তাওহীদ হলো আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মূলভিত্তি। ইসলামের সকল শিক্ষা তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটা মুসলিম জাতির প্রাণশক্তির মূল আধার হিসেবে বিবেচিত। তাওহীদের পরিচয় ও প্রকারভেদ সম্পর্কে প্রশ্নালোকে আলোচনা করা হলো।
তাওহীদ শব্দের অর্থ কি ?
تَوْحِيد শব্দটি اِسْمُ مَصْدَرٍ, বাবে تَفْعِيل; এটি وَحْد মূলধাতু থেকে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ— একত্ববাদ, কাউকে একক বলে স্বীকার করা। এটা শিরক-এর বিপরীত।
তাওহীদ কাকে বলে ?
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় একমাত্র আল্লাহ তায়ালাকেই সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, বিধানদাতা এবং ইবাদতের মালিক একক সত্বা হিসেবে বিশ্বাস করা ও মেনে নেওয়া কে তাওহীদ বলে।
আরো পড়ুন : তাওহীদের পরিচয়, গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা
তাওহীদের প্রকারভেদ:
কুরআন মাজীদের তাওহীদ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ বিশ্লেষণ করে তত্ত্বজ্ঞানী পণ্ডিতগণ তাওহীদি বিশ্বাসকে ছয়টি স্তরে ভাগ করেছেন। এ ছয়টি স্তরকে নিম্নে তুলে ধরা হলো-
১. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلذَّاتِ (আল্লাহর মূল সত্তার মধ্যে একত্ব ও অবিভাজ্যতা)।
2. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلصِّفَاتِ (আল্লাহ তায়ালার গুণাবলির মধ্যে তাওহীদ) ।
3. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلْأَفْعَالِ (আল্লাহ পাকের কার্যাবলির মধ্যে তাওহীদ) ।
৪. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلْعِبَادَةِ (ইবাদত বন্দেগিতে তাওহীদ)।
৫. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلرُّبُوبِيَّةِ (রুবুবিয়্যাতের মধ্যে তাওহীদ)।
৬. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلْوِلَايَةِ (কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার একত্ব)।
১. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلذَّاتِ তথা আল্লাহর মূল সত্তার মধ্যে একত্ব ও অবিভাজ্যতা : আল্লাহ তায়ালার মূল সত্তার একত্ব ও অবিভাজ্যতার তাৎপর্য হচ্ছে, আল্লাহ এক ও একক। তাঁর কোনো শরীক নেই। তাঁর সদৃশ কেউ নেই। তাঁর প্রতিকৃতি বা তাঁর দৃষ্টান্ত অকল্পনীয়। শুধু তাই নয়, তাঁর মহান সত্তা অখণ্ড ও অবিভাজ্য।
কেননা তা বিভিন্ন খণ্ড বা বিচ্ছিন্ন অংশের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেনি। কোনো বিশেষ রাসায়নিক বা ভাবাদর্শের বিশেষ সংমিশ্রণের ফলেও নয়। যেমন- সৃষ্টিলোকের বস্তুসমূহ বিভিন্ন উপকরণের সংমিশ্রণের ফসল। নিম্নে উদ্ধৃত আয়াতসমূহ মহান আল্লাহর সত্তার একত্ব ও অবিভাজ্যতা প্রমাণ করে—
شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلْمَلَائِكَةُ وَأُولُو ٱلْعِلْمِ قَائِمًا بِٱلْقِسْطِ ۚ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ
অর্থাৎ, আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া কোনো ‘ইলাহ’ নেই। এ সাক্ষ্য ফেরেশতাগণ ও বিবেকবান, জ্ঞানীবিজ্ঞানীরাও দিয়েছেন সুবিচার নীতির ওপর অবিচল থেকে। কেননা তিনি ছাড়া প্রকৃত ইলাহ কেউ হতে পারে না, তিনিই মহাপরাক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞানী ।
আরো পড়ুন : আরকানুল ঈমান কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি বিস্তারিত
২. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلصِّفَاتِ তথা আল্লাহ তায়ালার গুণাবলির মধ্যে তাওহীদ : গুণাবলির দিক দিয়ে আল্লাহর একত্ব ও অনন্যতার তাৎপর্য হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা বহু প্রকারের গুণে গুণান্বিত। তাঁর বিচিত্র ধরনের গুণাবলি রয়েছে। যেমন— ইলম, কুদরত, জীবন, শক্তি-সামর্থ্য; কিন্তু গুণাবলির এ বৈচিত্র্য ও বহুত্ব মানসিক তাৎপর্যের দিক দিয়ে মাত্র; বাহ্যিক অস্তিত্ব ও বাস্তবতার দিক দিয়ে এসবই এক ও অভিন্ন।
অন্য কথায় প্রত্যেকটি গুণ অপর গুণের মূল । তা থেকে স্বতন্ত্র বা ভিন্নতর নয়। এসব গুণই আল্লাহর মূল সত্তায় সমন্বিত তথা নাম ও গুণাবলির একত্ববাদের অর্থ হলো দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ সকল পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত এবং সকল অপূর্ণতার ত্রুটি হতে মুক্ত।
পবিত্র কুরআন ও হাদীসে উল্লিখিত সকল নাম ও বিশেষণের ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখা। সকল প্রকার বিকৃতি, অপব্যাখ্যা থেকে মুক্ত থাকা এবং আল্লাহর কোনো গুণ বা বিশেষণ কোনো সৃষ্টজীবের গুণ বা বিশেষণের মতো নয়, এ ব্যাপারে দৃঢ়বিশ্বাস রাখা। যেমন— ক. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
وَلِلَّهِ ٱلْأَسْمَاءُ ٱلْحُسْنَىٰ فَٱدْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا ٱلَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ۚ
قُلِ ٱدْعُوا ٱللَّهَ أَوِ ٱدْعُوا ٱلرَّحْمَـٰنَ ۖ أَيًّا مَّا تَدْعُوا فَلَهُ ٱلْأَسْمَاءُ ٱلْحُسْنَىٰ
ٱللَّهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ لَهُ ٱلْأَسْمَاءُ ٱلْحُسْنَىٰ
আরো পড়ুন : ইসলাম ও ঈমান কাকে বলে?এদের মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্য
৩. التَّوْحِيدُ فِى الْأَفْعَالِ তথা আল্লাহ তায়ালার কার্যাবলির মধ্যে তাওহীদ : কার্যাবলির ক্ষেত্রে তাওহীদ হচ্ছে কার্যকারণ সম্পর্কে এ জ্ঞান যে, এসবই মহান আল্লাহর কাজের ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের কারণে সবকিছুই নিরন্তর ঘটছে।
এ মহাবিশ্বের যা কিছু রয়েছে তার কোনো একটিও স্ব-ক্ষমতায় দাঁড়িয়ে নেই। তার সবই মহান আল্লাহর কারণে অস্তিত্বশীল মোটকথা, মহান আল্লাহর কোনো শরীক নেই, তিনি তাঁর মূল সত্তায় যেমন একক; তেমনি তাঁর কার্যকারিতায় এবং তাঁর সৃষ্টিতেও একক।
আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই কিছু করার নেই। সৃষ্টিকর্মে আল্লাহর একত্ব সম্পর্কে কুরআন মাজীদে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, সৃষ্টিকর্তা কেবল আল্লাহ । এ ঘোষণা যেসব আয়াতে উচ্চারিত হয়েছে, তা এখানে উদ্ধৃত হলো। যেমন—
١. قُلِ ٱللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ
٢. ٱللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ
٣. أَلَا لَهُ ٱلْخَلْقُ وَٱلْأَمْرُ
৪. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلْعِبَادَةِ তথা ইবাদত বন্দেগিতে তাওহীদ : ইবাদত বন্দেগির একক প্রাপক হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা। তিনি ছাড়া আর কারোরই এক বিন্দু অধিকার নেই মাবুদ হওয়ার। পূর্ণত্ব ও কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার যত উচ্চশৃঙ্গেই কেউ আরোহণ করুক না কেন, কারোর নিজস্ব বলতে কিছুই নেই।
এক কথায় ইবাদত পাওয়ার একমাত্র সত্তা আল্লাহ। কেননা যেসব কারণে আল্লাহ এ অধিকার লাভ করেছেন তা আল্লাহ ছাড়া আর কারো মধ্যে পাওয়া যায় না । সম্পর্কে মহান আল্লাহর ঘোষণা হলো-
١. لَا إِلَـٰهَ إِلَّا أَنَا فَٱعْبُدُونِ
٢. أَوْ قَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ
٣. قُلْ يَا أَهْلَ ٱلْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا ٱللَّهَ
৫. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلرُّبُوبِيَّةِ তত রুবুবিয়্যাতের মধ্যে তাওহীদ: তাওহীদে রুবুবিয়্যাতের তাৎপর্য হচ্ছে, আল্লাহই সারা জাহানের রব, ব্যবস্থাপক, পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। মোটকথা হলো, সমগ্র সৃষ্টিজগৎ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছে এক ও একক। যিনি অফুরন্ত নেয়ামতের মাধ্যমে নিখিল সৃষ্টিজগৎকে প্রতিপালন করছেন।
ইহকালীন ও পরকালীন সুখ-শান্তি লাভের ক্ষেত্রে সৃজনশীল মন ও আত্মার জন্য এটাই হচ্ছে কল্যাণময় শিক্ষা। বান্দার এ আকিদা পোষণের নামই হচ্ছে তাওহীদের বুনিয়াদ। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। এখানে কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো। যেমন—
١. أَغَيْرُ ٱللَّهِ أَبْغِي رَبًّا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ
٢. فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
٣. كُلُوا مِن رِّزْقِ رَبِّكُمْ
৬. ٱلتَّوْحِيدُ فِي ٱلْوِلَايَةِ তথা কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার একত্ব : কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে তাওহীদের তাৎপর্য হচ্ছে, কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা কেবল আল্লাহ তায়ালারই রয়েছে। সার্বভৌম ক্ষমতা (Supreme power) একমাত্র তাঁরই। এ কর্তৃত্ব ক্ষমতায় কেউ তাঁর শরীক হতে পারে না।
তাঁর বিধান মতেই মানুষ তার জীবন ও জগৎ চালাবে। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনপ্রবাহ তার চরিত সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত। যেমন মহান আল্লাহর ঘোষণা—
١. إِنَّ ٱلْحُكْمَ إِلَّا لِلَّهِ
٢. عَلَيْهِ لَهُ ٱلْخَلْقُ وَٱلْأَمْرُ
٣. وَمَنْ لَمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَافِرُونَ