নবী রাসূলগণের পর রাসূলুল্লাহ (স)-এর সাহাবীগণ ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ ও দীনের অকুতোভয় সৈনিক। তাঁদের মাধ্যমেই দিক দিগন্তে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেছে। এমনকি তাঁদের মর্যাদা, সফলতা কুরআন হাদীস ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা প্রমাণিত।
সাহাবা এর আভিধানিক অর্থ :
صَحَابَةٌ শব্দটি একবচন, বহুবচনে أَصْحَابٌ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো— সঙ্গী, সাথী, বন্ধু, অনুসারী, সহচর ইত্যাদি।
সাহাবা কাকে বলে ?
যারা রাসূল (সাঃ)কে স্বচক্ষে দেখেছেন, তিনাকে অনুসরণ করছেন, তিনাকে অনুকরণ করে সারাটি জীবন ইসলামের পথে পার করেছেন তাদেরকেই সাহাবী বলা হয়।
আরো : সাহাবা অর্থ কি?সংজ্ঞা, আখলাক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা :
আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মূলভিত্তিই হলো রাসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাহ ও সাহাবীগণের অনুসরণ। তাঁরা ছিলেন নবী রাসূলগণের পর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। কুরআন ও হাদীসের আলোকে সাহাবীগণের আকাশ ছোয়া মর্যাদা পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
ক. পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে সাহাবীগণের মর্যাদা : পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে সাহাবীদের মর্যাদার উপস্থাপনপূর্বক মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي অর্থাৎ, তাদের এ বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে।
এতে বোঝা যায়, উম্মতে মুহাম্মাদীর শ্রেষ্ঠ সাহাবীগণ ছিলেন সকল নবীর উম্মতদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাঁদের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে হাজার বছর পূর্বে আলোকপাত করা হয়েছে।
আরো : সাহাবা কারা? তাদের পরিচয় ও তাদের সমালোচনা করার বিধান
খ. আল কুরআনে সাহাবীগণের মর্যাদা : মহাগ্রন্থ আল কুরআনে সাহাবীগণের মর্যাদা নিম্নোক্ত পন্থায় আলোকপাত করা হয়েছে। যথা-
১. সাহাবীগণের আত্মোৎসর্গের পরিচয় : পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন স্থানে সাহাবীগণের প্রশংসা এবং আত্মত্যাগের কথা উপস্থাপনপূর্বক তাঁদেরকে জান্নাতের শুভ সংবাদ প্রদান করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-
لَا يَسْتَوِي مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الفَتْحِ وَقَاتَلَ – أُولَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الَّذِينَ أَنْفَقُوا مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلُوا، وَكُلًّا وَعَدَ اللهُ الحُسْنَى۔
অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়। তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের চেয়ে যারা পরবর্তীকালে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে। তবে আল্লাহ উভয়কে কল্যাণের (জান্নাতের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ।
২. আল কুরআনে সকল সাহাবীর প্রশংসা : রাসূলুল্লাহ (স)-এর সকল সাহাবীর প্রশংসা করতঃ তাঁদের ধার্মিকতা, সততা ও বিশ্বস্ততার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেন-
وَلَكِنَّ اللهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ، أُولَئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ
অর্থাৎ, কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তাকে তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করেছেন। তিনি কুফরী, পাপ ও অবাধ্যতাকে তোমাদের নিকট অপ্রিয় করেছেন। তারাই সৎপথ অবলম্বনকারী ।
৩. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের ঘোষণা : বিশেষত প্রথম অগ্রবর্তী মুহাজির ও আনসারগণের নিষ্ঠার কথা বর্ণনাপূর্বক তাঁদেরকে জান্নাতের শুভ সংবাদ প্রদান করেন। যেমন আল কুরআনের বাণী-
وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ، أَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا، ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
আরো : পৃথিবীতে ও আখেরাতে আল্লাহকে দেখা সম্ভব কিনা? দলিল সহ
৪. বিশেষ কিছু সাহাবীদের জান্নাতের সংবাদ : বাইয়াতুর রিদওয়ান ও তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণকে জান্নাতের বিষয়ে সুস্পষ্ট সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহর বাণী-
لَكِنَّ الرَّسُولَ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ جَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ، وَأُولَئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ، وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
৫. ইবাদত বন্দেগির বর্ণনা : সাহাবীগণ প্রতিটি মুহূর্তই মহান আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন এবং রুকু, সেজদার মাধ্যমে নিষ্ঠার সাথে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন। যেমন পবিত্র কুরআনে এসেছে-
وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجُودًا وَقِيَامًا
৬. চেহারায় ইবাদতের নিদর্শন : আল্লাহর প্রিয় বান্দা সাহাবীগণের রুকু, সেজদা, অযু ইত্যাদি ইবাদতের চিহ্ন তাঁদের চেহারা মোবারকে ফুটে ওঠেছে। আমলের প্রভাব তথা নূরে তাঁদের চেহারা আলোকিত ছিল । আল্লাহ তায়ালা (গ) এমমে বলেন-
سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ
৭. সাহাবীগণের ইখলাস : সাহাবীগণের ঈমান, ইবাদত ও তাবলীগে কোনো কুফর, নেফাক, লৌকিকতা ছিল না। তারা সকল কর্ম, দান, ইবাদত একমাত্র আল্লাহর চূড়ান্ত সন্তুষ্টির জন্য করেছিলেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا
৮. অন্যায়ের প্রতি কঠোর ও সত্যের প্রতি দুর্বল : ইসলামের শত্রুগণের কুফরীর মোকাবেলায় তাঁরা ছিলেন আপসহীন ও বজ্রকঠোর এবং সত্যের নিকট তারা ছিলেন দুর্বল। সাথিগণের প্রতি উদার ও রহমতস্বরূপ। সকল ক্ষেত্রে অন্য ভাইয়ের সাথে আন্তরিকতা ও অগ্রাধিকার প্রদানের অনুকরণীয় আদর্শ ছিলেন সাহাবীগণ। যেমন মহান আল্লাহর বাণী-
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ۔
গ. হাদীসের আলোকে সাহাবীগণের মর্যাদা : অসংখ্য হাদীসে সাহাবীগণের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে এবং জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। নিম্নে তার কিছু উল্লেখ করা হলো-
১. সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত : ওমর ইবনে খাত্তাব (রা ) বলেছেন, রাসূল (সা )বলেন-
الْكَرِيمُو أَصْحَابِي (فَإِنَّهُمْ خِيَارُكُمْ)، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ يَظْهَرُ الْكِذَّبُ۔
অর্থাৎ, তোমরা আমার সাহাবীগণকে সম্মান করবে। কারণ তাঁরাই তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। অতঃপর তাঁদের পরে তাদের পরবর্তীগণ এরপর তাঁদের পরবর্তীগণ অতঃপর মিথ্যা বিকাশ লাভ করবে।
২. আমানতদার : রাসূল (স) সাহাবায়ে কেরামের নিকট রেখে গেছেন দীনের আমানত। তাঁরা তাঁদের আমানত যথাযথভাবে পালন করেছিলেন। যেমন হাদীসে এসেছে – أَصْحَابِي أَمَانَةٌ لِأُمَّتِي
৩. মুজতাবা তথা নির্বাচিত : তাঁদেরকে আল্লাহ বিশেষভাবে নির্বাচিত করেছেন স্বীয় দীন ও রাসূল (স)-কে সাহায্য করার জন্য। যেমন ইবনে মাসউদ (রা) বলেন-
فَاخْتَارَهُمُ اللَّهُ لِصَحْبَةِ نَبِبِهِ وَنَصْرَةِ دِينِهِ –
৪. জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবী : অহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (স) তাঁর দশ জন সাহাবীকে বেহেশতের সুসংবাদ প্রদানপূর্বক ঘোষণা করেছেন-
أَبُو بَكْرٍ فِي الْجَنَّةِ، وَعُمَرُ فِي الْجَنَّةِ، وَعُثْمَانُ فِي الْجَنَّةِ، وَعَلِيٌّ فِي الْجَنَّةِ، وَطَلْحَةُ فِي الْجَنَّةِ، وَالزُّبَيْرُ فِي الْجَنَّةِ، وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ عَوْفٍ فِي الْجَنَّةِ، وَسَعْدُ بْنُ أَبِي وَقَّاصٍ فِي الْجَنَّةِ، وَسَعِيدُ بْنُ الزُّبَيْرِ فِي الْجَنَّةِ، وَأَبُو عُبَيْدَةَ ابْنُ الجَرَّاحِ فِي الْجَنَّةِ।