হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

ইমাম ইবনে মাজাহ এর জীবনী ও ইবনে মাজাহর বৈশিষ্ট্য

উপস্থাপনা : সিহাহ সিত্তার তালিকায় সর্বশেষ সহীহ গ্রন্থ সুনানু ইবনে মাজাহ। এর সংকলক হলেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে মাজাহ (র)। ইলমে হাদীসের খেদমতে তিনি উৎসর্গ করেন তাঁর সমগ্র জীবন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ সুনানু ইবনে মাজাহ। নিম্নে ইমাম ইবনে মাজাহ (র)-এর জীবনী ও তাঁর সুনানগ্রন্থের বৈশিষ্ট্যসমূহ সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো ।

ইমাম ইবনে মাজাহ (র) এর জীবনী :

১. নাম ও পরিচয় : তাঁর পূর্ণনাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযিদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাজাহ আল কাযভীনী।

২. জন্ম : তিনি ২০৯ হিজরীতে ইরাকে আযম বা উত্তর-পশ্চিম ইরাকের কাযভীন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।

৩. বাল্যকাল : ইমাম ইবনে মাজাহ (র) বাল্যকাল থেকেই হাদীস শিক্ষার অপূর্ব সুযোগ লাভ করেন। কারণ তিনি যে শহরে জন্মগ্রহণ করেন সে কাযভীন শহরটি খোলাফায়ে রাশেদার তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা)-এর শাসনামলে বিজিত হওয়ার পর হতেই ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। এমনকি হিজরী তৃতীয় শতকের শুরু থেকেই এটা ছিল ইলমে হাদীসের প্রাণকেন্দ্র।

আরো পড়ো : ইমাম নাসায়ী (র) এর জীবনী ও নাসায়ীর বৈশিষ্ট্যসমূহ

8. শিক্ষাজীবন : বয়োপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকেই মহানবী (স)-এর হাদীস সংগ্রহ করার জন্য মনোনিবেশ করেন। এজন্য তিনি বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতদের নিকট থেকে নানা বিষয়ে জ্ঞান আহরণপূর্বক স্বীয় পিপাসা নিবৃত্ত করেন।

৫. শিক্ষকমণ্ডলী : ইমাম ইবনে মাজাহ (র)-এর অসংখ্য উস্তাদ ছিলেন। তন্মধ্যে আলী ইবনে মুহাম্মদ আবুল হাসান তানফেসী, আমর ইবনে রাফে, আবু হাজার বিজলী, ইসমাঈল ইবনে মুসা ইবনে হাইয়ান তামীমী এবং মুহাম্মদ ইবনে আবু খালেদ আবু বকর কাযভীনী (র)-এর মতো বড় বড় মুহাদ্দিসের নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করেন।

৬. দেশভ্রমণ : হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি মদিনা, মক্কা, কুফা, বসরা, বাগদাদ, ওয়াসত, দামেস্ক, হিমস, মিসর, তিন্নীস, ইস্পাহান প্রভৃতি হাদীসের কেন্দ্রসমূহ সফর করেন।

৭. ছাত্রবৃন্দ : ইমাম ইবনে মাজা (র)-এর অসংখ্য ছাত্র ছিল। এদের মধ্যে আবুল হাসান কাত্তান ও ঈসা ইবনে আবসার (র) প্রমুখ প্রসিদ্ধ ছিলেন।

৮. রচনা : ইমাম ইবনে মাজাহ (র) অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে-

ক. তাঁর রচিত হাদীসের আলোকে কুরআন মাজীদের বিরাট তাফসীর গ্রন্থটি শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ।

খ. তারীখে মীলীহ। এতে সাহাবীদের যুগ থেকে গ্রন্থকারের সময় পর্যন্ত বিস্তারিত ইতিহাস আলোচিত হয়েছে ।

গ. আস সুনান। হাদীসে এটা তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি, যা সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভুক্ত প্রসিদ্ধ কিতাব।

আরো পড়ো : ইমাম আবু দাউদ(রহ)এর জীবনী ও আবি দাউদের বৈশিষ্ট্য

৯. গুণাবলি : তিনি বহুবিধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে মনীষীগণের অভিমত নিম্নরূপ-

ক. আবু ইয়ালা খালিলী আল কাবিনী (র) বলেন, ইমাম ইবনে মাজাহ (র) একজন বড় আলেম ছিলেন।

খ. ইবনে কাসীর (র) বলেন, তাঁর রচিত গ্রন্থই তাঁর আমল ইলমের গভীরতা ও তাকওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে । তিনি একজন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফিকহবিশারদ ছিলেন।

১০. ইন্তেকাল : তিনি কোথায় ইন্তেকাল করেছেন, তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে এতটুকু জানা যায়, তিনি ২৭৩ হিজরী সনে রোজ সোমবার ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।

সুনানু ইবনে মাজাহর বৈশিষ্ট্য :

ইমাম ইবনে মাজাহ (র) কর্তৃক প্রণীত সুনানে ইবনে মাজাহ গ্রন্থটির রচনাশৈলী, সংযোজন, সজ্জায়ন অতি চমৎকার। নিম্নে গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচিত হলো-

১. সুনান : ইমাম ইবনে মাজাহ (র) কর্তৃক প্রণীত গ্রন্থটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গ্রন্থটি সুনান। ইমাম ইবনে মাজাহ (র) গ্রন্থটির অধ্যায়সমূহ ফিকহশাস্ত্রের অনুসরণে বিন্যাস করেছেন বিধায় একে সুনান নামে নামকরণ করেছেন। সুতরাং গ্রন্থটির সুনান নামকরণ সার্থক হয়েছে।

আরো পড়ো : সহীহ মুসলিম শরীফের বৈশিষ্ট্য – পয়েন্ট আকারে

২. প্রখ্যাত ব্যক্তিদের স্বীকৃতি : ইমাম ইবনে মাজাহ (র) গ্রন্থটির প্রণয়নকার্য সমাপ্ত করে প্রখ্যাত হাদীসবিদদের নিকট পেশ করেন। নিম্নে তাঁদের মতামত প্রদত্ত হলো-

ক. ইবনে মাজার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ইমাম আবু যুরয়ার নিকট এ গ্রন্থটি পেশ করা হলে তিনি বলেন- আমার ধারণা, যদি এ গ্রন্থ মানুষের হাতে পৌছে তাহলে পূর্ববর্তী অধিকাংশ গ্রন্থ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে।

খ. প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (র) গ্রন্থটির উচ্চ প্রশংসা করে বলেন, প্রকৃতপক্ষে সজ্জায়ন, সৌন্দর্য ও পুনরাবৃত্তি ব্যতীত হাদীসসমূহ একের পর এক উল্লেখ করা এবং তদুপরি সংক্ষিপ্তকরণ প্রভৃতি বিশেষত্ব এ কিতাবে যা পাওয়া যায়, অপর যেকোনো কিতাবে তা দুর্লভ।

গ. হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (র) বলেন- ইমাম ইবনে মাজার সুনান গ্রন্থ অত্যন্ত ব্যাপক হাদীস সমন্বিত ও উত্তম।

ঘ. হাফেয ইবনে কাসীর (র) বলেন- এটা অত্যন্ত চমকপ্রদ গ্রন্থ । ফিকহের দৃষ্টিতে এর অধ্যায়সমূহ খুবই চমৎকার ও মযবুত।

৩.অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ এবং হাদীস সংখ্যা : এ গ্রন্থে ৩২টি অধ্যায় ও ১৫০০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। উল্লিখিত অধ্যায় ও পরিচ্ছেদের অধীনে প্রায় চার হাজার হাদীস সন্নিবদ্ধ করা হয়েছে। তন্মধ্যে ১৩৩৯টি এমন হাদীস রয়েছে, যা সুনানে ইবনে মাজাহ ছাড়া অন্য কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না।

৪. বিশেষত্ব : সিহাহ সিত্তার অন্যান্য গ্রন্থ থেকে এ গ্রন্থটির পৃথক দুটি বিশেষত্ব পরিলক্ষিত হয়। যথা-

প্রথমত : এর রচনা ও সংযোজন, সজ্জায়ন, সৌকর্য। এতে হাদীসসমূহ এক বিশেষ সজ্জায়ন পদ্ধতিতে ও অধ্যায় ভিত্তিতে সাজানো হয়েছে। কোথাও পুনরাবৃত্তি ঘটেনি অপর কোনো কিতাবে এ সৌন্দর্য দেখা যায় না ।

দ্বিতীয়ত : এর জনপ্রিয়তা পূর্ববর্তী সকল হাদীসগ্রন্থকে ছাড়িয়ে গেছে।

৫. ব্যবহারিক মূল্য : এ গ্রন্থে এমন সব হাদীস উল্লিখিত হয়েছে, যা সিহাহ সিত্তার অপর কোনো গ্রন্থে উল্লিখিত হয়নি। এ কারণে গ্রন্থটির ব্যবহারিক মূল্য অন্যান্য গ্রন্থাবলির তুলনায় অনেক বেশি। আল্লামা আবুল হাসান সিনটী (র) তাঁর ইবনে মাজার শরাহ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন-

كانَ المُصَنِّفُ رَحِمَهُ اللهُ تَعَالَى تَبِعَ مُعاذًا حَيْثُ أَخْرَجَ عَنِ المُتُونِ فِي كَثِيرٍ مِنَ الأَبْوابِ مَا لَيْسَ فِي الكُتُبِ الخَمْسَةِ المَشْهُورَةِ.

অর্থাৎ, গ্রন্থকার এতে হযরত মুয়ায ইবনে জাবালের রীতি অনুসরণ করেছেন। বেশ কয়েকটি অধ্যায়ে তিনি এমন সব হাদীস উদ্ধৃত করেছেন, যা অপর প্রখ্যাত পাঁচটি গ্রন্থে নেই ।

হযরত মুয়াযের রীতি অনুসরণ করার অর্থ হলো, তিনি প্রায়ই এমন সব হাদীস বর্ণনা করতেন, যা অন্যান্য সাহাবীর শ্রুতিগোচর হয়নি।

৬. বিন্যাস পদ্ধতি : ইমাম ইবনে মাজাহ (র) অপরিসীম শ্রম ও সাধনা এবং লক্ষ লক্ষ হাদীস যাচাইবাছাই করার পর গ্রন্থটির প্রণয়নকার্য সম্পন্ন করেছেন। তিনি লক্ষ লক্ষ হাদীস বাছাই করে চার হাজার হাদীসকে বিভিন্ন অধ্যায়ে সাজিয়েছেন ।

৭. প্রসিদ্ধ রাবী : ইমাম ইবনে মাজাহ (র) অসংখ্য বর্ণনাকারী থেকে হাদীস গ্রহণ করে থাকলেও এ গ্রন্থের প্রসিদ্ধ রাবী বা বর্ণনাকারীগণ হলেন- ১. আবু হাসান কাত্তান, ২. সোলায়মান ইবনে ইয়াযিদ, ৩. আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে ঈসা, ৪. আবু বকর হামেদ আযহারী (র)।

৮. সুলাসী হাদীস : এ বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থে ৫টি সুলাসী তথা তিন রাবীবিশিষ্ট হাদীস রয়েছে। এ পাঁচটি হাদীসের সনদ একই ব্যক্তি থেকে বর্ণিত।

৯. ত্রুটিমুক্ত হাদীস : সুনানে ইবনে মাজাতে খুব অল্পসংখ্যক হাদীসই ত্রুটিযুক্ত। এ গ্রন্থের ত্রুটি সম্পর্কে ইমাম আবু যুরয়া (র)-এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন-

طَالِعْتُ كِتَابَهُ أَيُّ عَبْدِ اللهِ ابْنِ مَاجَةَ فَلَمْ أَجِدْ فِيهِ إِلَّا قَدْرًا يَسِيرًا مِمَّا فِيهِ شَيْءٌ وَذِكْرٌ قَرِيبٌ بِضْعَةَ عَشَرَ.

অর্থাৎ, ইমাম আবু যুরয়া (র) বলেছেন, আমি আবু আবদুল্লাহ ইবনে মাজাহ (র)-এর হাদীসগ্রন্থ অধ্যয়ন করেছি, কিন্তু এতে খুব অল্প হাদীসই ত্রুটিযুক্ত পেয়েছি। এছাড়া আর কোনো দোষ পাইনি। অতঃপর এ পর্যায়ে তিনি দশটির কিছু বেশি হাদীসের উল্লেখ করলেন।

১০. স্থান : ইবনে মাজাহ গ্রন্থে সিহাহ সিত্তার অপর পাঁচটি গ্রন্থের তুলনায় যয়ীফ হাদীসের সংখ্যা একটু বেশি হওয়ার কারণে ছয়টি হাদীস গ্রন্থের মধ্যে এর স্থান সর্বশেষে। মুহাদ্দিস সিনদী (র) বলেন- অর্থাৎ, যাই হোক, মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়ে ইবনে মাজাহ গ্রন্থটি অপর পাঁচটি গ্রন্থের নিচে ও পরে অবস্থিত।

পরিশেষে : যয়ীফ হাদীসের সমাবেশ সত্ত্বেও সুনানে ইবনে মাজাহ একটি বিশুদ্ধতম গ্রন্থ, যা আজও মুসলিম বিশ্বের শিক্ষালয়গুলোতে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। আর এটা সম্ভব হয়েছে, পুনানে ইবনে মাজার আপন বৈশিষ্ট্যের কারণেই।

শিক্ষাগার

প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

মাহমুদুল হাসান

শিক্ষাগত যোগ্যতা
গণিতে অনার্স ও মাস্টার্স

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফাজিল সম্পন্ন

গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা

বিশেষ দক্ষতা

বাংলা সাহিত্য • গণিত • ইসলামিক শিক্ষা

অভিজ্ঞতা

শিক্ষকতা ও ৫+ বছর কন্টেন্ট রাইটিং

আমাদের লক্ষ্য

শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা। ২০২৩ সাল থেকে লাখো শিক্ষার্থী শিক্ষাগার থেকে উপকৃত হচ্ছে।

Leave a Comment