উপস্থাপনা : বিশুদ্ধতম ছয়টি হাদীসগ্রন্থের মধ্যে আস সহীহ বুখারী ও মুসলিম সবচেয়ে বিশুদ্ধতম। তবে এ দুটির মধ্যে কোনটি প্রাধান্যপ্রাপ্ত, এ ব্যাপারে দুটি অভিমত রয়েছে। জমহুর মুহাদ্দিসীন বলেন- অর্থাৎ, কিতাবুল্লাহর পরে সবচেয়ে বিশুদ্ধ গ্রন্থ আস সহীহ লিল বুখারী।
পক্ষান্তরে আবু আলী আন নিসাপুরী, কুরতুবী, ইবনে রুশদ (র) এবং আফ্রিকার মুহাদ্দিসগণের মতে, সহীহ মুসলিম বিশুদ্ধতম গ্রন্থ। নিসাপুরীর মতে- আকাশের নিচে ইমাম মুসলিমের হাদীসগ্রন্থ অপেক্ষা বিশুদ্ধতর গ্রন্থ আর কোনোটি নেই ।
বুখারী ও মুসলিম শরীফের তুলনামূলক আলোচনা :
যুক্তির ভিত্তিতে আলোচনা করলে দেখা যায়, বিশুদ্ধতার দিক থেকে সহীহ বুখারী শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ; কিন্তু গ্রন্থনা, উপস্থাপনা ও পরিমার্জনায় সহীহ মুসলিম সর্বোপরি প্রাধান্যপ্রাপ্ত। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো-
১. বর্ণনাকারীদের যোগ্যতার তারতম্য : মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে রাবীদেরকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে । যথা-
ক. যাদের হাদীস সংরক্ষণ ক্ষমতা অত্যধিক। সে সাথে স্বীয় শায়খ বা মারবী আনহু-এর সাথে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক রয়েছে।
খ. যাদের হাদীস সংরক্ষণ ক্ষমতা অত্যধিক। কিন্তু শায়খের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ নয়
গ. যাদের হাদীস সংরক্ষণ ক্ষমতা কম; কিন্তু শায়খের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর।
ঘ. যাদের হাদীস সংরক্ষণ ক্ষমতা কম, সে সাথে নিজ শায়খের সাথে সম্পর্কও কম ।
ঙ. যাদের হাদীস সংরক্ষণে ক্ষমতা কম, শায়খের সাথে সম্পর্কও কম এবং সে সাথে অন্যান্য দুর্বলতাও রয়েছে।
আরো জানো : সিহাহ সিত্তাহ কি? কয়টি ও কি কি। সংকলকের নাম সমূহ
ইমাম বুখারী (র) উক্ত পাঁচ শ্রেণির মধ্যে প্রথম প্রকার থেকে যাচাই ছাড়াই রেওয়ায়াত করেছেন এবং দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে যাচাইবাছাই করে বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম মুসলিম (র) প্রথম দু’শ্রেণি থেকে দ্বিধাহীনচিত্তে হাদীস গ্রহণ করেছেন এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে যাচাই করে গ্রহণ করেছেন। এদিক থেকে বুখারী শ্রেষ্ঠ ।
২. ইত্তেসালে সনদ প্রসঙ্গ : ইমাম বুখারী (র) বর্ণনাকারী এবং যার থেকে বর্ণনা করা হয়েছে এ দুয়ের মধ্যে সাক্ষাতের শর্তারোপ করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম মুসলিম (র) উভয়ের সমসাময়িক যুগে হওয়াকেই যথেষ্ট মনে করেছেন ।
৩. সমালোচিত বর্ণনাকারীদের সংখ্যানুপাত : সহীহ বুখারীতে ৪৫৩ জন বর্ণনাকারীর মধ্যে ৮০ জন সমালোচিত রাবী ইমাম বুখারীর শিক্ষক। কিন্তু মুসলিমের ৬২৫ জন রাবীর মধ্যে ১৮০ জনই সমালোচিত; অপরদিকে সমালোচিত রাবীগণের অনেকেই ইমাম মুসলিমের শিক্ষকও নন। সুতরাং বুখারী প্রাধান্যযোগ্য ।
৪. শায এবং মুয়াল্লাল না হওয়া প্রসঙ্গ : উভয় গ্রন্থে রাবীর দোষত্রুটিযুক্ত সর্বমোট ২১০টি হাদীস বিদ্যমান রয়েছে। তন্মধ্যে শুধু সহীহ বুখারীতে ৮০টি এবং সহীহ মুসলিমে ১৯৮টি। উভয় গ্রন্থে আছে ৩২টি। সুতরাং বুখারী অগ্রগণ্য।
আরো জানো : ইমাম বুখারী (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (পয়েন্ট আকারে)
৫. জামে গ্রন্থ : জামে হওয়ার জন্য যে ৮ টি বিষয়সংক্রান্ত হাদীস থাকা দরকার তা বুখারীর মধ্যে বিদ্যমান বিধায় বুখারী একটি জামে গ্রন্থ। কিন্তু সহীহ মুসলিম জামে নয়। যেহেতু এতে তাফসীর অধ্যায় নেই।
৬. হাদীসগ্রহণে সতর্কতা : হাদীসগ্রহণের ব্যাপারে ইমাম মুসলিমের তুলনায় ইমাম বুখারী (র) অধিক সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তিনি সেসব বিশ্বস্ত ও ন্যয়নিষ্ঠ রাবীদের হাদীস গ্রহণ করেছেন যাঁরা তাঁদের উস্তাদের সম্মুখ সাক্ষাতে হাদীস গ্রহণ করার প্রমাণ আছে। পক্ষান্তরে ইমাম মুসলিম (র) উস্তাদ শাগরিদের সাক্ষাৎ হওয়ার প্রমাণের তোয়াক্কা করেননি।
৭. সনদের দীর্ঘসূত্রিতা : সহীহ বুখারীর তুলনায় সহীহ মুসলিমের সনদ দীর্ঘ। সুতরাং বুখারী গ্রহণযোগ্য ।
৮. সুলাসিয়াত প্রসঙ্গ : সহীহ বুখারীতে ২২টি সুলাসিয়াত রয়েছে। পক্ষান্তরে সহীহ মুসলিমে সুলাসিয়াত নেই ।
৯. তরজমাতুল আবওয়াব : সহীহ বুখারীতে ইমাম বুখারী (র) তরজমাতুল আবওয়াব রচনা করেছেন; কিন্তু সহীহ মুসলিমে ইমাম মুসলিম (র) তা করেননি। অবশ্য ইমাম নবুবী (র) পরে তা সংযোজন করেছেন।
১০. অধিক যাচাইবাছাই : ইমাম বুখারী (র) ৬ লক্ষ হাদীস থেকে যাচাইবাছাই করে ১৬ বছরের সাধনায় বুখারী শরীফ রচনা করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম মুসলিম ৪ লক্ষ হাদীস থেকে যাচাইবাছাই করে গ্রন্থ সংকলন করেছেন।
আরো জানো : বুখারী শরীফের বৈশিষ্ট্য, প্রেক্ষাপট ও তার অবদান বিস্তারিত
১১. খতমে বুখারীর অনুষ্ঠান : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে এ উপমহাদেশে সহীহ বুখারীর খতম অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু কোথাও মুসলিমের খতম অনুষ্ঠান হয় না ।
১২. মনীষীদের মন্তব্য : বিশ্বের বিদগ্ধ মুসলিম মনীষীগণ কিতাবুল্লাহর পরে বিশুদ্ধতম গ্রন্থ হিসেবে বুখারীকে নির্বাচিত করে থাকেন। এ থেকে বুখারীর প্রাধান্য প্রমাণিত হয়।
১৩. দারে কুতনীর মন্তব্য : ইমাম দারে কুতনী (র) বলেন- বুখারী না হলে মুসলিমের বিকাশ হতো না। এদিক থেকে মুসলিমকে প্রাধান্য দেয়া যায় না ।
১৪. ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক : ইমাম বুখারী (র)-এর ছাত্র ছিলেন ইমাম মুসলিম (র)। ইমাম বুখারী (র) থেকে তিনি রেওয়ায়াত করেছেন। কিন্তু এর বিপরীতটির প্রমাণ মেলে না । তাই বুখারী শ্রেষ্ঠ।
১৫. রাসূলের কিতাব : ইমাম শাফেয়ী (র)-এর অনুসারী এক প্রখ্যাত আলেম স্বপ্নে সহীহ বুখারীকে রাসূলের কিতাব বলে জেনেছেন। কিন্তু মুসলিমের ব্যাপারে এরূপ জানা যায়নি।
১৬. বুখারীর আত্মপ্রত্যয় : ইমাম বুখারী (র) তাঁর হাদীসগ্রন্থের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন বলেই তিনি কিতাবের নামকরণ করেছেন-(আল জামেউল মুসনাদুস সহীহুল মুখতাসারু মিন উমূরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহী ওয়া আইয়ামিহী)
১৭. হাদীস লেখার পদ্ধতি : ইমাম বুখারী (র) স্বীয় গ্রন্থ লেখার জন্য অযু গোসল করে পবিত্র হয়ে দু’রাকাত নফল নামায আদায় করতঃ ইস্তেখারা করতেন, অতঃপর নিশ্চিত হয়ে হাদীস লিখতেন। ইমাম মুসলিম (র) সতর্কতা অবলম্বন করলেও এমন কর্মের প্রমাণ পাওয়া যায় না।
পরিশেষে : সর্বোপরি উত্তম বর্ণনা ও রচনাশৈলীর বিবেচনায় সহীহ মুসলিম অনন্য শিষ্ট্যমণ্ডিত হলেও বিশুদ্ধতা ও সার্বিক গুণাগুণ বিবেচনায় সহীহ বুখারী মুসলিমের তুলনায় অধিক বিশুদ্ধতম হাদীস সংকলন। হাদীসের বিশুদ্ধতম এ সংকলন দুটি মুসলিম সমাজে চিরদিন অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।