প্রশ্ন : ॥ আবুল মনসুর আহমদ বিরচিত ‘হুযুর কেবলা’ গল্প অবলম্বনে এমদাদের চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
অথবা, আবুল মনসুর আহমদের “হুযুর কেবলা’ গল্পে এমদাদ চরিত্রের বিভিন্ন দিক
আলোচনা কর।
উপস্থাপনা : ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত ‘হুযুর কেবলা’ গল্পটি আবুল মনসুর আহমদের অনবদ্য সৃষ্টি। গল্পটির সবটুকু জুড়ে যদিও এক ভণ্ড পীর বিরাজ করেছে, তবু এর কাহিনি নিয়ন্ত্রণ করেছে এমদাদ নামক এক প্রগতিশীল যুবক।
গল্পের কাহিনি শুরু এমদাদকে দিয়ে এবং শেষও হয়েছে এমদাদকে ঘিরেই। তাই এ গল্পে এমদাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। নিচে এমদাদ চরিত্রের বিভিন্ন দিক আলোচিত হলো-
এমদাদের পরিচয় : গল্পকার এমদাদের পিতৃপরিচয় বিস্তৃতভাবে এ গল্পে তুলে ধরেননি। তবে আলোচনা দ্বারা বোঝা যায়, সে ছিল সচ্ছল পরিবারের সন্তান, কিন্তু তার মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ ছিল না । আত্মীয় বলতে ছিল শুধু বিধবা এক ফুফু। এমদাদ উত্তরাধিকারসূত্রে বেশকিছু তালুকপ্রাপ্ত হয়েছিল।
সে কলকাতায় দর্শনশাস্ত্রে অনার্স পড়ত। তখন সে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেলাফত আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে গ্রামে প্রত্যাবর্তন করে। পরবর্তীতে ফুফুকে ফেলে সে আধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধানে ঘর থেকে বের হয়।
আরও জানো : হুজুর কেবলা গল্পের মূলভাব / মূল বিষয়/মূল বক্তব্য
নাস্তিক এমদাদ : কলেজের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এমদাদ ছিল নাস্তিক্যমনা। সে ধর্ম, খোদা, রাসুল কিছুই মানত না। এমদাদ খোদার আরশ, ফেরেশতা, অহি, রাসুলের মিরাজ নিয়ে সর্বদা হাসি-ঠাট্টা করতো। কলেজ ম্যাগাজিনে সে মিল, হিউম, স্পেন্সার ও কোমতের ভাব চুরি করে খোদার অস্তিত্বের অসারতা প্রমাণ করার জন্য প্রবন্ধ লিখেছিল। এমদাদ এভাবে নিজেকে পুরোদস্তুর নাস্তিক হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল।
আস্তিক এমদাদ : অসহযোগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এমদাদ এবার খেলাফত আন্দোলনের সৈনিক হয়ে গেল। নাস্তিক্য ত্যাগ করে সে আস্তিকে পরিণত হলো। কোরা খদ্দরের কল্লিদার কোর্তা ও সাদা লুঙ্গি পরে মুখে দেড় ইঞ্চি ঝাঁকড়া দাড়ি রেখে মাথায় গোলটুপি পরে চটি জুতা পায়ে দিয়ে এমদাদ যেদিন গ্রামে ফিরল, সেদিন রাস্তার বহুলোক তাকে সালাম দিল।
সে নিয়মিত নামাজ পড়তে লাগল। বিশেষ করে নফল নামাজে সে একেবারে তন্ময় হয়ে পড়ল। বাঁশের কঞ্চি কেটে নিজ হাতে তসবিহ বানিয়ে অষ্টপ্রহর টিপতে টিপতে আঙুলের মাথা ক্ষয় করে ফেললেও ইবাদতে মনোযোগী হতে পারল না। শেষ পর্যন্ত এমদাদ এক পরিচিত সুফী সাহেবের শরণাপন্ন হলো।
আরও জানো : হুজুর কেবলা গল্পের পীর সাহেবের চরিত্র বিশ্লেষণ কর
এমদাদের পরিবর্তন : এমদাদ খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেল। সে বিলেতি পোশাক ও অন্যান্য জিনিস পরিত্যাগ করে স্বদেশী আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে দেশি জিনিসপত্র ব্যবহার করতে লাগল। পোশাক ও অন্যান্য ধর্মীয় উপকরণ ব্যবহারের কারণে লোকজন তাকে সালাম দিতে লাগল ।
ধর্মভীরু এমদাদ : এমদাদ হুযুর কেবলার সান্নিধ্যে এসে অত্যন্ত ধার্মিক হয়ে যায়। ধর্মকর্মে আরও ব্যাপক মনোনিবেশের জন্য সে সুফী সাদুল্লাহর মাধ্যমে পীর সাহেবের মুরিদ হয়। এছাড়া সে অন্য কোনো উপায় খুঁজে পেল না।
অসহায়ের মতো সুফীর নিকট ধরা গলায় বলল, ‘কি হইবে আমার তাহা হইলে সুফী সাহেব?’ পীর সাহেবের সংস্পর্শে এসে সে তার অলৌকিক সব কাণ্ডকারখানায় যারপরনাই মুগ্ধ ও বিস্ময়াভিভূত হলো। নিয়মিত ধর্মচর্চা করা ও পীরের সান্নিধ্যে থাকাই একদা নাস্তিক এমদাদের নিত্যদিনের কাজে পরিণত হলো।
সে এখানে এসে যেন আত্মার শান্তি খুঁজে পেল। পীর সাহেবের মুখে শোনা আরবি ও ফারসি কথাগুলো তাকে বিমোহিত করে। সে দিবানিশি দুই চোখ বুজে পীরের নির্দেশমতো ‘এলহু’ ‘এলহু’ যিকির করতে থাকে।
মুরিদ হিসেবে এমদাদ : এমদাদ বহু চেষ্টা করেও ইবাদতে নিবিষ্ট হতে পারছিল না। ঘুম তাকে তাহাজ্জুদ থেকে বঞ্চিত রাখে। অগত্যা এমদাদ এক সুফী সাহেবের কাছে তার অশান্তি অসুবিধার কথা খুলে বলে। সুফী সাহেব সবকিছু শুনে বললেন, ‘পীর না ধরে কেউ রূহানিয়াৎ হাসিল করতে পারে না।’
এমদাদ একজন কামেল পীরের সন্ধান চাইলে সুফী সাহেব তাকে নিজের পীরের কাছে নিয়ে যায়। এমদাদ পীর সাহেবের বাড়িতে গিয়ে তার কিছু বুযুগিপূর্ণ কথাবার্তা শুনে আশ্চর্য হয়ে কোনো দ্বিধা না করে পীরের মুরিদ হয় ।
পীরভক্ত এমদাদ : এমদাদ মুরিদ হওয়ার পর পীরের নির্দেশে যিকরে জলি আরম্ভ করল। সে দিনরাত দুই চোখ বুজে ‘এলহু’ ‘এলহু’ যিকির করতে থাকে। অনাহার-অনিদ্রায় এমদাদের চোখ দুটি মাথার মধ্যে প্রবেশ করল, তার শরীর নিতান্ত দুর্বল, মন অত্যন্ত অস্থির হয়ে গেল, তবু এমদাদ পীর সাহেবের প্রতি অটুট ভক্তি রেখে চলছিল
এমদাদের অস্থিরতা : এমদাদ অনেক চেষ্টা করেও নিজের অন্তরকে লতিফায় মুতাওয়াজ্জাহ করতে পারল না। অর্ধাহার, অনাহার ও অনিদ্রায় তার শরীর-মন দুই-ই দুর্বল ও অস্থির হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, আর কিছুদিন গেলে তার রূহ বস্তুতই জিসম থেকে আজাদ হয়ে আলমে আমরে চলে যাবে। তাই এমদাদ বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে।
মুরিদানে গমন : বাড়ি যাওয়ার জন্য এমদাদ যখন অস্থির হয়ে উঠল তখন দূরবর্তী স্থানের মুরিদরা পীর সাহেবকে দাওয়াত দেয়। এমদাদও তার সফরসঙ্গী হয়। সেখানে রাজকীয় খাবার খেয়ে এমদাদের দেহের চেকনাই ফিরে এল । এমদাদ লক্ষ করল, সুস্বাদু খাবার-দাবার ও নারীর প্রতি পীর সাহেবের আসক্তি বেশি।
সেখানে যে মোড়লের বাড়িতে পীর সাহেব আস্তানা গেড়েছিল, সে মোড়লের ছেলে রজবের সুন্দরী স্ত্রী কলিমনের প্রতি পীর সাহেবের চোখ পড়ে। এ ব্যাপারটি এমদাদের কাছে খুবই সন্দেহজনক ও আপত্তিকর বলে মনে হয়। পীর সাহেবের মোরাকাবার আসরে পাতানো খেলার ভণ্ডামি সে ধরে ফেলে ।
প্রতিবাদী এমদাদ : মোরাকাবার আসর বসিয়ে হুযুর যে তার কাম-লালসা চরিতার্থ করার ফন্দি আঁটছেন, এমদাদ তা বুঝতে পারে। সে নিজেই মোরাকাবায় বসতে চাইলে পীর সাহেব তাকে বারণ করে। প্রধান খলিফা সুফী বদরুদ্দীন মোরাকাবায় বসার পর এমদাদ প্রশ্ন করতে চাইলে তাকে উপহাসের পাত্র হতে হলো।
এরপর বদরুদ্দীনের দেহে রাসুলের আত্মা আনয়নের মতো বেদাতি কাজ করে হুযুর তার বাসনা পূর্ণ করেন। বদরুদ্দীন রাসুলের আত্মা সেজে হুযুরকে বলেন, রজবের স্ত্রী কলিমনকে বিয়ে করে শরীয়তের নির্দেশ পালন করতে। এমদাদ এসব কুকীর্তি বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সাহসী এমদাদ : রজবকে কাঁদিয়ে তার স্ত্রী কলিমনকে কৌশলে বিয়ে করে নারীলোলুপ পীর সাহেব। এমদাদ দুঃসাহসের সাথে এর প্রতিবাদ করে। সে বিয়ের আসরে হুযুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে বলে- “রে ভণ্ড শয়তান, নিজের পাপ-বাসনা পূর্ণ করিবার জন্য দুইটা তরুণ প্রাণ এমন দুঃখময় করিয়া দিতে তোর বুকে বাজিল না?” এজন্য শাগরেদ মুরিদরা এমদাদকে প্রহার করতে শুরু করলে সে তাদের মূর্খ বলে গালি দেয়। সে হুযুর কেবলার মুখোশ জনগণের সামনে খুলে দেয়।
উপসংহার : ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে এমদাদ একটি অনুসন্ধানী, প্রতিবাদী ও সাহসী চরিত্র। সে সঠিক পথের দিশা লাভ করতে গিয়ে ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ী নামধারী পীরদের খপ্পরে পড়েছে। যদিও শেষপর্যন্ত সে নিজে পথভ্রষ্ট হয়নি, কিন্তু ভণ্ড প্রতারক ও নামধারী পীরদের মুখোশ উন্মোচন করতে এটা তার সুবর্ণ সুযোগ ছিল। এমদাদ অসাধারণ এক সত্যবাদী চরিত্র। বর্তমান যুগে এমদাদের মতো সাহসী প্রতিবাদী চরিত্র বিরল।