উপস্থাপনা : হাদীস সংকলনের ইতিহাসে জ্যোতির্ময় এক মহামনীষী ইমাম আবু ঈসা তিরমিযী (র)। তাঁর সংকলিত জামে তিরমিযী সিহাহ সিত্তার মধ্যে অনবদ্য বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর একটি গ্রন্থ। হাদীসশাস্ত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর রচিত জামে গ্রন্থটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইলমে হাদীসের এ মহান সেবকের জীবনী, তাঁর অবদান এবং জামে তিরমিযী শরীফের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো ।
ইমাম তিরমিযী (রহ)-এর জীবনী :
১. নাম ও পরিচয় : সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ ‘জামে তিরমিযী’-এর সংকলকের নাম মুহাম্মদ। উপনাম আবু ঈসা, উপাধি আল ইমামুল হাফেয । তাঁর পূর্ণ নাম ও নসবনামা হলো, আল ইমামুল হাফেয আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সাওরাতা ইবনে মুসা ইবনে যাহহাশ আস সুলামী আত তিরমিযী ।
২. জন্ম : তিনি ট্রান্স অক্সিয়ানার তিরমিয নামক প্রাচীন শহরে ২০৯ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন। এ শহরে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও প্রখ্যাত ওলামায়ে কেরামের জন্মগ্রহণের কারণে এটা ‘মদিনাতুর রিজাল’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে ।
আরো পড়ো : ইমাম বুখারী (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (পয়েন্ট আকারে)
৩. শিক্ষাগ্রহণ : ইমাম তিরমিযী (র) প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গৃহে সমাপন করেন। অতঃপর তিনি মুসলিম জাহানের প্রখ্যাত হাদীস শিক্ষা কেন্দ্রসমূহ পরিভ্রমণ করে হাদীস শ্রবণ ও গ্রহণ করেন। বসরা, রাই, খোরাসান, ইরাক ও হিজায নগরীতে হাদীস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি বছরের পর বছর ভ্রমণ করেন।
৪. ইমাম তিরমিযীর উস্তাদমণ্ডলী : ইমাম তিরমিযী (র) তাঁর সময়কার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণের নিকট থেকে হাদীস শ্রবণ ও গ্রহণ করেন। তিনি সর্বমোট হাদীসের এক হাজার উস্তাদ থেকে হাদীস সংগ্রহ করেন। তাঁদের মধ্যে- ১. ইমাম বুখারী (র), ২. ইমাম মুসলিম (র), ৩. আলী ইবনু হাজার, ৪. কুতাইবা ইবনে সাঈদ, ৫. মুহাম্মদ ইবনু বিশর, ৬. মুহাম্মদ ইবনে মুসান্না প্রমুখ অন্যতম ৷
৫. সুযোগ্য ছাত্রবৃন্দ : ইমাম তিরমিযী (র)-এর উল্লেখযোগ্য কয়েকজন ছাত্র হলেন- ১. আবু হামেদ আহমদ ইবনু আবদুল্লাহ মারূফী, ২. আহমদ ইবনু ইউসুফ নাসাফী, ৩. মুহাম্মদ ইবনু মাহমুদ (র) প্রমুখ ।
৬. অসাধারণ স্মরণশক্তি : ইমাম তিরমিযী (র) অসামান্য স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। কোনো হাদীস একবার শুনলে দ্বিতীয়বার শোনার প্রয়োজন হতো না; সাথে সাথে হাদীসটি তাঁর স্মৃতিপটে গেঁথে যেত। আবু সাঈদ ইদরীস (র) বলেন, ইমাম তিরমিযীর স্মরণশক্তি সম্পর্কে একটি উদাহরণ আছে যে, একদা তাঁর বাসনা জাগল যে, তিনি এমন একজন মুহাদ্দিস থেকে হাদীস শুনবেন, যার সাথে ইতঃপূর্বে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেনি।
আরো পড়ো : ইমাম মুসলিম রহ এর জীবনী (পয়েন্ট ভিত্তিক)- pdf
এরপর তিনি তেমনি একজন মুহাদ্দিসের খেদমতে হাজির হন। অতঃপর বিশেষ অনুরোধক্রমে মুহাদ্দিস সাহেব দাঁড়িয়ে অনেক হাদীস মুখস্থ পাঠ করেন। এগুলো শ্রবণ মাত্রই সকল তাঁর মুখস্থ হয়ে যায়। এটা দেখে সেই মুহাদ্দিস সাহেব বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন এবং তাঁর মেধা পরীক্ষার জন্য তিনি আরো ৪০টি হাদীস পাঠ করেন।
এগুলোও সাথে সাথে ইমাম তিরমিযীর মুখস্থ হয়ে যায় এবং পুনরায় সেগুলোও উস্তাদকে শুনিয়ে দেন। এমনই ছিল তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয়। অসাধারণ মেধার কারণে ইমাম বুখারী (র) তাঁর সম্পর্কে অনেক প্রশংসাজ্ঞাপক কথা বলতেন ।
৭. ইমাম তিরমিযী প্রণীত গ্রন্থাবলি : ইমাম তিরমিযী (র) বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। যেমন- আল জামে লিততিরমিযী, শামায়েলে তিরমিযী, কিতাবুল আসমা ওয়াল কুনা, কিতাবুত তারিখ, কিতাবুয যুহদ, কিতাবুল মুফরাদ প্রভৃতি তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ।
৮. আল্লাহভীতি : ইমাম তিরমিযী (র)-এর আল্লাহভীতি ও পরহেযগারী ছিল উচ্চ পর্যায়ের। তিনি সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করতেন। ফলে শেষ জীবনে তাঁর দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়।
৯. ইন্তেকাল : তিনি ২৭৯ হিজরীতে ৭০ বছর বয়সে তিরমিয শহরেই ইন্তেকাল করেন।
আরো পড়ো : ইমাম আবু দাউদ(রহ)এর জীবনী ও আবি দাউদের বৈশিষ্ট্য
তিরমিযী শরীফের বৈশিষ্ট্য :
সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ জামে তিরমিযী। জামে তিরমিযীর এমন কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এটাকে অন্যান্য হাদীসগ্রন্থ থেকে ব্যতিক্রমী মর্যাদায় উদ্ভাসিত করেছে। নিম্নে জামে তিরমিযী শরীফের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো।
১. জামে ও সুনান : সিহাহ সিত্তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে একমাত্র তিরমিযী শরীফই জামে ও সুনানরূপে সংকলিত। কেননা এতে যেমনিভাবে সিয়ার, তাফসীর, আকাইদ, আদাবু, ফিতান, আহকাম, মানাকিব ও আশরাত এ ৮টি বিষয়ের আলোচনা রয়েছে তেমনি গ্রন্থটিকে বিন্যস্ত করা হয়েছে ফিকহী তারতীব অনুযায়ী ।
২. রাবীর পরিচয়ের উল্লেখ : রাবীর পরিচয় উল্লেখ করা জামে তিরমিযী শরীফের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ গ্রন্থে হাদীস বর্ণনার পাশাপাশি রাবীদের পরিচিতি, অবস্থান ও তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা দেয়া হয়েছে। যাতে তাঁদের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায় ।
৩. শরীয়তের আইনের উদ্ভাবন : হাদীস থেকে শরীয়তের আইন উদ্ভাবনের এক চমৎকার পদ্ধতির উল্লেখ আছে এ গ্রন্থে। ফলে ওলামায়ে কেরাম অত্যন্ত সহজে এ গ্রন্থ থেকে শরীয়তের আইন উদ্ভাবন করতে পারেন ।
৪. মাযহাব সম্পর্কিত আলোচনার উল্লেখ : ইমাম তিরমিযী (র) তাঁর গ্রন্থে মাযহাবভিত্তিক বিধান তথা প্রত্যেক হাদীসের উল্লেখ শেষে বিভিন্ন মাযহাবের মতবাদ এবং প্রত্যেক মতবাদের প্রমাণ উল্লেখ করেছেন ।
৫. সুলাসিয়াত : সহীহ বুখারীর পর জামে তিরমিযীতে সুলাসিয়াত তথা সাহাবী থেকে ইমাম তিরমিযী (র) পর্যন্ত তিন রাবী সূত্রে বর্ণিত হাদীস পাওয়া যায়।
আরো পড়ো : ইমাম নাসায়ী (র) এর জীবনী ও নাসায়ীর বৈশিষ্ট্যসমূহ
৬. খণ্ড-খণ্ড বাব : তিনি তাঁর হাদীসগ্রন্থকে বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত করে বহু অধ্যায়ে সংকলন করেছেন।
৭. তাকরার নীতি পরিহার : জামে তিরমিযীতে প্রয়োজনের তাগিদে মাত্র অল্প কয়েকটি হাদীস ব্যতীত আর কোনো হাদীসের তাকরার করা হয়নি। এ গ্রন্থে মাত্র ৮৩টি হাদীসের তাকরার পাওয়া যায় ।
৮. হাদীসের শ্রেণি বিশ্লেষণ : এ গ্রন্থে হাদীসের প্রকারভেদ যেমন- সহীহ, হাসান, যয়ীফ, গরীব প্রভৃতি শ্রেণির বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং কোনটি কোন শ্রেণির তাও বলে দেয়া হয়েছে।
৯. সহজবোধ্যতা : সহজবোধ্যতা তিরমিযী শরীফের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। মূলত সিহাহ সিত্তার অন্য যে কোনো গ্রন্থ থেকে এটা সহজবোধ্য । তাই অনেকে একে বুখারী মুসলিম এমনকি অন্য সব গ্রন্থের ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
১০. যাচাইবাছাইয়ের কষ্টিপাথর : ইমাম তিরমিযী (র) তাঁর এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হাদীসগুলোকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে যাচাইবাছাই করে গ্রহণ করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য শ্রমের মাধ্যমে পাঁচ লক্ষ হাদীস থেকে যাচাইবাছাই করে মাত্র ১৬ শত হাদীসের সমন্বয়ে এ গ্রন্থ সংকলন করেন। তাই এ গ্রন্থে দুর্বল হাদীস নেই বললেই চলে।
১১. হাদীসের আমল : জামে তিরমিযী শরীফের جَمْعٌ بَيْنَ الصَّلَاتَيْنِ ও قَتْلُ شَارِبِ الخَمْرِ -এর হাদীস ছাড়া বাকি সব হাদীসের ওপরই কোনো না কোনো মাযহাবের লোক আমল করে।
১২. অন্যান্য মনীষীর মতামত : জামে তিরমিযী সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন মন্তব্য প্রদান করেছেন। যেমন-
ক. মুফতি আমীমুল ইহসানের অভিমত : মুফতি আমীমুল ইহসান (র) বলেন, এটি পূর্ণাঙ্গতা ও হাদীসের শুদ্ধাশুদ্ধির দিক থেকে বুখারীর অনুসারী এবং অঙ্গসজ্জা ও বিন্যাসে মুসলিমের উদাহরণ বটে।
খ. হাফেয ইবনে রশীদের অভিমত : হাফেয ইবনে রশীদ জামে তিরমিযীর ১৪টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন- ১. এ গ্রন্থটি অধ্যায়ে অধ্যায়ে বিভক্ত, ২. ফিকহী মাসয়ালা বর্ণিত, ৩. সহীহ ও যয়ীফ হাদীসের পরিচয় প্রদান, ৪. রাবীদের পরিচয়, ৫. রাবীদের দোষ-গুণের উল্লেখ, ৬. সাহাবী ও তাবেয়ীগণের স্বতন্ত্র পরিচয় প্রদান, ৭. সনদ সমালোচিত, ৮. শায হাদীস চিহ্নিত, ৯. মওকূফ হাদীস স্পষ্টকৃত, ১০. মুদরাজ হাদীস প্রসঙ্গে মন্তব্য, ১১. মুসনাদ বিবৃত, ১২. মাতরূকুল আমলের বিবরণ প্রদান, ১৩. হাদীস গ্রহণ ও বর্জন সম্পর্কে আলেমদের মতবিরোধ, ১৪. হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ধারায় মুসলিম পণ্ডিতদের বিভিন্ন মতামত ।
ইমাম তিরমিযীর অভিমত : এ গ্রন্থ সংকলনের পর ইমাম তিরমিযী (র) স্বয়ং এর সম্পর্কে অভিমত পেশ করে বলেন, এ গ্রন্থটি যার ঘরে থাববে মনে হবে যেন নবী করীম (স) নিজেই তার গৃহে কথা বলছেন।
পরিশেষে : ইমাম তিরমিযী নিঃসন্দেহে একজন প্রথিতযশা, অসামান্য প্রতিভাধর ও ক্ষণজন্মা মহামনীষী ছিলেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের ফসল জামে তিরমিযী। এ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যাবলি হাদীসশাস্ত্রে তাঁর স্বাতন্ত্র্য রক্ষার মযবুত হাতিয়ার, যে বৈশিষ্ট্যাবলি অন্যান্য গ্রন্থে অনেকাংশেই অনুপস্থিত।