উপস্থাপনা : রাসূল (স)-এর ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরাম (রা) হাদীস সংকলনে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে হাদীস সংকলনের একটি পরিকল্পিত আয়োজন করেন উমাইয়া খলিফা হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (র)।
এ ধারাবাকিকতায় হিজরী তৃতীয় শতকে হাদিস সংকলনের স্বর্ণযুগ সূচিত হয়। এ যুগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রখ্যাত মুহাদ্দিসীনে কেরাম হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
হাদিস সংকলনের স্বর্ণযুগ :
The Encyclopedia of Islam গ্রন্থে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীকে হাদিস সংকলনের স্বর্ণযুগ আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে – The third century was the time when important musannaf (classified) works were compiled. মূলত হাদীস সংকলনের উন্নতি ও বিকাশ এ শতাব্দীতে পূর্ণতা পায়।
মুহাদ্দিস ও হাদীস বর্ণনাকারীগণ হাদীসের সন্ধানে এ সময় মুসলিম জাহানের প্রতিটি অঞ্চল ভ্রমণ করেন এবং পূর্ণ সনদসম্পন্ন হাদীসসমূহ স্বতন্ত্রভাবে সজ্জিত ও সুবিন্যস্ত করেন।
এ সময় সনদ ও বর্ণনাসূত্রের ধারাবাহিকতা ও বিশুদ্ধতা বিচারের জন্য ‘আসমাউর রিজাল’ নামে ভিন্নধারার এক পরীক্ষণ বিজ্ঞান উদ্ভাবিত হয়। তাছাড়া ‘তানকীদুল হাদীস’ শীৰ্ষক হাদীস যাচাইবাছাই, পরীক্ষণ নিরীক্ষণ ও সত্য মিথ্যা নির্ধারণের স্বতন্ত্র বিজ্ঞান উৎপত্তি লাভ করে ।
আরো জানো : সিহাহ সিত্তাহ কি? কয়টি ও কি কি। সংকলকের নাম সমূহ
স্বর্ণযুগের হাদীস সংকলকগণ :
হিজরী তৃতীয় শতকে ইলমে হাদীস পূর্বাপেক্ষা অধিক উন্নতি, অগ্রগতি, প্রসারতা ও ব্যাপকতা লাভ করে। এ সময় হাদীস একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর এক একটি বিভাগ সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্রভাবে গঠিত হয়। আর এক্ষেত্রে যে সকল খ্যাতিমান মনীষী অবদান রাখেন, তাদের সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো-
১. ইমাম বুখারী (র) : হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে হাদীস সংকলনের যে স্বর্ণালি অধ্যায় রচিত হয়, ইমাম বুখারী (র) সে অধ্যায় সূচনার পথিকৃৎ। তাঁর পূর্ণ নাম ইমামুদ দুনইয়া ফিল হাদীস আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম। তিনি উজবেকিস্তানের বুখারা নগরে ১৯৪ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন।
হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি বলখ, বাগদাদ, মক্কা, মদিনা, বসরা, কুফা, আসকালান, হিমস, দামেস্ক প্রভৃতি অঞ্চল ভ্রমণ করেন। হাদীসশাস্ত্রে তাঁর অসামান্য অবদান হলো ‘আল জামেউস সহীহ লিল বুখারী’ গ্রন্থনা। দীর্ঘ ১৬ বছরের সাধনায় সংগৃহীত ৬ লক্ষাধিক হাদীস যাচাইবাছাই করে মাত্র ৭৩৯৭টি হাদীস নিয়ে তিনি অমর এ সংকলনখানা প্রণয়ন করেন। বিশুদ্ধতার বিচারে আল কুরআনের পরেই এর স্থান।
আরো জানো : ইমাম বুখারী (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (পয়েন্ট আকারে)
২. ইমাম মুসলিম (র) : ইমাম মুসলিম (র)-এর পূর্ণ নাম আবুল হোসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন নিসাপুরী। তিনি ২০৪ হিজরী সালে খোরাসানের অন্তর্বর্তী নিসাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শৈশবকাল থেকেই হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মুসলিম জাহানের সবকটি কেন্দ্রেই গমন করেন।
তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর সাধনা করে তিন লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে মাত্র ৭৩৯১টি হাদীসের সমন্বয়ে ‘সহীহ মুসলিম’ নামক হাদীসগ্রন্থ রচনা করে হাদীস সংকলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন ।
আরো জানো : ইমাম মুসলিম রহ এর জীবনী (পয়েন্ট ভিত্তিক)- pdf
৩. ইমাম নাসায়ী (র) : আবদুর রহমান আহমদ ইবনে শোয়াইব আন নাসায়ী (র) খোরাসানের নাসা নামক শহরে ২১৫ হিজরী সালে জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম নাসায়ী (র) হাদীসের বড় হাফেয ছিলেন। হাদীস সংকলনের ইতিহাসে তিনি ‘সুনানে নাসায়ী’ নামক হাদীসগ্রন্থ প্রণয়নের মাধ্যমে স্মরণীয় হয়ে আছেন। এছাড়াও তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে ‘সুনানু কুবরা’ ও ‘সুনানু সুগরা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
৪. ইমাম আবু দাউদ (র) : সোলায়মান ইবনুল আশয়াস ইবনে ইসহাক আল আযদী আস সিজিস্তানী (র) ২০২ হিজরী সালে সিজিস্তান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাঁচ লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করে তন্মধ্য থেকে মাত্র ৪৮০০টি হাদীস নিয়ে ‘সুনানু আবু দাউদ’ নামক একখানা অনবদ্য গ্রন্থ রচনা করেন।
৫. ইমাম তিরমিযী (র) : আল ইমামুল হাফিয আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত তিরমিযী (র) ২০৯ হিজরীতে প্রাচীন তিরমিয শহরে জন্মগ্রহণ করেন। হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে ইমাম তিরমিযী (র)-এর কালোত্তীর্ণ অবদান তাঁর সুনানে তিরমিযী, যা আল জামেউ লিত তিরমিযী নামেও খ্যাত।
৬. ইমাম ইবনে মাজাহ (র) : আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযিদ ইবনে মাজাহ আল কাযভীনী (র) ২০৯ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ‘সুনানে ইবনে মাজাহ’ তৃতীয় শতাব্দীর হাদীস সংকলনের ধারায় উজ্জ্বল সংযোজন। বেশিরভাগ হাদীস গবেষক তাঁর সুনানটিকে সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভুক্ত একখানা মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করেছেন।
অন্য মুহাদ্দিসগণ : সিহাহ সিত্তার সংকলক এ ছয়জন মহান মুহাদ্দিস ছাড়াও অন্য যে সকল মুহাদ্দিস পূর্বাপর হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েক জনের নাম, পরিচয় ও সময়কাল সংক্ষিপ্ত পরিসরে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. আলী ইবনুল মাদানী (র) (১৬১-২৪৩ হিঃ) : তিনি ছিলেন একজন জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস। তিনি একজন বিখ্যাত গ্রন্থ প্রণেতাও ছিলেন। হাদীস সম্পর্কিত ইলমের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তিনি বহুসংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
২. ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন (র) (মৃত্যু ২৩৩ হিঃ) : তৃতীয় শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের মধ্যে ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন অন্যতম। তিনি হাদীস শিক্ষায় স্বীয় জান ও মাল অকাতরে উৎসর্গ করেছিলেন ।
৩. আবু মুররা আর রাযী (র) (মৃত্যু ২৬৪ হিঃ) : তিনি একজন বিখ্যাত হাফেযে হাদীস ছিলেন। ইমাম আবু দাউদ (র) ছাড়া সিহাহ সিত্তার অপর পাঁচজন মুহাদ্দিসই ছিলেন তাঁর ছাত্র। তিনি সনদসহ এক লক্ষ হাদীস লিখেছিলেন।
৪. আবু হাতেম আর রাযী (জন্ম ১৯৫ হিঃ) : তিনি ইমাম বুখারীর সমসাময়িক মুহাদ্দিস ছিলেন। প্রচণ্ড পরিশ্রম ও কঠোর সাধনা করে তিনি হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন করেন।
৫. মুহাম্মদ ইবনে জারীর আত তাবারী (২২৪-৩১০ হিঃ) : তিনি ছিলেন ইমাম তিরমিযী ও নাসায়ীর সমকালীন মুহাদ্দিস। ইবনে কাসীর (র) বলেছেন, আত তাবারী হাদীসগ্রন্থ সংকলন করেছেন ।
৬. ইবনে খোযায়মা (মৃত্যু ৩১১ হিঃ) : ইমাম দারে কুতনী (র) বলেছেন, ইবনে খোযায়মা (র) হাদীসের প্রতিষ্ঠালব্ধ ইমাম ছিলেন। তিনি হাদীস ও দীনি মাসয়ালা সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ লিখেছেন ।
৭. ইবনে সায়াদ (জন্ম ১৬৮ হিঃ) : সীরাত গ্রন্থকার হিসেবে পরিচিত হলেও মূলত তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস। হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন ।
৮. ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (১৬১-২৩৮ হিঃ) : তিনি হাদীস শিক্ষার জন্য প্রায় সকল কেন্দ্রে গমন করেন। তারপর নিজের সংগৃহীত হাদীসগুলো থেকে বিভিন্ন সংকলন প্রকাশ করেন।
৯. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল : তিনি ছিলেন ইলমে হাদীসে এক অনন্য সাধারণ সুদক্ষ মুহাদ্দিস। তাঁর সংকলিত মুসনাদে আহমদ হিজরী তৃতীয় শতকের একটি পরীক্ষিত ও অপূর্ব গ্রন্থ। এটাকে হাদীসশাস্ত্রের বিশ্বকোষ বললেও অত্যুক্তি হবে না ।
উপসংহার : হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে একদিকে যেমন হাদীস সংগ্রহ, সংকলন, গ্রন্থ প্রণয়ন ও হাদীস সম্পর্কিত জরুরি জ্ঞানের অপূর্ব সমাবেশ ঘটে, অপরদিকে মুসলিম জনগণের মধ্যে হাদীস শিক্ষা ও চর্চার অদম্য উৎসাহ এবং বিপুল আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং সঙ্গত কারণেই হিজরী তৃতীয় শতাব্দীকে ‘হাদিস সংকলনের স্বর্ণযুগ’ বলা যথার্থ হবে ।