উপস্থাপনা : প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, ছোটগল্পকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পুঁই মাচা’ গল্পটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী সামাজিক ছোটগল্প। এ গল্পে তিনি সমাজ বাস্তবতার পাশাপাশি কিশোর মনস্তত্ত্বের বহুমাত্রিক রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন।
পুঁই মাচা গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সহায়হরির বড় মেয়ে ক্ষেন্তি। তাকে কেন্দ্র করেই গল্পটির অন্যান্য চরিত্র গড়ে উঠেছে এ গল্পে লেখক ক্ষেন্তির চরিত্র অত্যন্ত করুণ রসাত্মক এবং চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ক্ষেন্তির পরিচয় : পুঁই মাচা গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্ষেন্তি সহায়হরি চাটুয্যের বড় মেয়ে। তার বয়স পনেরো বছর। বিবাহযোগ্য হলেও ক্ষেন্তির শিশুসুলভ আচরণের সমাপ্তি ঘটেনি। সে সারাদিন ছোট বোন দুটোকে নিয়ে গ্রামময় ঘুরে বেড়ায়। এ কারণে মা অন্নপূর্ণার বকুনি খায়। সে। বিয়ের বয়স হলেও এখনো ক্ষেন্তির বিয়ে হয়নি। অবশ্য একবার আশীর্বাদ হওয়ার পরও পাত্রের চরিত্রদোষের কারণে বিয়ে দেওয়া হয়নি ।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু /মূলভাব/মূল বক্তব্য/মূল সুর
ক্ষেস্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : সাধারণ গ্রাম্য দরিদ্র বালিকার ভোজনপটুতা, উদারপরায়ণতা, আত্মসম্মানবোধের অভাব, এমনকি পিতার প্রশ্রয়ে প্রলোভনের বশে চুরি করার প্রবণতাও ক্ষেন্ডির মধ্যে রয়েছে। তারপরও তার মধ্যে অদম্য প্রাণশক্তি, শৈশব-চাপল্যের চিরন্তন প্রতীক।
ঝরনার চঞ্চলতা ও প্রাণোচ্ছল খেয়াল-খুশিতে পূর্ণ কিশোরী। ক্ষেন্তি কখনো মায়ের শাসনে শঙ্কিতা, আবার কখনো বাবার প্রশ্রয়ে চঞ্চলা হরিণী। বিয়ের সাথে সাথে তার আবাল্য বেড়ে ওঠা পরিবারের সাথে অবিচ্ছেদ্য ঘনিষ্ঠতায় বিচ্ছেদ দেখা দেয়।
নিরীহ প্রকৃতির ক্ষেন্তি : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুই মাচা’ গল্পের সহায়হরি চাটুয্যের বড় কন্যা ক্ষেন্তি ছিল নিরীহ প্রকৃতির এক গ্রাম্য বালিকা। তার স্বভাব ছিল গোবেচারা ধরনের। তাকে হাজারো গালমন্দ রাগারাগি করলেও সে এর প্রতিবাদ করতো না।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের সমাজ বাস্তবতার পরিচয় দাও
ও পাড়ার রায়দের ফেলে দেওয়া পুঁইশাক তুলে আনার কারণে মা অন্নপূর্ণা যখন তাকে গালমন্দ করেন, তখনও ক্ষেন্তি একজন অপরাধীর ন্যায় চুপচাপ থেকেছে। আবার বাপের সাথে বরোজপোতার জঙ্গল থেকে আলু চুরি করে আনার অপরাধে মা যখন তাকে ভর্ৎসনা করেছেন, তখনো সে টু-শব্দ করেনি। সংসারের অভাব-অনটনের প্রভাব ক্ষেন্তির ওপরও পড়েছিল।
তার সহজ-সরল মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে, কুড়িয়ে পাওয়া পুঁইশাক কিছুটা হলেও খাদ্যাভাব মেটাবে এবং এতে তার মা খুশি হবে। সংসারের কাছে তার কোনো দাবি ছিল না। নিরীহ প্রকৃতির কারণেই অযত্ন, অবহেলা ও বিনা চিকিৎসায় শ্বশুর বাড়িতে ক্ষেন্তিকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে।
পিতৃ-অনুগত ক্ষেন্তি : ক্ষেন্তি ছিল তার পিতা সহায়হরি চাটুয্যের একান্ত অনুগত। পিতাকে সে যেমন ভালোবাসত তেমনি মান্য করতো। এ কারণে সে পিতার প্রশ্রয়ে লালিত হয়েছে। বরোজপোতার জঙ্গল থেকে মেটে আলু চুরি করে আনার প্রস্তাবে ক্ষেন্তি বিনা আপত্তিতে পিতার অনুগামী হয়েছে। কাজটা গর্হিত কিনা তা বিচার করার প্রয়োজনীয়তা তার কাছে ছিল একান্তই গৌণ। এভাবেই ক্ষেন্তি তার পিতার প্রতি সব ক্ষেত্রেই আনুগত্য প্রদর্শন করেছে।
আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর
মাতৃভীতু ক্ষেন্তি : বাবা সহায়হরির সাথে ক্ষেন্তির বেশ সখ্য থাকলেও মায়ের প্রতি ছিল তার ভীষণ ভয়। রায় কাকার বাড়ি থেকে পুঁইশাক কুড়িয়ে আনার পর মা রাগান্বিত হয়ে সেগুলো ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দিলে ক্ষেন্তি ভয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে এক বারের জন্যও ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করার সাহস পায়নি। অবশেষে খাওয়ার সময় পাতে পুঁই চচ্চড়ি দেখে খুশি হলেও ভয়ে সে মায়ের চোখের দিকে তাকাতে সাহস করেনি।
ভোজনপটু ক্ষেন্তি : গল্পের প্রধান চরিত্র ক্ষেন্তি ছিল অধিকমাত্রায় ভোজনপটু মেয়ে। সে খেতে ভালোবাসত, বিশেষ করে পুইশাকের চচ্চড়ির প্রতি তার খুব লোভ ছিল। খাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো লাজলজ্জার বালাই ছিল না।
পিতা সহায়হরি ও মা অন্নপূর্ণা তার এ ভোজনপটুতাকে সব সময়ই প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখেছেন। ক্ষেন্তি পুইশাক, পিঠা ও আমসত্ত্ব যেতে খুবই পছন্দ করতো। সে একসঙ্গে আঠারো-উনিশটা পিঠা খেতে পারতো। এভাবে খেতে তার একটুও লজ্জা বা সংকোচ অনুভব হতো না।
বিভক্ত ক্ষেন্তি : ‘পুই মাচা’ গল্পের প্রধান চরিত্র ক্ষেন্তি পুঁইশাক খেতে খুব পছন্দ করতো। গত অরন্ধনের পূর্বদিন বাড়িতে পুঁইশাক রান্না হলে ক্ষেস্তি সংকোচ লজ্জার তোয়াক্কা না করে মাকে বলেছিল, সে একাই অর্ধেক খাবে।
তার এ পুঁইপ্রীতির কারণে একদিন সে বোনদের নিয়ে ওপাড়ার রায়দের ফেলে দেওয়া পাকা পুঁইশাকের ডাঁটার বোঝা কুড়িয়ে এনে মায়ের বকুনি খেয়েছিল। সেদিনই পুঁইশাক রান্না হলে সে অতি আগ্রহের সাথে তা খেয়েছিল ।
এরপর ক্ষেন্তি উঠানের এক কোণে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে মাচা বেঁধে একটা শীর্ণকায় পুই চারা রোপণ করেছিল। তার মৃত্যুর পর এ পুঁই গাছটি তারই স্মৃতি পাতায় পাতায়, শিরায় শিরায় ধারণ করে বিস্তার লাভ করেছিল।
অপরিচ্ছন্ন ক্ষেন্তি : মা অন্নপূর্ণার দৃষ্টিতে ক্ষেন্তি ছিল অপরিচ্ছন্ন। পৌষ-সংক্রান্তিতে পিঠা বানানোর সময় অন্নপূর্ণা প্রথমে ক্ষেন্তির সাহায্য নিতে রাজি হননি। কারণ সে যেখানে-সেখানে বসে, বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, মাথার চুল এলোমেলো, তার কাপড়-চোপড় স্বাস্থ্যসম্মত পরিচ্ছন্ন নয়। অবশেষে ক্ষেন্তির আগ্রহ ও অনুরোধে অন্নপূর্ণা তার হাত-পা ধুইয়ে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিয়ে তাকে নারকেল কোরাতে দিয়েছিলেন।
সত্যবাদী ক্ষেন্তি : ক্ষেন্তির চমৎকার একটা গুণ হলো, সে কখনো মিথ্যা কথা বলত না। সব সময় সত্য কথা বলত। আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও সে কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেয়নি বরোজপোতার জঙ্গল থেকে চুরি করে আনা মেটে আলু সম্পর্কে পিতা সহায়হরি অন্নপূর্ণার কাছে মিথ্যা বলেছিলেন, কিন্তু সত্যবাদী ক্ষেন্তি মায়ের প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যা বলতে পারেনি। ]
ক্ষেন্তির ভগ্নিপ্রীতি : ক্ষেন্তি তার বোনদের খুব ভালোবাসত। সে ছিল মূলত স্নেহময়ী একটা মেয়ে। ক্ষেন্তি কিছুটা উদাস-অসচেতন প্রকৃতির হলেও ছোট বোনদের প্রতি ছিল তার প্রবল স্নেহ-মমতা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা ।
তাই সে ছোট বোন রাধী ও পুঁটিকে নিয়ে খেলা করেছে এবং পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়িয়েছে। বোনদের সাথে নিয়ে প্রতিবেশীর বাড়ি হতে পুঁইশাক চেয়ে এনেছে। নিজের বাড়িতে শাক-সবজির বাগান করেছে। সে কখনো বোনদের সাথে রাগারাগি করতো না ।
সহজ-সরল ক্ষেন্তি : সহায়হরির বড় মেয়ে ক্ষেন্তি ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল স্বভাবের মেয়ে। বিশেষত খাওয়ার ব্যাপারে তার লজ্জা-শরমের বালাই ছিল না। ছোট বোনদের ময়দার গোলা খেতে দেখে ক্ষেন্তি অবোধ শিশুর মতো লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। অন্নপূর্ণা তা দেখে ক্ষেন্তির জন্য খানিকটা গোলা তুলে রেখেছিলেন।
আবার নারকেল কোরানো শেষ হলে সে মাকে বলেছে, “মা, নারকেল কোরা একটু নেবো?” মা সম্মতি দেওয়ার সাথে সাথে ক্ষেন্তি এক থাবা নারকেল কোরা হাতে নিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শুরু করেছিল। সে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে পাটিসাপটা পিঠা খেয়েছে। এমনি সহজ- সরল প্রকৃতির মেয়ে ছিল ক্ষেন্তি।
ধৈর্যশীলা ক্ষেন্তি : ক্ষেন্তি ছিল অসীম ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক। মায়ের গালমন্দ, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং সমাজপতিদের গঞ্জনা সে নীরবে সহ্য করেছিল। ক্ষেন্তিকে বিয়ে দেওয়ার সময়ও পিতামাতার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সে কোনো প্রতিবাদ করেনি।
সংসার উদাসীন ক্ষেন্তি : স্বভাব-চরিত্রে ক্ষেন্তি ছিল পিতার মতোই উদাসীন ও অসচেতন প্রকৃতির। সমাজ-সংসারের প্রতি তার কোনো খেয়াল ছিল না। তার বয়স যে কৈশোরের কোঠা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তার বিয়ে নিয়ে যে মা-বাবা, এত চিন্তিত, সমাজে তাকে নিয়ে যে নানা ধরনের দুর্নাম রটতে পারে, সে ব্যাপারে তার কোনো অনুভূতিই ছিল না ।
হতভাগিনী ক্ষেন্তি : জন্মই ছিল যেন ক্ষেন্তির আজন্ম পাপ। সে ছিল এক হতভাগিনী ব্রাহ্মণ কন্যা। প্রথম যখন তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল তখন আশীর্বাদ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। এ কারণে পাড়ার মানুষ তাকে ‘উচ্ছ্বগগু’ করা মেয়ে বলে অভিহিত করতো। গরিব ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নেওয়ায় পিতামাতা তাকে উপযুক্ত পাত্রে বিয়ে দিতে পারেনি।
অনন্যোপায় হয়ে সহায়হরি চাটুয্যে চল্লিশোর্ধ্ব পাত্রের সাথে ক্ষেন্তির বিয়ে দিয়েছিলেন। পণের টাকা বাকি থাকার কারণে ক্ষেন্তিকে আর বাপের বাড়িতে আসতে দেওয়া হয়নি। অবশেষে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে হতভাগিনী ক্ষেন্তি অযত্ন, অবহেলা ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
উপসংহার : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পুঁই মাচা’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ক্ষেন্তি। ক্ষেন্তির মাধ্যমে লেখক দারিদ্র্যের করালগ্রাসে নিঃশেষিত সহজ-সরল গ্রামীণ একটি মেয়ের স্নিগ্ধ শান্তরূপ চিত্রিত করতে চেয়েছেন। তিনি ক্ষেন্তিকে উপলক্ষ করে কৌলীন্য প্রথাবিড়ম্বিত পরিবারব্যবস্থার দারুণ অসহায়তার চিত্রাঙ্কন করতে চেয়েছেন এ গল্পে ।