উসূলে ফিকহের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

ইসলামী শরীয়তের বিধিমালা কতিপয় মৌলিক নীতির ওপর নির্ভরশীল; যা মানবজীবনের পথনির্দেশক হিসেবে স্বীকৃত। আল্লাহ প্রদত্ত কুরআনুল কারীম এবং রাসূল (স)-এর সুন্নাহ ছাড়াও এর রয়েছে আরো কিছু অনুকরণীয় মানদণ্ড, যেগুলোকে একত্রে বলা হয় উসূলে ফিকহ; ইসলামের যাবতীয় মাসয়ালার সমাধান উসূলে ফিকহের মাধ্যমেই করা হয়েছে। নিম্নে উসূলে ফিকহের গুরুত্ব এবং উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো ।

উসূলে ফিকহের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ :

সাহাবীদের যুগ থেকে উসূলে ফিকহের উৎপত্তি হয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে তার ক্রমবিকাশ হতে থাকে । যেমন-

ক. সাহাবীদের যুগে উসূলে ফিকহ : রাসূল (স)-এর পরবর্তীকালে সাহাবীদের যুগে ফিকহ তথা ইজতেহাদের সূচনা হয়। বিভিন্ন ঘটনায় ফকীহ সাহাবীগণ সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে ইজতেহাদ করেন; কিন্তু তাঁদের এ নীতিমালা প্রকাশমূলক বা ঘোষিত ছিলো না। তাঁদের গৃহীত পদ্ধতিতে তা ফুটে ওঠে। তাঁরা তাঁদের ভাষাগত জ্ঞান, তীক্ষ্ণ মেধা, রাসূলের সাহচর্য ও শরীয়তের হেকমত সম্পর্কে অবগত থাকায় শরয়ী বিধান বুঝতে সমস্যায় পড়তেন না। সাহাবীদের মাঝে যাদের কথায় উসূল আলী, প্রকাশ পেয়েছে, তাঁদের মাঝে অন্যতম হলেন- হযরত আবু বকর, ওমর, ওসমান, আবদুর রহমান ইবনে আওফ, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, মুয়ায ইবনে জাবাল, যায়েদ ইবনে সাবেত (রা) ও হযরত আয়েশা (রা) প্রমুখ ।

সাহাবীগণের উসুল : সাহাবীগণ তাঁদের সময়ে সংঘটিত নতুন ঘটনাকে কুরআন বা সুন্নাহর সাথে হুবহু মিলে যায় এমন ঘটনার সাথে তুলনা করে তদনুসারে ফতোয়া দিতেন। এক্ষেত্রে তাঁদের পদ্ধতি ছিল মূল পাঠে ব্যবহৃত শব্দাবলির পরীক্ষা নিরীক্ষা, এর প্রয়োগ পদ্ধতি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের আলোকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তাৎপর্য ও আইনগত গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা।

আরো পড়ুন : উসুলুল ফিকহ কাকে বলে? উসূলে ফিকহের আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য

১. হযরত আবু বকর কর্তৃক গৃহীত উসুল : হযরত আবু বকর (রা)-এর পদ্ধতি সম্পর্কে মায়মুন ইবনে মাহরান বলেন, আবু বকরের শাসনকালে কোনো বিবাদ উপস্থিত হলে তিনি প্রথমে কুরআন খুলে দেখতেন, তারপর হাদীস দেখতেন, তারপরও সমাধান পাওয়া না গেলে সাহাবীগণের মাঝে পেশ করতেন, যদি তাঁদের থেকে জবাব না পেতেন তখন তাঁর ব্যক্তিগত বিচক্ষণতার সাহায্যে নসের ব্যাখ্যা করে অথবা তার ভাবার্থ থেকে অথবা কেবল ইজতেহাদের ভিত্তিতে মত গঠন করতেন।

২. হযরত ওমর কর্তৃক গৃহীত উসূল : হযরত ওমর (রা)-এর ইজতেহাদের অনুশীলনের প্রতি নজর দিলে আমরা দেখব যে, তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য সুস্পষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। তিনি সর্বপ্রথম ভুল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাবধানতা হিসেবে অথবা দুর্নীতি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে এবং আইনের আওতায় সহজতর ও সবচেয়ে বেশি উপযোগী পন্থা হিসেবে জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে এ সকল ফতোয়া প্রদান করেছেন।

৩. হযরত ওসমান কর্তৃক গৃহীত উসূল : হযরত ওসমান (রা) পূর্ববর্তী খলিফাদ্বয়ের গৃহীত সিদ্ধান্তাবলির ভিত্তিতে পথ চলার শপথ নেন, তথাপি তাঁর নিজস্ব কিছু ইজতেহাদ ছিল।

৪. হযরত আলী কর্তৃক গৃহীত উসূল : হযরত আলী (রা) বিভিন্ন বিষয়ে ইজতেহাদ করেছেন। তিনি তাঁর নিজের মতামত প্রদান করতে গিয়ে কেয়াস, ইসতিসহাব ইসতিহসান এবং ইসতিসলাহের ভিত্তিতে ইজতেহাদ করতেন। শরীয়তের বৃহত্তম লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি তাঁর মতামত প্রদান করতেন। তিনি মদ্যপানকারীর শাস্তি সম্পর্কে বলেছেন- اِنَّ إِذَا شَرِبَ هَذَى وَإِذَا هَذَى قَذَفَ فَيَجِبُ حَدٌ الْقَذَفِ .

অর্থাৎ, মদ্যপানকারী আবলতাবল বকে। আর যখন সে বকে তখন মিথ্যা অপবাদ দেয়, কাজেই মদ্যপানকারীকে মিথ্যা অপবাদদানকারীর শাস্তি প্রদান করা হবে। তাঁর এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায় সর্বশেষ ফলাফলের ভিত্তিতে হুকুম প্রদান করা হবে। এটি একটি মূলনীতি, যার আলোকে অসংখ্য মাসয়ালা বের করা হয়।

আরো পড়ুন : উসূলে ফিকহের উৎস কয়টি ও কি কি এবং উসূলে ফিকহের গুরুত্ব

৫. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের উসূল : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর ফিকহের ওপর হানাফী মাযহাবের মূলভিত্তি। এ সাহাবী উঁচু স্তরের ফকীহ ছিলেন, তাঁর গবেষণা পদ্ধতি ছিল অনন্য। তন্মধ্যে গর্ভবর্তী বিধবা সম্পর্কে তাঁর ফতোয়াটি উল্লেখযোগ্য। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) গর্ভবতী বিধবা সম্পর্কে বলেন, তার ইদ্দত প্রসব পর্যন্ত সময়কাল। দলীল হলো আল্লাহর বাণী- وَأُوْلَاتُ ٱلْأَحْمَالِ أَجَلُهُنَّ أَنْ يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ

এরপর তিনি বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, বড় সূরা বাকারা এর পর ছোট সূরা তালাক নাযিল হয়েছে। আর এ আয়াতটি দ্বিতীয় সূরার। তার এ কথা থেকে বোঝা যায়, পরে যা নাযিল হয়েছে তা হলো নাসেখ আর পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তা হলো মানসুখ । অর্থাৎ তিনি নসখ নীতির অনুসরণে ফতোয়া প্রদান করেছিলেন। কাজেই দাবি করা যায় যে, সাহাবীগণ তাঁদের ইজতেহাদের বেলায় নির্দিষ্ট উসূল অনুসরণ করেছেন।

খ. তাবেয়ীদের যুগে উসূলে ফিকহ : সাহাবীগণের পর যারা ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাঁদের অধিকাংশ মাওয়ালী তথা মুক্ত দাস ছিলেন। যেমন হযরত নাফে (র) ইবনে ওমরের মাওলা ছিলেন। হযরত ইকরামা হযরত ইবনে আব্বাসের ক্রীতদাস ছিলেন। এছাড়া হযরত ভাউস, হাসান বসরী, মুহাম্মদ ইবনে সিরীন, সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব ও হযরত ইবরাহীম নখয়ী অন্যতম ছিলেন। তাবেয়ীদের যুগে ঘটনাবলির বিস্তৃতির কারণে ইজতেহাদের পরিধি বেড়ে যায়, এ যুগে উসূলে ফিকহের নীতি অনুসৃত হয়েছে। ইবরাহীম নখয়ী মাসয়ালা প্রণয়নে কেয়াসের নীতিমালা অনুসরণ করেছেন।

গ. মুজতাহিদ ফকীহগণের যুগে উসূলে ফিকহ : মুজতাহিদগণের যুগ বলতে চার ইমামসহ অন্যান্য মুজতাহিদের কথা বোঝানো হয়েছে। নিম্নে মুজতাহিদ ফকীহগণের যুগে উসূলে ফিকহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।

আরো পড়ুন : উসুলুশ শাশী গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য

১. আবু হানীফা কর্তৃক রচিত উসূল : ইমাম আবু হানীফা (র) ও তাঁর সঙ্গীগণ ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে মাসয়ালা মাসায়েল উদ্ভাবন করেন। তাঁদের মূলনীতিসমূহ ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ (র)-এর উসূল গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে; কিন্তু বর্তমানে এ গ্রন্থদ্বয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান নেই। পরবর্তী হানাফী ইমামগণের বিভিন্ন গ্রন্থে সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

২. শাফেয়ী কর্তৃক রচিত উসূল : ইমাম শাফেয়ী (র) ইমাম মালেক ও আবু হানীফা (র)-এর পরবর্তী যুগে শ্রেষ্ঠ ফকীহ হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি الرِّسَالَةُ নামক গ্রন্থ রচনা করেন । এ গ্রন্থে তাঁর মাযহাবের কয়েকটি নীতিমালা তুলে ধরেন। তিনিই সর্বপ্রথম উসূলশাস্ত্রের গ্রন্থ রচনা করেন ।

৩. আহমদ কর্তৃক রচিত উসূল : ইমাম শাফেয়ী (র)-এর ছাত্র ইমাম আহমদ উসূলে ফিকহ সম্পর্কে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তা হলো- ১. আন নাসেখ ওয়াল মানসুখ, ২. আস সুন্নাহ্, ৩. আত তাওয়াতুর।

ইমাম আবু হানীফা (র) নস না পেলে সাহাবীগণের ফতোয়া দেখতেন, যদি তাও না পেতেন তাবেয়ীগণের ফতোয়া গ্রহণ না করে ইজতেহাদ করতেন। তিনি কেয়াস ও ইসতিহসানের পথে নির্দিষ্ট উসূল অনুসরণপূর্বক ইজতেহাদ করতেন।

একই সময় ইমাম মালেক (র) মদিনায় নিজস্ব গতিতে ও পদ্ধতিতে ফিকহ রচনা করেন । তিনি কুরআনবিরোধী কোনো কোনো বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করেন। অনুরূপভাবে দীনের কোনো নীতি বিরোধী বর্ণনাকে প্রত্যাখ্যান করতেন। যেমন তিনি খবরে ওয়াহেদ إِذَا وَلَغَ الْكَلْبُ فِي إِنَاءِ أَحَدِكُمْ غَسَلَهُ سَبْعًا প্রত্যাখ্যান করেন।এছাড়াও তিনি خِيَارُ مَجْلِسٍ ও মৃতের পক্ষ হতে সদকা আদায় সংক্রান্ত হাদীসদ্বয় প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইমাম আবু ইউসুফ (র) তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ كِتَابُ ٱلْخَرَاجِ রচনায় নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করেন ।

আরো পড়ুন : ফিকহ শব্দের অর্থ কি?কাকে বলে। গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

আমার মূল লক্ষ্য একটাই (Sikkhagar-শিক্ষাগার) ওয়েবসাইটের হাত ধরে “শিক্ষা হবে উন্মুক্ত ও বাণিজ্যমুক্ত”। এই প্লাটফর্মে থাকবে একাডেমিক প্রস্তুতি, ভর্তি প্রস্তুতি, চাকরি প্রস্তুতি, স্পেশাল স্কিল এবং ধর্মীয় শিক্ষাসহ নানাবিধ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ।

Leave a Comment