হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

তাওহীদের পরিচয়, গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা

তাওহীদ ইসলামী জীবনব্যবস্থার মূলভিত্তি। ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করা এবং তদনুযায়ী জীবন পরিচালিত করার জন্য তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস অপরিহার্য। নিম্নে তাওহীদের পরিচয় , গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হলো :

তাওহীদের পরিচয় :

تَوْحِيد (তাওহীদ ) শব্দটি اِسْمُ مَصْدَرٍ, বাবে تَفْعِيل; এটি و-ح-د মূলধাতু থেকে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ হলো — একত্ববাদ, কাউকে একক বলে স্বীকার করা। এটা শিরক-এর বিপরীত।

তবে অভিধানবেত্তাগণ তাওহীদ শব্দের আভিধানিক অর্থ নির্ণয়ে কয়েকটি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন-

১। আবদুল আযীয ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে বায (র) বলেন, তাওহীদ হলো- কোনো জিনিসকে একক সাব্যস্ত করা।

২। আল মুজামুল ওয়াসীত গ্রন্থকার বলেন- আল্লাহ তায়ালার কোনো শরীক নেই, তিনি এক এমর্মে তাঁর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার নামই তাওহীদ।

৩। মুফতি আমিনুল ইহসান (র ) বলেন ٱلْحُكْمُ بِأَنَّ ٱلشَّيْءَ وَاحِدٌ

৪। দর্শনশাস্ত্রে তাওহীদ হলো এক উপাসকের কথা বলা।

৫। কারো কারো মতে শব্দটি অতুলনীয় হওয়া, একত্ববাদের ঘোষণা দেওয়া, একত্ববাদের বিশ্বাস করা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার হয়।

৬। কেউ কেউ বলেন إِفْرَادُ ٱلْقَدِيمِ عَنِ ٱلْمُحْدَثِ

সংজ্ঞা : আল্লাহর সত্তা, গুণাবলি ও কর্মের সাথে কারো সামঞ্জস্য ও সমতাকে অস্বীকার করা এবং তাঁর প্রভুত্ব ও ইবাদতের ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের অংশীদারত্ব থেকে বিরত থাকাকে তাওহীদ বলা হয় ।

আরো পড়ুন : তাওহীদ শব্দের অর্থ কি? কাকে বলে। কত প্রকার ও কি কি

তাওহীদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা :

মানবজীবনে তাওহীদের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে এর কতিপয় দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো-

১. তাওহীদ ঈমানের মূলভিত্তি : ঈমানের মূলভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ। শুধু আল্লাহকে বিশ্বাসের মাধ্যমে মুমিন হওয়া সম্ভব নয়; বরং এর জন্য প্রয়োজন আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় বলে স্বীকার করা। আল্লাহকে স্বীকার করে তাঁর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করার নাম ঈমান হতে পারে না; বরং এটি শিরক।

২. তাওহীদ ইসলামের প্রথম ও শেষ মঞ্জিল : তাওহীদ হচ্ছে ইসলামী বিশ্বাসের মূলভিত্তি। হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে সকল নবী ও রাসূলের দাওয়াতের প্রথম কথা, ইসলামের প্রথম মঞ্জিল, প্রথম অবস্থান, যেখান থেকে একজন মুমিন আল্লাহর পথে ধাবিত হয়। তাওহীদ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার উলুহিয়াত, রুবুবিয়াত এবং আসমা ওয়াসসিফাত-এর ওপর এককভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা।

আরো পড়ুন : আরকানুল ঈমান কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি বিস্তারিত

কোনো ব্যক্তি যদি নামায আদায় করে; কিন্তু আল্লাহ তায়ালাকে একক উপাস্য, একক প্রতিপালনকারী প্রভু হিসেবে বিশ্বাস না করে, তাহলে সে ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না। ইসলামের প্রবেশদ্বার হলো ‘তাওহীদ’ আর দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেয়ারও মূলমন্ত্র হলো তাওহীদ। যেমন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) থেকে বর্ণিত হাদীস-

مَنْ كَانَ أَخِرُ كَلامِ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ .

অর্থাৎ, যার শেষ কথা হবে “আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই” (তাওহীদ) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর এ স্বীকারোক্তি একজন মুমিন মুসলিমের জন্য জীবনের প্রথমে যেমন ওয়াজিব, জীবনের শেষ মুহূর্তেও তেমনি ওয়াজিব।

৩. তাওহীদ নবী রাসূলগণের দাওয়াতের প্রধান বিষয় : তাওহীদ নবী ও রাসূলগণের দাওয়াতের প্রথম ও প্রধান বিষয়। মানবজাতির দিশারি হিসেবে যুগে যুগে লক্ষাধিক নবী ও রাসূল এ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁরা সকলেই তাওহীদের শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে মানবসমাজকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন।

সকলেই একটি মাত্র ছোট বাক্য এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য দাওয়াত দিয়েছেন। হযরত আদম (আ) থেকে নিয়ে সকল নবী রাসূল তাঁদের জীবনভর এবং নবীকুল শ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর নবী জীবনের সুদীর্ঘ তেইশটি বছর তাওহীদের শিক্ষা প্রচারের জন্য সংগ্রাম করেছেন।

মক্কার জীবনে নবুয়তের তেরো বছর শুধু তাওহীদ সংক্রান্ত আদেশ বাণীই প্রচার করেছেন এবং তাওহীদের বাণী প্রচার করতে গিয়ে তিনি বহু বাধা, বিঘ্ন ও নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন। তথাপি তিনি এ কাজ থেকে বিরত থাকেননি।

৪. তাওহীদ নবী রাসূলগণের প্রথম দায়িত্ব : তাওহীদের বাণী প্রচার করা নবী রাসূলগণের প্রথম দায়িত্ব। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আয়াতসমূহের মাধ্যমে আমরা তার প্রমাণ পাই। যেমন –

ولقد أَرْسَلْنَا نُوْحًا إلى قَوْمِهِ فَقَالَ يُقَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِنْ الهِ غَيْره .

অর্থাৎ, আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি। তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো উপাস্য নেই।

হযরত সালেহ (আ) বলেন- يَا قَوْمِ ٱعْبُدُوا ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـٰهٍ غَيْرُهُ অর্থাৎ, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন—

ولَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ .

অর্থাৎ, আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এ আদেশ দান করে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং শয়তান থেকে নিরাপদ থাক । সুতরাং প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানবান নারী-পুরুষের ওপর আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের সাক্ষ্য প্রদান করা ওয়াজিব ।

৫. ইবাদতের পূর্বশর্ত তাওহীদ : সর্বপ্রথম বান্দা যে বিষয়ের জন্য আদিষ্ট তা হলো, আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ বা তাওহীদে বিশ্বাস করা। আর এ বিষয়েও একমত যে, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়ই এ একত্ববাদ বা তাওহীদে বিশ্বাস করতে হবে।

একজন মানুষের জন্য সালাত ওয়াজিব হওয়ার পূর্বে তাওহীদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। সালাত আদায় করার পূর্বেই তাওহীদে বিশ্বাস করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا أَنَا فَٱعْبُدُونِ

অর্থাৎ, আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাঁকে এ আদেশই দিয়ে প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।

৬. ইসলামের মৌলিক কর্মকাণ্ড তাওহীদ : ইসলামের সকল বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় প্রথম ও মৌলিক জিনিস হচ্ছে এ তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। শরীয়তের যত কর্মকাণ্ড আছে তা হচ্ছে এ তাওহীদেরই শাখাপ্রশাখা মাত্র ।

হযরত হুদ (আ) বলেন- হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো উপাস্য নেই ।

৭. ইসলামী বিধিবিধানের উৎস তাওহীদ : ইসলামের নৈতিক বিধিব্যবস্থা ও সামাজিক আইনকানুন এ তাওহীদ থেকে উৎসারিত। এখানকার প্রতিটি জিনিসেরই উৎস ও প্রত্যাবর্তনস্থল হচ্ছে আল্লাহর একক সত্তা। ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, নবী রাসূল, কেয়ামত, আখেরাত, ফরয, ওয়াজিব এক কথায় প্রতিটি জিনিসের ভিত্তিই আল্লাহর একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

এ একটিমাত্র জিনিসকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে ফেরেশতা, কেয়ামত ও আখেরাতে বিশ্বাস একেবারে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। নবী রাসূল এবং তাঁদের আনীত কিতাবাদি আনুগত্য লাভের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফরয, ওয়াজিব, আনুগত্য ইত্যাদি তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে। আদেশ নিষেধ ও বিধিব্যবস্থায় কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (স) বলেন-

أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّىٰ يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ ٱللَّهِ

অর্থাৎ, আমি আদিষ্ট হয়েছি মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা এ সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর রাসূল।

Leave a Comment