প্রশ্ন :।। বাউল সম্রাট লালন শাহের- খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কবিতার মূলভাব তোমার নিজের ভাষায় লেখ।
অথবা, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ কবিতাটির ভাববস্তু নিজের ভাষায় লেখ।
অথবা, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী’ বাউল সম্রাট লালন শাহের একটি অসাধারণ কবিতা। এ কবিতার মূল বক্তব্য /বিষয়বস্তু তোমার নিজের ভাষায় আলোচনা কর।
উপস্থাপনা : লালন শাহ মধ্যযুগের শেষের দিকের একজন বিখ্যাত বাউল কবি। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী তাঁর একটি অনবদ্য কবিতা। এ বিখ্যাত গীতিকবিতায় তিনি জাতি-ধর্মহীন আড়ম্বরপূর্ণ দেহকেন্দ্রিক আধ্যাত্মিক ধর্ম সাধনার অপূর্ব সুধাময় ব্যঞ্জনা চির পরিচিত সহজ-সরল উপমায় অলঙ্কৃত করে উপস্থাপন করেছেন।
পুরান-কুরআন, বেদবেদান্ত এবং পোশাক-পরিচ্ছদসম্পন্ন আচারসর্বস্ব ধর্ম পালনের রীতিতে অবিশ্বাসী লালন শাহ দেহকেন্দ্রিক সাধনা দ্বারা স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী’ নামক গীতিকবিতায়।
মূল বক্তব্য/মূলভাব : নিচে বিভিন্ন শিরোনামে আলোচনার মাধ্যমে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী’ কবিতার মূল বক্তব্য/মূলভাব উপস্থাপন করা হলো :
লালন শাহের জীবনদর্শন : লালন শাহ ধর্মের প্রচলিত সংকীর্ণতা গ্রহণ করেননি। ধর্মের বেশভূষা, আচার-আচরণ কোনোটাতেই লালন শাহের বিশ্বাস ছিল না। তাঁর ভাষায়-
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন কয়, জাতের কিরূপ, দেখলাম না এক নজরে ।
বৌদ্ধ ধর্মের তান্ত্রিকতা, হিন্দু ধর্মের শক্তি ও ফকিরী মতবাদ বাউল মতকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু লালন শাহ হিন্দুদের শক্তি ও মুসলমানদের তাসাউফ কিংবা সুফী মত দ্বারা প্রভাবিত হয়েও এর মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি। সাংসারিক জীবনের বাইরে থেকে লালন শাহ সংগীতমুখর।
আরো পড়ো : ঐকতান কবিতার মূলভাব ও কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা
দেহকেন্দ্রিক সাধনা দ্বারা পরমাত্মাকে পেতে চেয়েছেন। কবির মতে, স্রষ্টাকে পেতে ঢাকা কিংবা দিল্লিতে খুঁজে বেড়ানোর দরকার নেই। অন্য কথায় আনুষ্ঠানিকভাবে তীর্থস্থান ভ্রমণের মাধ্যমে পরমাত্মার সন্ধান করতে যাওয়ার দরকার হয় না। তিনি আত্মারূপে মানুষের হৃদয়ে অবস্থান করেন। যেমন তিনি অন্যত্র বলেন-
আত্মারূপে কর্তাহরি
মনের নিষ্ঠা হলে মিলবে তারি ঠিকানা
বেদবেদান্ত পড়বে যত বাড়বে তত লক্ষণা।
লালন শাহ পরম আরাধ্য কাঙ্ক্ষিত স্রষ্টাকে কখনো কখনো মনের মানুষ, অচিন পাখী কিংবা অলক সাঁই অভিধায় অভিহিত করেছেন। ‘হারামনি’ নামক লোকসংগীত গ্রন্থের সংগ্রাহক মনসুরউদ্দিন বাউলদের মনের মানুষ সম্পর্কে বলেছেন, “বাউলরা মনের মানুষের সন্ধানে ঘুরিতেছে ।
মনকে ইহাতে পারিভাষিক শব্দে মগজ বলিয়া ধারণা করা যায়। মগজই আমাদের জীবনের নিয়ামক। মগজ যাহা ভালোবাসে তাহাই আমাদের প্রিয় ও ভালোবাসার ধন। বাউলদের ব্যবহারিক জীবনদর্শন আশ্চর্য। বাউলরা অধ্যাত্মবাদী, কিন্তু এই অধ্যাত্মবাদ দেহাত্মবাদকে অবলম্বন করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে।
জড়মানবদেহ তাহাদের প্রধান সাধন লক্ষণ ও অবলম্বন।” লালন শাহ দেহাত্মবাদের সাহায্যে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী’ নামক গীতিকবিতায় অচিন পাখী ও খাঁচার প্রতীকে নিজস্ব ভাবনা প্রকাশ করেছেন।
আরো পড়ো : বঙ্গভাষা কবিতার মূলভাব এবং প্রতি লাইনের ব্যাখ্যা
অচিন পাখি ও খাচার রূপক অর্থ : আধ্যাত্মিক রহস্যময় পুরুষ লালন শাহ রূপক ও প্রতীকের ব্যবহারের সাহায্যে বাউল মতের সাধনাকে সুদূরে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এ গীতিকবিতায় তিনি মানুষের দেহকে খাঁচার সঙ্গে তুলনা করে দেহের নশ্বরতা বোঝাতে বলেছেন-
খাঁচা যে তোর তৈরী কাঁচা বাঁশে,
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে।
অর্থাৎ কচি বাঁশের তৈরি বস্তু অপেক্ষাকৃত কম দিন টিকে। মানবাত্মারূপী কাঙ্ক্ষিত আরাধ্য বিমূর্ত স্রষ্টাকে পাখিরূপে বর্ণনা করেছেন। আমরা কোনোদিন আত্মাকে দেখতে পাইনি। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে অচিন পাখি খাঁচার ভেতরে-বাইরে আসা-যাওয়া করে। সেখানে তিনি স্থায়ীরূপে অনন্তকাল বসতি স্থাপন করেন না। খাঁচা ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অচিন পাখি আমাদের অগোচরে পালিয়ে যাবে। যেমন লালনের ভাষায়-
লালন কয় খাঁচা খুলে
সে পাখী কোনখানে পালায় ।
কবিতার ভাব : কবিতাটির বাহ্যিক অর্থ সহজ-সরল হলেও এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আমাদের নিকট দুর্বোধ্য। এ গীতিকবিতায় বাউল সম্রাট লালন শাহ সমাজ-সংসার বিবর্জিত বাউলদের অধ্যাত্মবাদ সাধনার সুনির্দিষ্ট পরামর্শ প্রদান করেছেন।
সাধারণ মানুষ যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য বাউলরাও চর্যাকারদের মতো রূপক ও প্রতীকের সাহায্যে তাদের দেহকেন্দ্রিক সাধনার সুরবার্তা শিষ্যদের জন্য রেখে যেতেন। অনেক গবেষক হয়তো এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত পণ্ডশ্রম হয়েছে কিনা তা বাউল সম্প্রদায়ই বলতে পারে।
আরো পড়ো : বনলতা সেন কবিতার মূলভাব ও নামকরণের সার্থকতা – pdf
সৃষ্টিজগতের মধ্যমণি স্রষ্টা বিমূর্ত নিরাকার। তাঁকে অনুভব করা যায় তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে, কিন্তু তাঁকে দেখা যায় না। সুফীবাদ কিংবা বৈষ্ণববাদের মতো বাউলরা বিশ্বাস করে, সৃষ্টি স্রষ্টার অংশ। সৃষ্টিতে স্রষ্টা বিরাজমান। বাউল সম্রাট লালনের মতে, মানুষের দেহে আত্মারূপে স্রষ্টা বসবাস করে। অতএব নিজের দেহকে চিনতে পারলে স্রষ্টাকে চেনা যায়। যেমন তিনি অন্যত্র বলেছেন-
একবার আপনারে চিনতে পারলে রে যাবে অচেনারে চেনা।
এ অচেনাকে এ গীতিকবিতায় কবি লালন শাহ অচিন পাখিরূপে বর্ণনা করেছেন। তিনি এ পাখির দেহরূপ খাঁচায় প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া অনুভব করেন, কিন্তু ধরতে পারেন না। তা প্রকাশ করেছেন এভাবে-
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায় ।।
তবে লালন শাহ দেহের অভ্যন্তরে পাখির প্রবেশ, প্রস্থানের পথ এবং অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছেন। তাঁর মতে, দেহের আট কুঠুরি, নয় দরজা এবং অন্যান্য ঝলকা কাটার অবস্থান ও কার্যপ্রণালি এবং আমাদের কর্তব্য জানতে পারলে অচিন পাখিকে চেনা যাবে। শিশমহল সদর-কোঠায় উপবিষ্ট হয়ে আকাঙ্ক্ষিত আলোর ঝলকানি আমরা দেখতে পাব।
কবির আক্ষেপ সাধারণ মানুষ খাঁচারূপী দেহের পরিচর্যা করে। তার সৌন্দর্য ও কল্যাণ নিয়ে চিন্তিত থাকে। আর মানুষের পরিচর্যাকৃত পরম প্রাণপ্রিয় দেহ একদিন কাঁচা বাঁশের ভঙ্গুর খাঁচার ন্যায় খসে পড়ে। অচিন পাখি সে মুহূর্তে পালিয়ে যায়। এ কারণে আলোকিত আরশিনগর পড়শির সাথে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে না।
উপসংহার : সাধক পুরুষ লালন শাহ তাঁর ছোট পরিসরের কবিতায় সহজ-সরল, প্রচলিত- পরিচিত উপমার আড়ালে বাউল সাধকদের জন্য সুর সাধনার সুধা ছড়িয়ে দিয়েছেন ৷ দেহকেন্দ্রিক দুর্বোধ্য সাধনায় যারা সার্থক হবে তারা লালন শাহের অচিন পাখির সাক্ষাতের সুধা পান করতে পারবে। রূপক, প্রতীক, উপমা ও সহজ-সরল শব্দ ব্যবহারে কারুকার্য কবিতাটি হৃদয়স্পর্শী হয়েছে।