» প্রশ্ন : ৷৷ কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত বনলতা সেন কবিতার মূলভাব/ মূল সুর/ মূল বক্তব্য তোমার নিজের ভাষায় লিপিবদ্ধ কর।
অথবা, জীবনানন্দ দাশ বিরচিত ‘বনলতা সেন’ কবিতার ভাবার্থ/ সারাংশ/ সারমর্ম তোমার নিজের ভাষায় লেখ।
উপস্থাপনা : জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিদের পথিকৃৎ এবং রূপসী বাংলার কবি। তাঁর রচিত ‘বনলতা সেন’ একটি অনিন্দ্যসুন্দর রোমান্টিক প্রেমের কবিতা। কবির মানসপ্রতিমা বনলতা সেনের সৌন্দর্য অনবদ্য।
শব্দ চয়ন, ছন্দ কৌশল, উপমা প্রয়োগ এবং স্বভাবোক্তি অলঙ্কারের দুর্লভ সমন্বয়ে তাঁর এ কবিতা এক অনন্য রূপ লাবণ্যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। এ কবিতার মাধ্যমে তিনি মানবহৃদয়ের প্রেমানুভূতি আর নারীর চিরায়ত সৌন্দর্য ও মাধুর্যের এক অনুপম বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
বনলতা সেন কবিতার মূলভাব : কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘বনলতা সেন’ কবিতায় যে প্রেমানুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তা সমগ্র পুরুষজাতির অনুভূতিকে একত্রিত করেছে।
শ্রমক্লান্ত মানুষ (পুরুষ) প্রতিনিয়ত শান্তির অন্বেষণ করে। কাঙ্ক্ষিত শান্তির জন্য সে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ফেরে, কিন্তু শান্তির সন্ধান সে পায় না। অনন্তকালের পথপরিক্রমায় কবির জীবনে যেসব অশান্তি সমুদ্রের সফেন হয়ে জমেছিল, তা আজ তাঁর মানস-প্রতিমা রূপসী- প্রেয়সী নারী বনলতা সেনের ভালোবাসার পরম স্পর্শে নির্মল হয়ে ওঠে।
আরো পড়ো : সাত সাগরের মাঝি কবিতার মূলভাব- তোমার নিজের ভাষায় লেখ
প্রকৃতি ও মানবীয় মেলবন্ধন : বনলতা সেন কবিতায় বনলতা সেন এখানে নারীসত্তারূপে, কবির মানস প্রিয়তমারূপে উপস্থাপিত হয়েছে। পৃথিবীর হাজারো পথ অতিক্রম করে কবি যখন ক্লান্ত, ইতিহাসের কোনো সভ্যতাই যখন কবিকে এতটুকু শান্তি দিতে পারেনি, তখন প্রকৃতি-সংলগ্নতাই কবিকে এনে দিয়েছে শান্তি-সুখের সন্ধান ।
ফলে সেই প্রকৃতিকে মানবীরূপ দিয়ে তার জন্য রচনা করেন স্তুতি গান, তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিলিত হওয়ার প্রয়াসে খুঁজে ফেরেন নির্জনতা, কাটান অপেক্ষার দীর্ঘপ্রহর। যেমন তিনি উচ্চারণ করেন-
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
ইতিহাস চেতনা : ‘বনলতা সেন’ কবিতায় কবির ইতিহাস চেতনা দৃঢ় প্রত্যয়ীপূর্ণ। বনলতা সেনের বর্ণনায় তিনি “বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে’ উপনীত হয়েছেন। শ্রাবন্তীর কারুকাজে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন।
দারুচিনি দ্বীপ, সিংহল সমুদ্র, মালয় সাগর তাঁর চোখে ভেসে উঠেছে। তরীর হাল ভেঙে যে নাবিক দিগভ্রান্ত হয়ে হঠাৎ দ্বীপের সন্ধান পেয়ে উজ্জ্বল আলোক চোখে ধারণ করে বলে ওঠেন-
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর
আরো পড়ো : স্বাধীনতা তুমি কবিতার মূলভাব /বিষয়বস্তু/সারমর্ম
কবির মানসপ্রতিমা : বনলতা সেন কবিতায় বনলতা সেন কবির মানস-প্রতিমা এবং কবি যেন সমগ্র মানব জাতির অংশ। বনলতা সেন চিরকালের প্রেমময়ী নারীর এক আশ্চর্য মনোহর প্রতিমা। প্রাণের অকৃপণ ঐশ্বর্যে সে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। তাই বনলতা সেন এক মুহূর্তের মধ্যেই সঞ্জীবিত করে তোলে হাজার বছরের ক্লান্তিতে জর্জর পুরুষসত্তাকে। কবির ভাষায়-
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে ।
মানসপ্রতিমার আশ্রয় : কবি দারুচিনি দ্বীপ, সিংহল সমুদ্র ও রাতের অন্ধকার পেরিয়ে মালয় পর্যন্ত ঘুরেছেন। হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতা যখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে সংসার সমুদ্রের অস্থিরতায় তোলপাড় করছিল, তখনই কবি দেখা পান আরাধ্য সেই প্রশান্তির আশ্রয় বনলতা সেনের। তার আশ্রয় লাভ করে তিনি পরিতৃপ্তি প্রকাশ করেন। যেমন কবির ভাষায়-
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
মানসপ্রতিমার সৌন্দর্য : কবির মানসপ্রতিমা বনলতা সেন অনবদ্য সৌন্দর্যের অধিকারী। তার চুল প্রাচীনকালের মালয় দেশের বিদিশা নগরীর অন্ধকারের মতো কালো। তার মুখে শ্রাবন্তীর কারুকার্য শোভা পায়।
সমুদ্রে হালভাঙা পথহারা হতাশ নাবিক যেমন হঠাৎ সবুজাভ ঘাসের দেশে দারুচিনি দ্বীপের সন্ধান পেয়ে আশান্বিত হয়, তেমনি কবিও তাঁর মানস-প্রতিমা বনলতা সেনের সান্নিধ্য পেয়ে এক নতুন পথের দিকনির্দেশনা পেয়েছেন। পরম মমতায় চোখ তুলে সে কবিকে বলেছে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
প্রেম ও সৌন্দর্য : ‘বনলতা সেন প্রেম ও সৌন্দর্যের মেলবন্ধন। এখানে যুগ-যুগান্তরের পথচারী পুরুষসত্তা খুঁজে পেয়েছে শাশ্বত এক নারী সত্তাকে। সেই শাশ্বত নারী প্রেম ও সৌন্দর্যের অনিঃশেষ দীপ্তিতে মহীয়সী। তার সান্নিধ্য পাওয়া যে-কোনো পুরুষের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় বটে। কবি সেই সৌভাগ্যবান পুরুষদেরই একজন।
মানসপ্রতিমার পরম শান্তির সন্ধান লাভ : দিনের শেষে নিঃশব্দ চরণে সন্ধ্যা নামে। দিনের সকল কোলাহল থেমে যায়। শিশিরের পতন বৃষ্টির মতো মৃদু শব্দ করে, চিলের ডানায় রোদের গন্ধ মুছে যায়, মুছে যায় পৃথিবীর সব রং, চারদিকে নেমে আসে ধূসরতা।
পৃথিবীর সব আলো তখন দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। জোনাকিরা আলো ঝিলমিল করে নতুন গল্পকাহিনি রচনার জন্য পাণ্ডুলিপির আয়োজন করে। আরম্ভ হয় সময়ের নতুন পর্যায়। পাখিরা তাদের খুঁজে বেড়ায় । স্তব্ধ হয়ে যায় নদীতীরের গুঞ্জন। তাই কবি বলেন-
সব পাখি ঘরে আসে – সব নদী – ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
উপসংহার : ‘বনলতা সেন’ কবি জীবনানন্দ দাশের অসাধারণ রোমান্টিক মানসের এক অনন্য সৃষ্টি, যা বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। এ কবিতার মধ্য দিয়ে নাটোর নামক নির্দিষ্ট এলাকা ও ‘বনলতা সেন’ নামক এক অপরূপ নারীর বর্ণনার মিলন ঘটানো হয়েছে।
জীবনানন্দ দাশ এ কবিতায় ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এক প্রেমিক আর বনলতা সেন তার মানসপ্রতিমা । বাংলার সবুজ শ্যামল নৈসর্গিক আর সুগভীর ইতিহাস চেতনার সংমিশ্রণে ‘বনলতা সেন’ যেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের উজ্জ্বল সম্পদ ।
প্রশ্ন :।। নামকরণের সার্থকতাসহ বনলতা সেন কবিতার মূল্যায়ন কর।
অথবা, বনলতা সেন কবিতার নামকরণের সার্থকতা নিরূপণ কর।
উপস্থাপনা : রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের অনন্য সৃষ্টি বনলতা সেন কবিতাটি। গভীর প্রেমানুভূতি, ভৌগোলিক বিস্তৃতি, ইতিহাস চেতনা, উপমার প্রয়োগ, ছন্দের কারুকার্য প্রভৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে এ কবিতায়। এ কবিতায় নারীর চিরাচরিত সৌন্দর্য ও মাধুর্যের মহিমাকীর্তন করা হয়েছে। নিচে ‘বনলতা সেন’ কবিতার নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করা হলো :
নামকরণের রীতি : নামকরণ সাহিত্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এর মধ্য দিয়ে সাহিত্যের অন্তর্নিহিত ভাব অনেকাংশই ফুটে ওঠে। এজন্য কবি সাহিত্যিকগণ নামকরণে বিশেষ সতর্ক থাকেন। মনীষী Cavendis-এর মতে, ‘A beautiful name is better than a lot of wealth’ অর্থাৎ, একটি সুন্দর নাম অঢেল সম্পদের চেয়ে উত্তম।
নামকরণে কবি- সাহিত্যিকগণ সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তু, চরিত্র এবং অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকেন। আলোচ্য কবিতার নামকরণ করা হয়েছে বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে।
নামকরণের ভিত্তি : প্রবন্ধ, কবিতা বা গল্পের নামকরণের মধ্য দিয়ে সাহিত্যিকের অভীষ্ট লক্ষ্য, ভাব ও বক্তব্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তাই সাহিত্যে নামকরণের ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হয়। যেমন-
- রচনার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বা বিষয়বস্তু
- স্থান বা কাল
- রূপক বা প্রতীকী ব্যঞ্জনা
- নায়ক-নায়িকার নাম
- কেন্দ্রীয় চরিত্র
- রচনার মূলভাব
নামকরণের উপজীব্য বিষয় : ক্লান্ত-শ্রান্ত কবি হাজার বছর পথ হেঁটে কোথাও সুখ-শান্তি ও আশ্রয় পাননি। হাজার বছরের পথপরিক্রমায় ক্লান্ত কবির কাছে বনলতা সেন ছিল শেষ আশ্রয়স্থল। ফলে বনলতা সেন এখানে হয়ে উঠেছে কবির মানস-প্রিয়া। তাই বনলতা সেনের রূপ বর্ণনায় কবি হয়ে উঠেছেন উদ্বেল ও আবেগপ্রবণ।
প্রাচীন ভারতের সকল ধ্রুপদী সৌন্দর্যের সমারোহে কবি তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন তাঁর মানসপ্রতিমাকে। বনলতা সেনের রূপ-সৌন্দর্যের উপমায় তিনি আহরণ করেছেন প্রাচীন ভারতের বস্তুনিচয় থেকে। বনলতা সেন সুন্দরী, তার চুল ঘনকৃষ্ণ। কবি প্রাচীন বিদিশা নগরীর আঁধার রাতের সঙ্গে বনলতা সেনের চুলের তুলনা করেছেন।
বনলতা সেনের চুল বিদিশার মোহ ছড়ানো অন্ধকার রাতের মতোই কালো। শ্রাবন্তী প্রাচীন ভারতের প্রসিদ্ধ নগরী। শ্রাবস্তীর কারুকাজ নিটোল রমণীমূর্তিকে পাথরে অক্ষয় করে রেখেছে। সে মূর্তি সৌন্দর্যের প্রতীক। কবির চোখে বনলতা সেনের মুখ যেন শ্রাবন্তীর সেই কারুকার্যময় নিটোল রমণীমূর্তির মুখ। এ মুখে কোনো খুঁত নেই। সৌন্দর্যের অপরূপ মহিমায় উজ্জ্বল সে মুখ ।
নামকরণের সার্থকতা : কবির কবিতায় যে হতাশার সুর, ব্যর্থ জীবনের ক্লান্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে তা দূর হয়েছে বনলতা সেনের প্রীতিস্নিগ্ধ প্রেমময় সংলাপে। সুস্থির কুশল সংলাপের মধ্য দিয়ে বনলতা সেন তাঁর প্রাণের অমল ভালোবাসাকে, কোমল হৃদয়ের স্নিগ্ধতাকে সঞ্চারিত করেছে জীবন-সমুদ্রের পথহারা কবির হৃদয়ে।
অশান্ত কবি শান্তিলাভ করেন বনলতা সেনের স্নিগ্ধ সান্নিধ্যে। তার দেহের সৌন্দর্যের রূপমুগ্ধতায়ই কবি পরম শান্তি পাননি, তার চোখের মাঝে মমতার উষ্ণ আতিথ্যই তাঁকে নিবিড় শান্তি এনে দিয়েছিল। কবিতাটির প্রধান আকর্ষণ হতাশা-পীড়িত কবিহৃদয় নয়, মমতাময়ী বনলতা সেন।
বঞ্চনা, সংশয়, ক্লান্তি সব আমরা ভুলে যাই, যখন আমাদের চেতনায় বনলতা সেন এক অবিনাশী নারীমূর্তি হয়ে বিরাজ করে। তার চুল, মুখ, আন্তরিক সম্ভাষণ এবং মমতাপূর্ণ চোখ আমাদের চেতনায় প্রেমের প্রত্যাশাকে জাগ্রত করে।
বনলতা সেন কবিতায় বনলতা সেন এখানে নারীসত্তারূপে, কবির মানস প্রিয়তমারূপে উপস্থাপিত হয়েছে। পৃথিবীর হাজার বছরের পথ অতিক্রম করে কবি যখন ক্লান্ত, ইতিহাসের কোনো সভ্যতাই যখন কবিকে এতটুকু শান্তি দিতে পারেনি, তখন প্রকৃতি-সংলগ্নতাই কবিকে এনে দিয়েছে শান্তি-সুখের সন্ধান।
ফলে সেই প্রকৃতিকে মানবীরূপ দিয়ে তার জন্য রচনা করেন স্তুতি গান, তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিলিত হওয়ার প্রয়াসে খুঁজে ফিরেন নির্জনতা, কাটান অপেক্ষার দীর্ঘপ্রহর। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘বনলতা সেন’ কবিতার নামকরণ কবিতার ভাববস্তু বিচারে সঙ্গত, শিল্পসম্মত ও সার্থক হয়েছে।
উপসংহার : সংযত চিন্তাচেতনা জীবনানন্দের কবিতায় যে চিত্রকল্পের সৃষ্টি করেছে তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। বনলতা সেন কবিতাটি অনন্য হয়ে উঠেছে কবির অনুচ্ছ্বসিত সংযত প্রকাশে। জীবনানন্দের কাব্যের এ অনন্য বৈশিষ্ট্য তাঁকে বাংলা কাব্য সাহিত্যে স্বতন্ত্র মহিমা এনে দিয়েছে। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় তাঁর সার্থক প্রতিফলন সবিশেষ লক্ষণীয়।
বনলতা সেন কবিতার মূলভাব – pdf
ফাইল সাইজ: 190 KB | ফরম্যাট: PDF
আপনার ফাইল প্রস্তুত হচ্ছে… অপেক্ষা করুন
30 সেকেন্ড