হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের মূলভাব/বিষয়বস্তু/সারমর্ম

প্রশ্ন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের মূলভাব নিজের ভাষায় লেখ।

অথবা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের বিষয়বস্তু / সারমর্ম / মূল বক্তব্য তোমার নিজের ভাষায় লেখ।

উপস্থাপনা : বাংলা সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী, বাংলা সাহিত্যের Versatile genius বা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী লেখক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ-সংকলন থেকে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে। লেখক তাঁর আশিতম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রবন্ধটি রচনা করেন।

লেখক কৈশোর ও যৌবনে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি মোহাবিষ্ট থাকলেও কালান্তরে জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়ে এ সভ্যতার গভীর সংকট তিনি মনে-প্রাণে উপলব্ধি করেন। আলোচ্য প্রবন্ধে ইংরেজ শাসন ও সভ্যতার প্রতি লেখকের মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে এবং সর্বোপরি পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী ও ভোগবাদী সভ্যতার স্বরূপ ফুটে উঠেছে।

সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের মূলভাব / বিষয়বস্তু

সভ্যতার সংজ্ঞা : Oxford Dictionary-তে সভ্যতা বা Civilization-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে A state of human society that is very developed and organized. অর্থাৎ, মানবজীবনের একটি অবস্থান, যেখানে তারা খুব উন্নত এবং সুসংবদ্ধ। সভ্যতার এ সংজ্ঞা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অবদান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, সভ্যতার যথার্থ প্রতিশব্দ আমাদের ভাষায় পাওয়া দুষ্কর।

সভ্যতার যে রূপ আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল, মনু তাকে বলেছেন ‘সদাচার’ । আর সদাচার হলো, কতকগুলো সামাজিক নিয়মের বন্ধন। সরস্বতী ও দৃশদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী যে দেশ ‘ব্রহ্মাবত’ নামে বিখ্যাত ছিল, সে দেশে যে আচার ক্রমান্বয়ে চলে এসেছে, তাকেই বলে সদাচার বা সভ্যতা ।

আরও জানো : রাজবন্দীর জবানবন্দী প্রবন্ধের মূল বক্তব্য / মূলভাব

লেখকের আত্মোপলব্ধি : লেখক রবি ঠাকুর জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়ে এমন মত ব্যক্ত করেছেন, যেখানে পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশিত এবং প্রাচ্য সভ্যতার প্রতি আস্থা ব্যক্ত হয়েছে। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে রচিত আলোচ্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুস্পষ্টভাবে যে সিদ্ধান্ত তুলে ধরেছেন, তা তার জীবনোপলব্ধিজাত।

সমগ্র জীবনজুড়ে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এখানে তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। তার প্রথম জীবনের সাথে শেষ জীবনের চিন্তা-চেতনার পার্থক্য এবং সর্বোপরি একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রয়াস পেয়েছেন তিনি এ প্রবন্ধে।

ব্রিটিশ শাসনে উপমহাদেশের উন্নতি : প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশ শাসন করেছে। এই সুদীর্ঘ শাসনামলে উপমহাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভূত উন্নতি ও সমৃদ্ধি সাধিত হয়। এটা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাথমিক জীবনের ভাবনা, কিন্তু জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি বুঝতে পারেন, ইংরেজ শাসনের সাফল্য ও হঠকারিতার মধ্যে কত রহস্য নিহিত রয়েছে।

আরও জানো : সংস্কৃতি কথা প্রবন্ধের মূলভাব / মূল বক্তব্য / বিষয়বস্তু

পাশ্চাত্য সভ্যতার বৈশিষ্ট্য : পাশ্চাত্য বা ইংরেজ সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্য হলো মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধতা রক্ষা করা। ইংরেজ চরিত্রের মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধতা রক্ষার এ বৈশিষ্ট্য সর্বদাই ছিল। তাই ইংরেজদের প্রতি প্রীত হয়ে আন্তরিক শ্রদ্ধায় তাদেরকে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথসহ শিক্ষিত ভারতীয়রা। তখনো সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতার মদমত্ততায় তাদের স্বভাব- চরিত্র কলুষিত হয়নি। তাই পৃথিবীর দেশে দেশে ইংরেজ সভ্যতার বিজয়বার্তা খুব সহজেই পৌঁছে গিয়েছিল।

ইংরেজি শিক্ষার প্রভাব : সেকালে ইংরেজি শিক্ষার প্রভাব ছিল দিগন্তবিস্তারী। ভারতবর্ষে তখন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য জানা মার্জিত রুচিবোধের পরিচায়ক ছিল। তখনকার সাহিত্যের আসরগুলো সর্বদা মুখরিত ছিল বার্কের বাগ্মিতায়, মেকলের ভাষাপ্রবাহের তরঙ্গ- ভঙ্গে; এখানে প্রতিনিয়তই আলোচনা চলত শেক্সপিয়রের নাটক আর বায়রনের কাব্য নিয়ে।

তখন স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলেও ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাবে ভারতীয়দের অন্তরে ছিল ইংরেজ জাতির ঔদার্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাবোধ।

সভ্যতার সংকট : প্রবন্ধকার আলোচ্য ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে সভ্যতার সংকট বলতে ইংরেজ সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতাকে বুঝিয়েছেন। একটি উন্নত সভ্যতা যখন ক্ষমতা মদমত্ততার বশবর্তী হয়ে বিশ্বমানবতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, সে সভ্যতাকে তখন মানুষ শ্রদ্ধা করতে পারে না।

ইংরেজ সভ্যতার ক্ষেত্রেও ভারতবর্ষে এরূপই ঘটেছিল। ইংরেজরা তাদের উপনিবেশগুলোতে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছিল। তাদের উপনিবেশগুলোতে মানুষকে অত্যন্ত নির্মমভাবে শোষণ করা হয়েছিল। তাদের সভ্যতা ছিল মূলত মানবতাবোধ সংকটে সংকটাপন্ন ।

আরও জানো : বাঙ্গালা ভাষা প্রবন্ধের মূল বক্তব্য/মূলভাব/বিষয়বস্তু

সংকটের অভ্যুদয় : প্রখ্যাত ইংরেজ মনীষী জন ব্রাইটের মুখে যে শাশ্বত বাণী শুনে লেখক মুগ্ধ হয়েছিলেন, এন্ড্রুজের সান্নিধ্যে গিয়ে মহত্ত্বের যে পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন, ইংরেজ শাসনের হিংস্রতা সেসবকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিল। ফলে লেখকের মনে ইংরেজদের প্রতি আশৈশব লালিত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস মুহূর্তে বিলীন হয়ে গিয়েছিল।

তাই তিনি আক্ষেপের সাথে বলেছেন, “জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম ইউরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।”

শাসনের নামে বঞ্চনা : একদিন যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজরা নিজেদের বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে আসছিল, তার যথোচিত চর্চা থেকে নিঃসহায় ভারতবর্ষ ছিল বঞ্চিত। অথচ জাপান একই শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল।

সেদিন ভারতবর্ষের জনসাধারণের যে নিদারুণ বঞ্চনা ও দারিদ্র্য লেখকের চোখের সামনে উদ্ঘাটিত হয়েছিল, তা ছিল অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। ইংরেজ শাসনের নিষ্ঠুর বিকৃতরূপ, সভ্য নামধারী ইংরেজকে জগদ্বাসীর কাছে ধিকৃত ও নিন্দিত করেছে।

ইংরেজ শাসনের পরিণতি : ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতবর্ষের অধিবাসীদের যে দুর্গতি সেদিন সৃষ্টি হয়েছিল, সে কেবল অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও আরোগ্যের শোকাবহ অভাবমাত্র নয়; তা হলো ভারতবাসীর মধ্যে অতি নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ।

তাদের কূটকৌশলে ভারতীয় জাতিসত্তা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তারা আমাদের দিয়ে গেল- ‘Law and order’ যার অপর নাম বলা যায় দারোয়ানি, কিন্তু তারা অপহরণ করে নিয়ে গেল আমাদের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর সাম্য-মৈত্রী

ইংরেজ শাসনের বেড়াজাল হতে মুক্তি : একটি জাতি কীভাবে সভ্যতার উত্তরণ ঘটায় সে ব্যাপারে লেখক আমাদের প্রতিবেশী আফগানদের দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করেছেন। জরথুস্ত্রীয়ানদের সাথে মুসলমানদের এককালে যে সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা ছিল, বর্তমান শাসনে তার উপশম হয়েছে।

এর কারণ, ইউরোপীয় জাতির চক্রান্তজাল থেকে তারা মুক্ত হতে পেরেছে। শিক্ষা ও সমাজনীতিতে সর্বজনীন উৎকর্ষ সাধন করতে না পারলেও তাদের মধ্যে এর সম্ভাবনা অক্ষুণ্ণ আছে। তাই তারা উন্নতির পথে মুক্তির পথে অগ্রসরমান।

সভ্যতার নগ্নরূপ : দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের নগ্নরূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। এর বহু আগেই ইংরেজরা কূটকৌশলে ভারতবর্ষ দখল করে নিয়েছিল। তারা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সভ্যদেশ চীনকে নৈতিকতাবিরোধী আখ্যায়িত করে চীনের একাংশ দখল করে নেয়।

জাপান যখন উত্তর চীনকে গ্রাস করে, তখন সভ্য ইংরেজ সে আগ্রাসনের কোনো প্রতিবাদ তো করেইনি; বরং তারাই জাপানকে এ আগ্রাসনে প্ররোচিত করেছিল। ইংরেজ সভ্যতার মানবতাবোধশূন্য নির্মম নগ্নরূপ প্রকট আকার ধারণ করে ভারতবর্ষে।

ভারতবর্ষে তারা তাদের শাসনক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য এ দেশের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে কোন্দল ও শত্রুতার জন্ম দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপণ করে। মূলত তারা নিজেদের সভ্য জাতি হিসেবে প্রচার করলেও উপমহাদেশে তাদের সভ্যতার নির্মম অমানবিক নগ্নরূপ প্রকাশিত হয়েছে।

লেখকের আশাবাদ : প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে একদিন মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের নির্মল আত্মপ্রকাশ ঘটবে যা নির্যাতিত-নিপীড়িত ভারতবাসীকে আলোর পথ দেখাবে, পৌঁছে দেবে তাদের মুক্তির দ্বারপ্রান্তে।

সমাজের সংগ্রামী জনতা একদিন নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সব বাধা অতিক্রম করে তাদের মহৎ মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য দৃঢ়পদে অগ্রসর হবে। ফিরে পাবে তাদের হারানো গৌরব আর শৌর্য-বীর্য।

উপসংহার : সময়ের প্রয়োজনে একদিন যে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল, কালান্তরে তা আজ সংকটাপন্ন। ইংরেজরা আমাদেরকে তাদের শক্তি দেখাতে পারলেও মুক্তির পথ দেখাতে পারেনি। তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী মনোভাবের কারণে সভ্যতা আজ কলুষিত, সংকটাপন্ন। এ সংকট থেকে জাতির মুক্তি ঘটবে, লেখক এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

শিক্ষাগার

প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

মাহমুদুল হাসান

শিক্ষাগত যোগ্যতা
গণিতে অনার্স ও মাস্টার্স

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফাজিল সম্পন্ন

গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা

বিশেষ দক্ষতা

বাংলা সাহিত্য • গণিত • ইসলামিক শিক্ষা

অভিজ্ঞতা

শিক্ষকতা ও ৫+ বছর কন্টেন্ট রাইটিং

আমাদের লক্ষ্য

শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা। ২০২৩ সাল থেকে লাখো শিক্ষার্থী শিক্ষাগার থেকে উপকৃত হচ্ছে।

Leave a Comment