প্রশ্ন : ॥ কবি ফররুখ আহমদ রচিত সাত সাগরের মাঝি কবিতার মূলভাব তোমার নিজের ভাষায় লেখ।
অথবা, ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতার সারাংশ লেখ।
উপস্থাপনা : সাত সাগরের মাঝি’ শীর্ষক কবিতাটি ইসলামী পুনর্জাগরণের কবি, ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ থেকে সংকলিত। কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে একটি গৌরবোজ্জ্বল সংযোজন। এ কবিতায় কবি সুপ্ত মুসলিম জাতিকে জাগরণের আহ্বান জানিয়েছেন।
সাত সাগরের মাঝির পরিচয় : যিনি নৌকা, জাহাজ ইত্যাদি পরিচালনা করেন তাকেই মাঝি বলা হয়। আলোচ্য কবিতায় ‘সাত সাগরের মাঝি’ বলতে কবি মুসলিম জাতি ও তাদের নেতাকে বুঝিয়েছেন।
মুসলমানদের হৃত গৌরব : অন্ধকারে নিমজ্জিত মরু আরবে ইসলামের আলো জ্বালিয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স)। আইয়ামে জাহেলিয়ার অবসানে বিশ্ব যেন আলোর জোয়ারে উদ্ভাসিত হয়েছিল। মহানবি (স)-এর ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলেও ইসলাম তার আপন জ্যোতি ছড়িয়ে দিয়েছিল দুনিয়ার অন্ধকার কোণে কোণে।
আরো পড়ো : স্বাধীনতা তুমি কবিতার মূলভাব /বিষয়বস্তু/সারমর্ম
মরু আরবের সেই আলো আফ্রিকা, ইউরোপ এমনকি ভারতবর্ষকেও আলোকিত করেছিল। মুসলমানরা তাদের খোদাভূক্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে গৌরবমণ্ডিত সভ্যতা সৃষ্টি করেছিল।
মুসলমানদের বর্তমান দুর্দশা : মুসলমানরা বর্তমানে দুর্দশার অতল অন্ধকারে নিমজ্জমান তাদের উত্থান ও উজ্জীবনের সকল দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে। আগের মতো তাদের শৌর্যবীর্য আর জগৎকে চমকিত করে না। বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, রসায়নশাস্ত্রে, গণিতে, পদার্থবিদ্যায়- মোটকথা জ্ঞানের সকল শাখায় নেতৃত্ব দিত মুসলমানরা। সে অতীত গৌরব এখন কেবলই সুস্মৃতি। মুসলমানরা এখন ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন।
পরাধীনতার শৃঙ্খলে মুসলিম জাতি : মুসলমান ছিল স্বাধীনচেতা জাতি, কিন্তু এখন তারা পরাধীন। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শাসন ক্ষমতাসহ কোথাও তাদের উচ্চাসন নেই। সারা বিশ্বে যখন নব জাগরণের জোয়ার এসেছে, তখনো মুসলিম জাতির অবচেতন ঘুম ভাঙেনি। শৃঙ্খলিত, ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন এ জাতির প্রতি কবির বিস্ময়ভরা জিজ্ঞাসা-
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা,
তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?
আরো পড়ো : খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কবিতার- মূলভাব/সারমর্ম/বিষয়বস্তু
মুসলিম জাতির পুনর্জাগরণ কামনা : ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ নিদ্রামগ্ন, বিলাসব্যসনে মত্ত মুসলিম জাতিকে নতুন করে জেগে ওঠার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। সাত সাগরের মাঝিকে কবি বলেছেন-
তুমি উঠে এসো, তুমি উঠে এসো মাঝিমাল্লার দলে
দেখবে তোমার কিশতি আবার ভেসেছে সাগর জলে ।
দুয়ারে অসংখ্য ক্ষুধিত মানুষের ভিড়, সাপের গর্জন। জাতি আজ ভুল পথে এগিয়ে চলেছে, যার কারণে তারা ক্রমাগত পতনের দিকে অগ্রসরমান। এ সময় মুসলিম জাতির কর্ণধারকে জেগে উঠতে হবে। তাদের ভুলে গেলে চলবে না অতীত গৌরব। কবির ভাষায়-
ভুলেছ কি সেই প্রথম সফর জাহাজ চলেছে ভেসে
অজানা ফুলের দেশে।
কবি অতীত গৌরব স্মরণ করিয়ে সাহসের সঞ্চার করতে চান। কোনো দ্বিধা নয়, সংশয় নয়, কবির সুস্পষ্ট আহ্বান-
আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে,
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি
ভাঙা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,
তবুও জাহাজ আজ ছোটাতেই হবে।
কবির পুনর্জাগরণি মনোভাব/কবি-মানস : কবি ফররুখের কাব্যপ্রতিভা প্রাণ পেয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য ও ইসলামী আদর্শ অবলম্বন করে। কবি একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে তার সমস্ত চেতনা রাঙিয়ে তুলেছেন এবং দ্বীন ইসলামকে বর্তমান যুগের পটভূমিতে নতুন বিপ্লবের দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ইসলামের অন্তর্নিহিত ভাব সৌন্দর্যকেই তিনি তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর কবিতায় রূপায়িত করেছেন ।
আরো পড়ো : বঙ্গভাষা কবিতার মূলভাব এবং প্রতি লাইনের ব্যাখ্যা
রোমান্টিক কবি-মানসের অধিকারী কবি ফররুখ আহমদ হৃদয়ের সমস্ত আকুতি দিয়ে কামনা করেছেন, মুসলিম জাতি যেন পুনরায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে বিশ্বের দরবারে। ‘সাত সাগরের মাঝি কবিতায় তার সে কবি-মানসেরই পরিচয় মেলে
কবির দৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বাস : কবি ফররুখ আহমদের বিশ্বাস, প্রত্যয় আর সাহস থাকলে মুসলিম জাতি একদিন তাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারবে। হেরার আলোর প্রোজ্জ্ব শিখায় দূর হবে তাদের জীবনের সকল অন্ধকার। তাই কবির আহ্বান-
তবে পাল খোলো, তবে নোঙ্গর তোলো;
এবার অনেক পথ শেষে সন্ধানী !
হেরার তোরণ মিলবে সমুখে জানি ।
উপসংহার: মুসলিম জাতির নব রেনেসাঁর নেতাকে হতে হবে সত্যনিষ্ঠ, চরিত্রবান আদর্শবান ও আপসহীন। তার চোখে থাকবে জ্যোতিময় স্বপ্ন সম্ভাবনা। তাহলেই মুসলিম জাতি বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে নতুন আকাঙ্ক্ষায় নতুন স্বপ্নে উদ্দীপিত হতে পারবে।
অতীত গৌরবের পথ ধরে তৈরি করতে পারবে ভবিষ্যতের সোনালি সোপান। কবি ফররুখ আহমদ আন্তরিকভাবেই মুসলমানদের গৌরবময় জাগরণের প্রত্যাশী।