্যামেটের যৌন মিলনকে নিষেক ক্রিয়া বলা হয়। | ১. প্রায় একই সময়ে একটি পুংগ্যামেট ডিম্বাণুর সাথে এবং অপর একটি পুংগ্যামেট গৌণ নিউক্লিয়াসের সাথে মিলিত হওয়াকে দ্বি-নিষেক বলা হয়। |
২. নিসেক আবৃতবীজী উদ্ভিদ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। | ২. দ্বি-নিষেক কেবল আবৃতবীজী উদ্ভিদে হয়। |
৩. একটি পুংগ্যামেটের প্রয়োজন হয়। | ৩. দুইটি পুংগ্যামেটের প্রয়োজন হয়। |
৪. নিষেকের ফলে কেবল ভ্রূণের (জাইগোট) সৃষ্টি হয়। | ৪. দ্বি-নিষেকের ফলে একদিকে ভ্রূণ ও অপরদিকে এন্ডোস্পার্ম সৃষ্টি হয়। |