হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

হুজুর কেবলা গল্পের পীর সাহেবের চরিত্র বিশ্লেষণ কর

প্রশ্ন : ॥ আবুল মনসুর আহমদ বিরচিত ‘হুযুর কেবলা’ গল্প অবলম্বনে পীর সাহেবের চরিত্র বিশ্লেষণ কর।

অথবা, ‘হুযুর কেবলা’ গল্প অবলম্বনে পীর সাহেবের চরিত্র বিশ্লেষণ কর।

অথবা, আবুল মনসুর আহমদের ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে হুযুর কেবলার চরিত্রের বিভিন্ন দিক আলোচনা কর।

উপস্থাপনা : ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মধ্য দিয়ে সমাজের বিভিন্ন দিক অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন। এ গল্পে বাঙালি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দীর্ঘদিনের যে অন্ধত্ব, কুসংস্কার, অন্ধভক্তি, ভণ্ডামি ও বঞ্চনা লুকিয়ে আছে, লেখক কঠোর ভাষায় তার সমালোচনা করে প্রতিবাদের ভূমিকা পালন করেছেন।

গল্পের মূল চরিত্র এক ভণ্ড পীর ও প্রতিবাদী যুবককে আশ্রয় করে লেখক এ গল্পটি রচনা করেছেন। এর কাহিনিতে পীর সাহেবের ভণ্ডামির জ্বলন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে।

পীর সাহেবের/হুযুর কেবলার পরিচয় : এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হুযুর কেবলা, কিন্তু গল্পের কোথাও গল্পকার তার নাম বা বিস্তারিত পরিচয় ব্যক্ত করেননি। শুধু বলা হয়েছে, সে একজন বড় মাপের কামেল পীর। বয়সে প্রবীণ। তার মুখে মেহেদিরঞ্জিত দাড়ি। তার মুরিদের সংখ্যা অনেক। একটি একতলা বড় বাড়িতে হুযুর কেবলা বসবাস করেন।

তার অন্দরমহলে কয়েকটি পাকা ঘর। যে বৈঠকখানায় বসে তিনি মুরিদদের উদ্দেশে ওয়াজ নসিহত করেন সেটিও আটচালা ঘর। সেখানে মুরিদরা দলে দলে গিয়ে পীর সাহেবের মহব্বত আদায়ের চেষ্টা করেন। পীর সাহেব সহজ-সরল মুরিদদের সামনে অনবরত কুরআন-হাদিস আওড়ান এবং নানা ধরনের উদ্ভট কথাবার্তা বলে তাদের মুগ্ধ করার চেষ্টা করেন।

আরও জানো : হুজুর কেবলা গল্পের মূলভাব / মূল বিষয়/মূল বক্তব্য

প্রতারক : ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে পীর সাহেব একজন প্রতারক ও ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ী। নিজের, স্বার্থসিদ্ধির জন্য তিনি যে-কোনো ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিতে কুণ্ঠিত হতেন না। তার কয়েকজন বিশ্বস্ত মুরিদ ছিল, যারা তার সকল কুকর্মের দোসর। পীর সাহেব প্রতারণামূলক কেরামতি প্রদর্শন করে গ্রামবাংলার অজ্ঞ মূর্খ মুরিদদের অবাক করে তাদের ভক্তি শ্রদ্ধা আদায়ের চেষ্টা করেন।

এমদাদের আগমন সম্পর্কে সুফী সাহেবের কাছ থেকে পূর্বে অবহিত হয়ে পীর সাহেব মজলিসে উপস্থিত মুরিদদের সামনে প্রকাশ করলেন যে, আধ্যাত্মিক শক্তি বলেই তিনি এমদাদ সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এটা ছিল তার প্রতারণার একটা নমুনা ।

ধর্ম-ব্যবসায়ী : পীর সাহেব ছিলেন চূড়ান্ত ধর্ম-ব্যবসায়ী। তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ধর্মকে আশ্রয় করে ব্যবসায় করা। তাই সুযোগ বুঝে তিনি মানুষকে ঠকাতেন, সর্বনাশ করতেন, এমনকি সর্বস্বান্ত করতেও দ্বিধা করতেন না। সাধারণ মানুষের ধর্মানুরাগের সুযোগ নিয়ে তিনি তাদের নানাভাবে প্রভাবিত করে তার ধর্ম ব্যবসায় চালিয়ে গেছেন।

আরও জানো : হুজুর কেবলা গল্প অবলম্বনে এমদাদের পরিচয় ও চরিত্র বিশ্লেষণ কর

গ্রামের অশিক্ষিত মানুষেরা সাধারণত পীর সাহেবের মাধ্যমে তাদের আত্মার মুক্তি কামনা করে, পরকালের শান্তি আকাঙ্ক্ষা করে। সাধারণ মানুষের এ ধর্মভয়কে পুঁজি করে তিনি তার ব্যবসার প্রসার ঘটান। তার ধর্ম-ব্যবসার নমুনা হলো তার পাকা বাড়িঘর বৈঠকখানা ইত্যাদির প্রাচুর্য।

ভোজনবিলাসী : হুযুর কেবলা গল্পের পীর সাহেব ছিলেন আরামপ্রিয় ও ভোজনবিলাসী। ঘি, সরু চাল, মুরগি, খাসি ইত্যাদি ছিল তার নিত্যদিনের খাওয়ার তালিকা। আর অম্বুরি তামাক না হলে তো তার দিনই কাটত না। ভক্তরা সব সময় তার খেদমতে রত থাকত। হাত-পা টিপে দিত। সফরে বের হওয়ার সময় তিনি সৌখিন বজরা করে নদীপথে বের হতেন ।

প্রকাণ্ড বজরায় এক মণ ঘি, আড়াই মণ তেল, দশ মণ সরু চাল, তিনশ মুরগি, সাত সের অম্বুরি তামাক এবং তেরো জন শাগরেদ নিয়ে পীর সাহেব মুরিদানের বাড়িতে রওয়ানা হতেন। হুযুর কেবলার এ শান-শওকত দেখে সহজেই তার বিলাসী জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় ।

 

কেরামতি দেখানো : সাধারণত গ্রামবাংলার সহজ-সরল মানুষেরা কেরামতিতে বিশ্বাসী। তাই পীর সাহেব মুরিদদের উদ্দেশে কেরামতি প্রদর্শন করতেন। তিনি সুফী সাহেবের সাথে এমদাদকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখেও এমন একটা ভাব করেছেন যেন ঐশীশক্তি মারফত তাদের আগমনের কথা জানতে পেরেছেন।

তিনি সুফীকে বলেছেন, সে কারো তদবিরে এসেছে। চোখ বুজে ধ্যানের ভান করে তিনি ঘোষণা করলেন, “সে এ ঘরেই হাজির আছে দেখিতেছি।” এসব কুদরতি ও কেরামতি দেখে এমদাদ বিস্মিত হয়। তার মনে হলো পীর – সাহেবের মুখ থেকে এক প্রকার জ্যোতি বের হচ্ছে।

রিয়াকারী : ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের পীর সাহেব ছিলেন অতি প্রদর্শনেচ্ছুক ব্যক্তি। ওয়াজ করার সময় পীর সাহেবের দেহে প্রায়ই জযবা আসত। এ জযবাকে মুরিদরা ফানা ফিল্লাহ বলত। ফানা ফিল্লাহর সময় পীর সাহেব ‘জ্বলে গেলাম’ ‘পুড়ে গেলাম’ বলে চিৎ হয়ে শুয়ে চিৎকার করতেন। এ সময় পীর সাহেবের রূহ নাকি আলমে খালক থেকে আলমে আমরে পৌঁছে যেত।

সেখানকার নূরের জালওয়া পীর সাহেবের চোখে সহ্য হতো বলে তিনি এরূপ চিৎকার করতেন। তাই জযবার সময় একখণ্ড কালো মধমল দিয়ে তার চোখ-মুখ ঢেকে দিয়ে হাত-পা টিপে দেওয়ার অসিয়ত ছিল। এসবই ছিল পীর সাহেবের রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা ।

পীর সাহেবের নারী-আসক্তি : নারীলোভী ভক্ত শয়তান ছিল পীর সাহেব হুযুর কেবলা। মহিলা মুরিদদের প্রতি তার ছিল মাত্রাতিরিক্ত নেক নজর। মেয়েদের সামনে ওয়াজ করার জন্য তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাই পুরুষদের মজলিসের চেয়ে তিনি মহিলাদের মজলিসে যাওয়ার জন্য ব্যগ্র থাকতেন এবং বেশি সময় কাটাতেন।

তার এক মুরিদের পুত্রবধূ (রজবের স্ত্রী) কলিমন ছিল অপূর্ব সুন্দরী। পীর সাহেব কলিমনকে বিয়ে করার জন্য এক কূট পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি নাটকীয় কৌশলে মোরাকাবা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেখান থেকে তার জন্য কলিমনকে হালাল করে নেন। এ ক্ষেত্রে তিনি মহানবির আত্মার সাথে তামাশা করতেও দ্বিধা করেননি।

বিবেক, বুদ্ধি, মানবতা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে পীর সাহেব তার নারী-আসক্তিকে চরিতার্থ করেছেন। কলিমনের আর্তনাদ, রজবের বুকফাটা কান্না কোনোকিছুকেই তিনি পরোয়া করেননি। নিজের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে তিনি ধর্ম, রাসুল, কিতাব প্রভৃতিকে ব্যবহার করেছেন। তার এ নারী-আসক্তি তাকে বিবেকবর্জিত অমানুষে পরিণত করেছিল।

চতুর ও ধূর্ত : অতি চতুর ও ধূর্ত লোক ছিলেন পীর সাহেব। রজবের স্ত্রী কলিমনকে বিয়ে করার জন্য তিনি চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার দুই খলিফার সাথে গোপনে কুপরামর্শ করে পীর সাহেব যে মোরাকাবা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন শিক্ষিত সচেতন এমদাদ ছাড়া অন্য কেউ তা বুঝতে পারেনি।

স্বীয় কামলোলুপতা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তার এ সর্বোচ্চ চাতুর্য জয়যুক্ত হয়েছিল। পীর সাহেব কলিমনকে বিয়ে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এভাবেই তিনি তার কামনা বাসনা পূর্ণ করতেন শঠতা ও ধূর্ততার সাথে।

মিথ্যুক ও হঠকারী পীর : পীর সাহেব ছিলেন চরম মিথ্যুক ও হঠকারী। মিথ্যা আর হঠকারিতার আশ্রয় নিয়েই হুযুর কেবলা অজ্ঞ মুরিদদের ধর্মভীতিতে মাতাল করে তুলতেন সাধনার মাধ্যমে স্রষ্টার অতি নিকটবর্তী হয়েছেন বলে তিনি দাবি করতেন। তাই তিনি বলেছেন, এলমে লাদুন্নি হাসিল করার পূর্বেই তিনি একবার লওহে মাহফুযে উপস্থিত হয়েছিলেন।

তখন পর্যন্ত সায়েরে নাযাবীর ফয়েষ হাসিল না হওয়ায় আরশে মুয়াল্লার পর্দা তার চোখের সামনে থেকে উঠে যেতেই তিনি নূরে ইষদানী দেখে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর মুরিদদের সামনে কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকার পর তিনি জানালেন, তার রূহ তামাম দুনিয়া ঘুরে সাত হাজার বছর কাটিয়ে আবার তার দেহে এসে প্রবেশ করেছে।

এ সময়ে কত বাদশার ওফাত হয়েছে, কত সালতানাত মিসমার হয়েছে, কত লড়াই হয়েছে, এটা তার পরিষ্কার মনে আছে। অধিক শুনলে মুরিদদের কলব ফেটে যাবে বলে উল্লেখ করে তিনি বর্ণনা সংক্ষিপ্ত করেন। তার এসব উক্তি ছিল বড় ধরনের মিথ্যাচার, যা অশিক্ষিত মুরিদরা বুঝতে অক্ষম হয়।

লম্পট পীর সাহেব : পীর সাহেব কেবলা ছিলেন লম্পট চরিত্রহীন একটা মানুষ। নিজের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য তিনি দুটি তরুণ প্রাণকে দুঃখময় জীবনে ঠেলে দেন, রজবকে ঘরছাড়া করেন, কলিমনকে বিয়ে করেন।

বৃদ্ধ বয়সেও প্রবল নারী-আসক্তির কারণে রাসূল এর আত্মার দোহাই দিয়ে তিনি এমন অমানবিক ঘটনা ঘটালেন। তার মতো ভণ্ডের কামলোলুপতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রহৃত হয় এমদাদ।

উপসংহার : ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে পীর সাহেব একজন নারীলোভী ভণ্ড প্রতারক মানুষ। ধর্ম-ব্যবসায়ী এ ভণ্ড পীর নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভণ্ড খলিফার অভিনয়কে রাসুল-এর আত্মা বলে প্রচার করেছেন। মানুষের সরলতা, অন্ধ ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে তিনি অর্থোপার্জন ও কামলালসা চরিতার্থ করেছেন।

এরা আমাদের সমাজের মানুষরূপী শয়তান। বেশিরভাগ মানুষেরই ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে এ ধরনের প্রবণতা বর্তমান সমাজেও অব্যাহত রয়েছে।

শিক্ষাগার

প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে

মাহমুদুল হাসান

শিক্ষাগত যোগ্যতা
গণিতে অনার্স ও মাস্টার্স

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফাজিল সম্পন্ন

গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা

বিশেষ দক্ষতা

বাংলা সাহিত্য • গণিত • ইসলামিক শিক্ষা

অভিজ্ঞতা

শিক্ষকতা ও ৫+ বছর কন্টেন্ট রাইটিং

আমাদের লক্ষ্য

শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা। ২০২৩ সাল থেকে লাখো শিক্ষার্থী শিক্ষাগার থেকে উপকৃত হচ্ছে।

Leave a Comment