হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

একরাত্রি গল্পের প্রেমের স্বরূপ বিশ্লেষণ কর

প্রশ্ন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একরাত্রি গল্পে বর্ণিত প্রেমের স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।

অথবা, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একরাত্রি গল্প একটি অপরিণত প্রেমের উপাখ্যান” আলোচনা কর।

অথবা, “বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলে দেয়” – উক্তিটি ‘একরাত্রি’ গল্পের সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ? তা আলোচনা কর।

উপস্থাপনা : বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোটগল্পের রচয়িতা বিশ্বকবি খ্যাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত ‘একরাত্রি’ একটি অসাধারণ ছোটগল্প। গল্পটি তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি মূলত প্রেমের গল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও মানব-মানবীর শাশ্বত প্রেমকে গল্পকার একটি ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন।

রসঘন বাক্যালংকারে গল্পের প্রতিটি লাইন হয়ে উঠেছে রোমান্টিকতায় ভরপুর। নিচে প্রশ্নালোকে বিস্তারিত বিবরণ উপস্থাপন করা হলো ।

প্রেমের স্বরূপ : প্রেমের ইংরেজি প্রতিশব্দ Love. Oxford Dictionary-তে Love সম্পর্কে বলা হয়েছে- A strong feeling of affection. মূলত প্রেম মানবজীবনের এক মৌলিক ও প্রবল অনুভূতি। প্রেমের মধ্যে একটি মানবহৃদয় অন্য একটি মানবহৃদয়ের সন্ধান পায়।

আবার প্রেমের বেদনা মানুষকে রিক্ততার অতলান্তে নিক্ষেপ করে। প্রেম একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি হলেও সমাজ-সংসারের প্রথা-পদ্ধতি দ্বারা ব্যক্তির অনুভূতি প্রভাবিত ও রূপায়িত হয়। প্রেমে আছে মিলনের নিবিড় আনন্দ আর বিরহের মর্মচ্ছেদী গভীর যন্ত্রণা।

আরও জানো : একরাত্রি গল্পের বিষয়বস্তু / মূলভাব / মূল বক্তব্য

মানবিক চর্চার উৎকৃষ্ট প্রবাহে মানুষের সহজাত আকর্ষণে সমগ্র চেতনা পরিব্যাপ্ত হলে কামনা-বাসনা প্রশমিত করে প্রেমের উন্মেষ ঘটে। এ প্রেম মানবজীবনের পরম কাঙ্ক্ষিত সম্পদ, বেঁচে থাকার অবলম্বন । প্রেমে মিলনের চেয়ে বিরহই অধিক বলে প্রেম এত মধুর।

‘একরাত্রি’ গল্পে প্রেমের স্বরূপ : প্রেমের গল্প ‘একরাত্রি’র রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চৈতন্যে প্রেমসত্তার অর্ধেক বাস্তবতা আর অর্ধেক কল্পনা। ‘একরাত্রি’ গল্পে প্রেমের ক্ষেত্রে প্রাপ্তি নয় বরং প্রাপ্তির প্রত্যাশা, মিলন নয় বরং মিলনাকাঙ্ক্ষাই শাশ্বত রূপ পেয়েছে।

যে প্রেম বুভুক্ষিত দৃষ্টিতে দেহের চারপাশে ঘুরে মরে, ব্যক্তি মানুষের বাস্তব দেহমন যার ভিত্তি, সেই প্রেম অসীম, অনন্তের ধন, আত্মার সম্পদ, তাকে দেহের সীমানায় ধরা যায় না। তা আবেগময় আত্মহারা মানুষের সাধারণ প্রেম একরাত্রি’ গল্পের প্রেম নয়। এ গল্পে দেখা যায়, অনুভূতিলব্ধ গুপ্ত প্রেম, যার প্রকাশ ঘটেছে বহু বিলম্বে।

আরও জানো : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের- একরাত্রি গল্পের নামকরণের সার্থকতা

কৈশোরের এক জোড়া বালক- বালিকা পরস্পরের কাছাকাছি থেকেও একে অন্যকে প্রেমে আবদ্ধ করতে পারেনি। তাই যৌবনে নায়ক নায়িকাকে বিয়ে করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে । আর নায়িকার বিয়ে হয়ে যায় এক উকিল বাবুর সাথে।

জীবনের উত্থান-পতনের সিঁড়ি বেয়ে নায়ক একদিন সুদূর নোয়াখালীর এক ছোট শহরে গিয়ে নায়িকা সুরবালার প্রতিবেশী হয়েছে। নায়কের অবচেতন মনে বাল্যকালে যে প্রেমের অঙ্কুরোদগম হয়েছিল, তা ফুলে ফলে বিকশিত হয়েছে। এখন সারাক্ষণই নায়কের মনে সুরবালার ছবি ভেসে ওঠে।

গল্পে প্রেমের উন্মেষ : কথকের ভাষ্যে রচিত ‘একরাত্রি’ গল্পে প্রেমের উন্মেষ ঘটে গল্পের কথকের জবানিতে এভাবে- ‘সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি এবং বউ-বউ খেলিয়াছি। তাহাদের বাড়িতে গেলে সুরবালার মা বড় যত্ন করিতেন এবং আমাদের দু’জনকে একত্র করিয়া আপনা-আপনি বলাবলি করিতেন, আহা, দুটিতে বেশ মানায়।

” সেই ছোট বয়সে এ কথার মর্মার্থ নায়ক না বুঝলেও সে এটুকু উপলব্ধি করেছিল, সুরবালার প্রতি অন্যান্যের চেয়ে তার কিছু বেশি অধিকার আছে। এ অধিকার বলেই সে সুরবালার প্রতি কর্তৃত্ব খাটাত। আর সুরবালাও তা মেনে নিত। এভাবেই নায়কের মনে প্রেমের অঙ্কুরোদগম ঘটেছিল ।

আরও জানো : পুঁইমাচা গল্পের ক্ষেন্তির চরিত্র বিশ্লেষণ কর

বিপর্যস্ত প্রেম : মানবসমাজ একটা জটিল ভ্রান্তির জাল। এখানে মানুষের আশা-নিরাশা, প্রবৃত্তি-নিবৃত্তির মধ্যে চলছে বিরামহীন দ্বন্দ্ব। ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়কের আত্মপ্রতিষ্ঠার মোহে সুরবালার সাথে বিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। নায়ক দেশোদ্ধারের কাজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকায় নোয়াখালীর সরকারি উকিল রামলোচনের সাথে সুরবালার বিয়ে হয়।

সেদিন দেশোদ্ধারের আদর্শের মোহে নায়ক সুরবালার বিয়ের সংবাদকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিল। তারপর যথারীতি স্বপ্নভঙ্গ হয় তার। নাজির, সেরেস্তাদার, মাটসীনি গারিবালডি কিছুই সে হতে পারল না; হলো নোয়াখালীর এন্ট্রান্স স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার।

 

একদিন চরম ঔদাসীন্যে সুরবালার যে প্রেম সে উপেক্ষা করেছিল, আজ আত্মপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হৃদয়ে সেই সুরবালার স্মৃতি মহাসমুদ্রের ঢেউ তুলে দিয়েছে। সুরবালাকে কেন্দ্র করে একটা অসঙ্গত-অন্যায় চিন্তা নায়কের মন-প্রাণ বিপর্যন্ত করে তুলেছে।

রোমাঞ্চকর আবহ : নায়ক সুরবালার অনেক কাছাকাছি অবস্থানের কারণে মন থেকে তার চিন্তা মুছে ফেলতে পারে না। যতই মুছে ফেলতে চায় ততই তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশ্বাস, সরলতা এবং শৈশব-প্রীতিতে ঢল ঢল সুরবালার দু’খানি চোখের কথা নায়কের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে।

তার মনে হয়, সহসা তার হৃৎপিণ্ডকে কে যেন একটা কঠিন মুষ্টি দ্বারা চেপে ধরল, আর বেদনায় তার ভেতরটা টন টন করে উঠল। নায়ক উদ্‌ভ্রান্তের মতো বাসায় ফিরে এলেও সে ব্যথাটা লেগেই রইল। কোনো কাজেই সে মন বসাতে পারছিল না।

একদিন এক দুর্যোগময় রাত দুজনার মিলনের পথ সৃষ্টি করে দিল। গভীর রাতে প্লাবন যখন জনপদ গ্রাস করছে তখন সুরবালার স্বামী ঘরে অনুপস্থিত। এ দুর্যোগ থেকে সুরবালাকে রক্ষার্থে নায়ক পা বাড়ায়। সুরবালাও আত্মরক্ষার্থে পুকুর পাড়ে আসে। দুজন পরস্পর মুখোমুখি হয় । এ আকস্মিক উপস্থিতির মধ্যে জন্ম নেয় এক রোমাঞ্চকর আবহ।

অনন্ত প্রেম : ‘একরাত্রি’ গল্পে সুরবালার সাথে নায়কের মিলন হয়েছিল এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাতে। এক দুর্যোগপূর্ণ রাতে তারা কাছাকাছি এসেছিল । বিশ্বাসে ভালোবাসায় তারা ছিল শান্ত সমাহিত। আকস্মিক সান্নিধ্যে দুজনেই নির্বাক হতবিহ্বল চিত্তে অনন্ত প্রেমের আস্বাদ লাভ করেছিল ।

সে প্রেমের অনির্বচনীয়তা এখন শুধু স্মৃতির মাঝেই আবদ্ধ । এ প্রেম নায়িকাকে ঘর থেকে টেনে বের করার পরিবর্তে স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে, কিন্তু নায়কের হৃদয়ে তার জন্য অনন্ত প্রেমের আসন চিরতরে পাকা হয়ে গেল ।

বিরহ-বিচ্ছেদ : ‘একরাত্রি’ গল্পে মূলত যা ফুটে উঠেছে তা হলো, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়। পরস্পরকে দূরে ঠেলে দেওয়ার মাধ্যমে বিরহের মাঝে তারা প্রেমের সার্থকতা খুঁজে পায়।

কৈশোর ও যৌবনের প্রারম্ভে গল্পের নায়কের মনে যে প্রেম বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি, নায়িকার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে প্রেম পূর্ণতা পেয়েছে, তখন প্রেম নিবেদনের পাত্রীটি নায়কের নাগালের বাইরে। তাকে হাজার চেষ্টা করে স্পর্শ করা দূরে থাক, এক নজর দেখার অধিকারও নায়কের নেই। না পাওয়ার এই বেদনা যেন হৃদপিণ্ডকে কঠিন মুষ্ঠি দ্বারা চেপে ধরার মতো ।

শাশ্বত প্রেম : একটা শাশ্বত প্রেমের কাহিনি অঙ্কিত হয়েছে ‘একরাত্রি’ গল্পে। এ প্রেম অপার্থিব সৌন্দর্যের নিবিড় অনুভূতি, এক অনির্বচনীয় আনন্দ রস। এ রসসিক্ত হয়ে নায়ক বিমুগ্ধ বিস্ময়ে প্রেম আস্বাদন করেছে। এ গল্পের প্রেম দেহের ঊর্ধ্বচারী বলে মিলনের আবেগ, উত্তেজনা, চাঞ্চল্য প্রকাশ অপেক্ষা স্থির, স্নিগ্ধমধুর জ্যোতি বিকিরণ করেছে। এ প্রেম শাশ্বত, চিরন্তন ।

উপসংহার : ‘একরাত্রি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোমান্টিক চেতনায় দেহাতীত প্রেমের এক চিরন্তন শাশ্বত ভাষাচিত্র এঁকেছেন। এটি একটি অপরিণত প্রেমের উপাখ্যান। নায়কের মন যখন প্রেমে ষোলোকলায় পূর্ণ হয়েছে, তখন নায়িকা সুরবালা অন্যজনের ঘরনি। তাকে এক নজর দেখার অধিকারও এখন আর তার নেই, কাছে থেকেও সে এখন অনেক দূরে। তাই বলা যায়- বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়।

শিক্ষাগার

প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

মাহমুদুল হাসান

শিক্ষাগত যোগ্যতা
গণিতে অনার্স ও মাস্টার্স

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফাজিল সম্পন্ন

গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা

বিশেষ দক্ষতা

বাংলা সাহিত্য • গণিত • ইসলামিক শিক্ষা

অভিজ্ঞতা

শিক্ষকতা ও ৫+ বছর কন্টেন্ট রাইটিং

আমাদের লক্ষ্য

শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা। ২০২৩ সাল থেকে লাখো শিক্ষার্থী শিক্ষাগার থেকে উপকৃত হচ্ছে।

Leave a Comment