কোনো ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কে তথ্য, উপাত্ত, সিদ্ধান্ত ও ফলাফলসহ খুঁটিনাটি অনুসন্ধান করে যে বিবরণী লিপিবদ্ধ করা হয় তাকেই প্রতিবেদন বলে। ইংরেজি Report শব্দের বাংলা পারিভাষিক শব্দ ‘প্রতিবেদন’। যিনি প্রতিবেদন রচনা করেন তাকে বলা হয় প্রতিবেদক। নির্দিষ্ট কোনো বিষয় সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে সুস্পষ্টভাবে অবহিত করা, জটিল বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা প্রদান ইত্যাদি উদ্দেশ্যে প্রতিবেদন রচনা করা হয়।
প্রতিবেদন কী :
ইংরেজি Report শব্দের প্রতিরূপ হিসেবে ‘প্রতিবেদন’ শব্দটি ব্যবহার হয়। Report- এর আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থ সমাচার, বিবরণী বা বিবৃতি হলেও প্রতিবেদন শব্দটি সমধিক প্রচলিত । প্রকৃতপক্ষে কোন ঘটনা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ, তথ্যভিত্তিক বর্ণনাত্মক বিবরণকে প্রতিবেদন বলা যেতে পারে। অবশ্য প্রতিবেদন ও সংবাদ পরিবেশনের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান। সংবাদ পরিবেশনের সময় সাংবাদিক নিরপেক্ষ থেকে ঘটনা বর্ণনা করেন, যেখানে তার ব্যক্তিগত মতামতের বিষয়টি অবশ্যই গৌণ। কিন্তু প্রতিবেদন রচনার ক্ষেত্রে প্রতিবেদক উদ্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা সংযুক্ত করতে পারেন। তবে প্রতিবেদকের মূল্যায়ন যেন সীমাহীন আবেগে ভেসে না যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এদিক দিয়ে একই বিষয় ‘সংবাদ’ ও ‘প্রতিবেদন’ উভয় প্রকারের আকার গ্রহণ করতে পারে। সংবাদপত্র বা সাময়িকীতে প্রকাশিত কোন বিষয়ের ওপর নিজস্ব মতামত ও মন্তব্যসহ প্রতিবেদন লিখিত হতে পারে ।
প্রতিবেদনের আলোচ্য বিষয় :
প্রতিবেদনের আলোচনার ক্ষেত্র ব্যাপক। বলা যায়, যে কোন বিষয়ে প্রতিবেদন রচিত হতে পারে। সাংস্কৃতিক বা ক্রীড়া সংগঠনের কার্যাবলি, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতা, রাজনৈতিক বা সামাজিক কর্মকাণ্ড, জাতীয় বা আঞ্চলিক সমস্যা, আন্তর্জাাতিক ঘটনাবলি – এসব বিষয়ই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু হতে পারে। সংবাদপত্রই প্রতিবেদন প্রকাশস্থল। তবে কিছু কিছু স্থলে এর ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যায়।
কোন সংগঠনের বার্ষিক সভায় সংগঠন প্রধান কর্তৃক প্রদত্ত কার্যাবলির বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশ না পেলেও সেটিকে প্রতিবেদন বলতে বাধা নেই। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পরিচালক কিংবা কোন সংগঠনের সম্পাদকের বার্ষিক বিবরণ এ শ্রেণির আওতাভুক্ত। সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক কর্মকর্তা যখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বার্ষিক বা সাময়িক বিবরণী পাঠান, তখন সেটিও প্রতিবেদন । বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনও এ পর্যায়ে পড়ে ।
তাছাড়া প্রতিবেদনের ভাষা সরল ও সহজবোধ্য হতে হয়। কারণ সাধারণ মানুষ এর পাঠক। আকর্ষণীয় উপস্থাপনা ও সরল বর্ণনাভঙ্গিও প্রতিবেদনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিষয়ভিত্তিক শিরোনাম যেন পাঠককে অতি সহজে আকৃষ্ট করতে পারে সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন । এক কথায় প্রতিবেদন হলো সহজবোধ্য ভাষায় লিখিত আকর্ষণীয় শিরোনামযুক্ত কোন বিবরণী।
আরো দেখুন : বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সম্পর্কে প্রতিবেদন-স্কুল ও মাদ্রাসা
প্রতিবেদন কাকে বলে ?
কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধানের পর সে বিষয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পেশকৃত ধারাবাহিক বিবরণীকে প্রতিবেদন বলে। কোন তথ্য, ঘটনা বা বক্তব্য সম্পর্কে বর্ণনা দানই প্রতিবেদন ।
প্রতিবেদনের বিষয় :
সম্প্রতি প্রতিবেদন শব্দটি বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত। এতে কোন কাজের বিভিন্নমুখী বর্ণনা প্রকাশ পায়। এতে কাজের নির্দেশ, পরামর্শ, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয় । যিনি প্রতিবেদন রচনা করেন, তাকে বলা হয় প্রতিবেদক। প্রতিবেদকের কাজের ফলই প্রতিবেদন। প্রতিবেদক কোন বিষয়ের তথ্য, উপাত্ত, সিদ্ধান্ত, ফলাফল ইত্যাদি যে কোন একটি বা কয়েকটি যথাযথ অনুসন্ধানের পরে বিবরণী তৈরি করে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিভাগে পেশ করেন। বিশেষ কৌশলে বা পদ্ধতিতে বিবৃতি বা বিবরণই প্রতিবেদন ।
প্রতিবেদন সম্পর্কে অভিমত :
কারো কারো মতে, তথ্যগত ও সত্যনিষ্ঠ বিবরণীকে প্রতিবেদন বলা হয়। অধ্যাপক হ্যাচ বলেন, প্রতিবেদন হলো একটি সুসংগঠিত তথ্যগত বিবৃতি বা কোন বক্তব্য সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত অথচ সঠিক বর্ণনা বিশেষ। একে যথেষ্ট সতর্কতা, পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণের পর তৈরি করা হয় ।
অন্যভাবে বলা যায়, প্রতিবেদন হলো কোন বিষয়ের পুনঃ উপস্থাপনা । এটি একটি বিশেষ কলাকৌশল, যার মাধ্যমে প্রতিবেদক প্রত্যক্ষভাবে পরীক্ষিত, বিশ্লেষিত, পর্যালোচিত ও নিরূপিত তথ্য বা ঘটনার বিবরণী তৈরি করে প্রকাশ করে থাকেন। এতে প্রতিবেদকের সুপারিশ থাকতেও পারে, আবার না থাকতে পারে ।
প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা :
প্রতিবেদন হলো সাধারণত পত্রিকায় যা প্রকাশ পায়। সময়ের বিবর্তনে মানুষ নানারকম ঝক্কি- ঝামেলা পোহায় । মানবজীবনের চলার পথের সমুদয় বাধা-বিপত্তি, উন্নতি-অবনতি সকল ব্যাপারই প্রতিবেদন পেশ করা হয় । অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান রয়েছে । নিম্নে প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হল-
১. যোগাযোগ মাধ্যম : প্রতিবেদন পাঠের মাধ্যমে ব্যক্তি যে কোন বিষয় খুঁটিনাটি অবগত হতে পারে। এর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নত হয় ।
২. সিদ্ধান্ত গ্রহণীয় : প্রতিবেদন যারা প্রস্তুত করেন তারা সিদ্ধান্ত ও গ্রহণীয় বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যাদি অবগত হয়ে আলোচ্য বিষয়ে বাস্তব প্রেক্ষিতে কোন সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারেন।
৩. আইন-আদালত : আইন-আদালত ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম ।
৪. বিরোধপূর্ণ ও জটিল : প্রতিষ্ঠান বা সমাজ ও পারিবারিক বিরোধপূর্ণ কোন জটিল বিষয় প্রতিবেদনের মাধ্যমে বর্ণনা করা যায়।
৫. ব্যবস্থাপনায় সাহায্য : ব্যবসায় ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কার্যাবলিকে সহজ করে দেয়। বিশেষ করে ব্যবস্থাপনার কাজের মধ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ, সংগঠন, নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ, ফলাফল নিরূপণ, সমন্বয় সাধন ইত্যাদি কাজে প্রতিবেদন বিশেষ সাহায্য করে থাকে।
৬. বস্তুনিষ্ঠ নির্ণয়ন : প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা নির্ণয় একটা বড় জিনিস। প্রতিবেদন যদি সত্য, সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ না হয় তাহলে তা প্রতিবেদন হতে পারে না ।
৭. অত্যাধুনিক ধারা অবলম্বন : অত্যাধুনিক ধারার ব্যাপারেও বেশ গুরুত্ব দেয়া হয় ।
৮. বিশেষ কৌশল অবলম্বন : প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা একান্ত প্রয়োজন । সেক্ষেত্রে যদি তা না হয় তাহলে লক্ষ্যানুযায়ী কাজ হবে না ।
৯. কোন বিষয়ে মতামত পেশ করা : কোন বিষয়ে মতামত প্রকাশ করতে এবং বিষয়টির দোষ-গুণ জনসমক্ষে তুলে ধরতে প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আরো দেখুন : প্রতিবেদন : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ ও এর প্রতিকার সম্বন্ধে
প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য :
প্রতিবেদন রচনার কতকগুলো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নরূপ—
- বিষয়বস্তু সম্পর্কে সুষ্পষ্টভবে অবহিত হওয়া ৷
- নিরপেক্ষভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা৷
- কাজের সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা ৷
- জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করা ৷
- কোন বিষয়ে মতামত প্রদান করা ৷
- সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা দান করা ৷
প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য :
প্রতিবেদনের যে সকল নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা নিম্নরূপ-
- নির্দিষ্ট কাঠামো ও নিয়মানুযায়ী রচিত হতে হবে।
- কোন নির্দিষ্ট ঘটনা অবলম্বনে লেখতে হবে।
- বক্তব্য যুক্তিযুক্ত হতে হবে।
- নিরপেক্ষভাবে রচিত হতে হবে।
- প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত আবেগ বহির্ভূত হতে হবে।
- বাহুল্যবর্জিত ও সংক্ষিপ্ত হতে হবে।
- বক্তব্য হবে সহজ ও সরল।
- মন্তব্য ও সুপারিশ থাকতে হবে।
প্রতিবেদন লেখার নিয়ম :
প্রতিবেদন রচনা লেখার জন্য বিশেষ কতকগুলো বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো-
ক. নির্দিষ্ট কাঠামো : প্রতিবেদন রচনার লেখার জন্য একটি কাঠামো অনুসরণ করা প্রয়োজন। এতে সাধারণ শিরোনাম, প্রাপকের নাম, ঠিকানা, সূচিপত্র, বিষয়বস্তু, তথ্যপঞ্জি, স্বাক্ষর, তারিখ ইত্যাদি থাকে ।
খ. সঠিক তথ্য : প্রতিবেদন রচনার আগে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রতিবেদককে সংগ্রহ করতে হবে।
গ. স্পষ্টতা : এমনভাবে প্রতিবেদন রচনা করতে হবে, যাতে বক্তব্যের কোথাও বিন্দুমাত্র অস্পষ্টতা না থাকে ।
ঘ. সংক্ষিপ্ততা : দীর্ঘ ও বাহুল্যপূর্ণ বক্তব্য মূল লক্ষ্য থেকে বিছিন্ন হতে পারে এবং বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। তাই প্রতিবেদনের বক্তব্য হতে হবে সংশ্লিষ্ট।
ঙ. উপস্থাপনা ও পরিবেশনা : প্রতিবেদনের উপস্থাপনা হতে হবে আকর্ষণীয় । এর বক্তব্য সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় পরিবেশিত হতে হবে।
চ. সম্পূর্ণতা : প্রতিবেদনের পরিবেশিত তথ্য হতে হবে নির্ভুল, সম্পূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য।
ছ. সুপারিশ : একটি সম্পূর্ণ প্রতিবেদনের উপসংহারে সুপারিশ সংযোজিত হতে হবে ।
আরো দেখুন : প্রতিবেদন:একুশে ফেব্রুয়ারি/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে
প্রতিবেদন কয় প্রকার ও কী কী ?
প্রতিবেদন বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। প্রতিবেদনকে যে কয় শ্রেণীতে ভাগ করা যায় তা নিম্নে উল্লেখ করা হল-
- রীতিসিদ্ধ প্রতিবেদন।
- নিয়মিত প্রতিবেদন।
- বিশেষ প্রতিবেদন।
- প্রচলিত প্রতিবেদন।
- কোম্পানি প্রতিবেদন।
- অবিধিবদ্ধ প্রতিবেদন।
- সংবাদপত্রের প্রতিবেদন।
- রীতি বিরুদ্ধ প্রতিবেদন।
- সাময়িক প্রতিবেদন।
- নির্বাহী প্রতিবেদন।
- অপ্রচলিত প্রতিবেদন।
- বিধিবদ্ধ প্রতিবেদন।
- সরকারি প্রতিবেদন।
- তদন্ত প্রতিবেদন ।
একটি সুন্দর প্রতিবেদন তৈরি করতে হলে উপরিউক্ত বিষয়গুলো অবগত থাকতে হবে। প্রতিবেদনের আকার, শ্রেণী, বৈশিষ্ট্য, রীতিনীতি ও বিষয় বিন্যাসের ওপর ধারণা থাকতে হবে। প্রতিবেদন ছোট হতে পারে আবার বড় হতে পারে। ছোট প্রতিবেদনে শিরোনাম, বিষয়বস্তু, সুপারিশ ও উপসংহার থাকে । আবার বড় প্রতিবেদন পুস্তকাকারে হতে পারে। সেখানে সারণি চিত্র, নকশা ছক, পরিশিষ্ট, তথ্য নির্দেশ, পরিভাষ্য, পরিচিতি ইত্যাদি থাকতে পারে এবং বহু কিছুর বর্ণনা, ব্যাখ্যা ও পাদটীকা থাকতে পারে।
নিচে নমুনাস্বরূপ কিছু প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলো-
১। ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকের ভূমিকা’শীর্ষক মুক্ত আলোচনা সভার ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি কর।
৭ই মে, ২০২…
বরাবর
মহাপরিচালক,
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদন্তর, ঢাকা।
বিষয়: ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকের ভূমিকা’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা সভার প্রতিবেদন।
সূত্র : ত্র: ম.উ.শ.৩/০৯(০৭)/২০২…
জনাব,
গত ৫ই মে, ২০২…ঢাকাস্থ ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের উদ্যোগে দিনব্যাপী মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আপনি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পেশের আদেশ প্রদান করার প্রেক্ষিতে আমি নিম্নোক্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করছি।
‘শিক্ষার মানোন্নয়নে ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকের ভূমিকা’ শীর্ষক একটি মুক্ত আলোচনা গত ৫ই মে, ২০২…ঢাকা ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক মহোদয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধান অতিথিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। এরপর স্বাগত ভাষণ দেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক। তারপর ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকের ভূমিকা’ বিষয়ে মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মুক্ত আলোচনায় প্রথমে অংশগ্রহণ করেন তা’মীরুল মিল্লাত কামিল
মাদরাসা, ঢাকা-এর অধ্যক্ষ মহোদয়। তিনি বলেন, শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবকের সম্মিলিত প্রয়াস ও পারস্পরিক সহযোগিতায় শিক্ষার যথার্থ লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। তবে সবার মধ্যে শিক্ষককেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয় এবং এক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব সর্বাধিক। এছাড়া শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহতৈরির জন্য অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা তাঁর বক্তব্যে বলেন, শিক্ষার মান কমে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। গ্রামীণ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেই, সবাইকে ভর্তি করতে হয়। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি চর্চা অবহেলিত হওয়ায় মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে দুর্বল থাকে। অভিভাবকগণ তাঁদের সন্তানের সঠিক ও যথার্থ শিক্ষার ব্যাপারে সচেতন নন। তাছাড়া মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে সমাজে এখনো সেভাবে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। বিদ্যালয় পরিচালনায় অনেক সময় পরিচালনা কমিটির সাথে শিক্ষকদের মতানৈক্যের সৃষ্টি হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ধানমন্ডি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলোচনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য শিক্ষকের ভূমিকাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ‘অভিভাবকদের সচেতন করার দায়িত্বও শিক্ষকের। তিনি আরও বলেন, শিক্ষকদের আর্থিক সমস্যা দূর করারও উদ্যোগ নিতে হবে। কবি নজরুল কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় বলেন, শিশুদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষককে নিজ পেশার প্রতি আন্তরিক হতে হবে। বর্তমানে সমাজে যে নৈতিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে তার জন্য শিক্ষকরাও কিছুটা দায়ী। তাই এ অবক্ষয় প্রতিরোধ করতে শিক্ষকদের চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষককেও দায়িত্ববান হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সেন্ট্রাল বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার অভিমত, শিক্ষার মানোন্নয়নে অভিভাবকদের ভূমিকাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে শিক্ষকেরও দায়িত্ব রয়েছে, সেই সাথে শিক্ষার্থীদেরও ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। সবার মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে চলতে হবে। নবাবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, শিক্ষার্থীদের চাহিদা বিবেচনা করে শিক্ষাব্যবস্থা গড়েতুলতে হবে।
প্রধান অতিথি তাঁর ভাষণে বলেন, শিক্ষাকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করার নিমিত্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছু বাস্তবধর্মী ওকার্যকর পদক্ষেণ গ্রহণ করেছে। এর ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই উপকৃত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সভাপতি তাঁর ভাষণে বলেন, শিক্ষককে অর্থলোলুপ হলে চলবে না। শিক্ষকতার প্রতি শিক্ষকের আন্তরিকতা থাকতে হবে। এছাড়া শিক্ষককে হতে হবে দায়িত্ব সচেতন। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সভাপতির ভাষণের মাধ্যমেই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে।
নিবেদক
আবিদা সুলতানা, দক্ষিণ কেরানিগঞ্জ, ঢাকা
২. বন্যাদুর্গত এলাকার কয়েকটি রিলিফ ক্যাম্পের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনা কর।
বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত : রিলিফ ক্যাম্পে খাদ্য যাচ্ছে না।
নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা, ২০ আগস্ট ২০২……। অতিবর্ষণ না হলে বা উজান থেকে ঢল না নামলে সারাদেশের সামগ্রিক বন্যা পরিস্থিতি দু’তিনটি জেলা বাদে আগামীকাল থেকে উন্নতির দিকে যেতে পারে। শনিবার ঢাকা, চাঁদপুর এবং সিলেট বাদে সব জেলার ‘বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি ঘটে। ভরা পূর্ণিমার প্রভাব কেটে যাওয়ার ফলে বন্যার পানি আজ দ্রুত বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হবে বলে আবহাওয়া অফিস জানায়। শুক্র ও শনিবার দেশে বর্ষণের পরিমাণও তেমন ছিল না বলে একজন আবহাওয়াবিদ জানান। এসব স্থান থেকে পানি নামতে সময় নেবে।
সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির সামান্য অবনতির কারণ প্রসঙ্গে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানা যায় যে, উজান থেকে নেমে আসা পানি কুশিয়ারা অমলশিদে ২১ সে. মি. বেড়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। তবে সিরাজগঞ্জের উজানে ব্রহ্মপুত্রের পানির স্তর কমে থেমে গিয়ে স্থির রয়েছে। ভৈরব বাজার থেকে ভাটির দিকে মেঘনার পানির স্তরও অপরিবর্তিত রয়েছে।
ঢাকা-মাওয়া-খুলনা ও ঢাকা-মুন্সিগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মুন্সিগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও জেলা শহরের ৮৭% এখনো পানির নিচে রয়েছে বলে গতকাল নিজস্ব সংবাদদাতা জানান।
এদিকে এক তথ্য বিবরণীতে জানা গেছে যে, সৃষ্ট বন্যার কারণে বিভিন্ন এলাকায় রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে গত দু’দিনে ডায়রিয়াসহ ১৮০ জন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন চলছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। সরকারের ত্রাণ তহবিল থেকে যে সামান্য পরিমাণ চাল-ডাল, চিড়া-মুড়ি বিতরণ করা হচ্ছে তা দুর্গতদের কোনোই উপকারে আসছে না।
আমাদের বিশেষ সংবাদদাতা সরেজমিনে পরিদর্শন করে জানিয়েছেন যে, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলা মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় যে রিলিফ ক্যাম্পটি রয়েছে, সেখানে সরকারি রিলিফ নামকাওয়াস্তে যাচ্ছে। সরকারি ক্যামেরা বন্ধ হলেই রিলিফ দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা যে খাদ্য দিচ্ছে তা অপর্যাপ্ত ও অপ্রতুল। জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি খাদ্য পাচ্ছে না। গজারিয়ায় মেডিক্যাল টিম এখনো যায়নি। ফলে শিশু সন্তানদের বাঁচানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকার সবুজবাগে অবস্থিত কয়েকটি রিলিফ ক্যাম্পের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানিয়েছেন, ক্যাম্পের অসহায় মানুষ ঠিকমতো রিলিফ পাচ্ছে না। গত কয়েকদিন যাবৎ যে রিলিফ ও খাদ্য গিয়েছে তার মধ্যে কাপড়, ওষুধ ও রুটি-চিড়া রয়েছে। স্থানীয় জনগণ জানিয়েছে, যে রুটি দেয়া হচ্ছে তা পচা গন্ধযুক্ত। আর চিড়াও পোকাযুক্ত যা খেলে ডায়রিয়ার প্রকোপ আরো বেশি দেখা দিতে পারে। আমাদের প্রতিনিধিকে আটকে পড়া মানুষ কান্নাকাটি করে তাদের দুঃখের কথা জানান।
অন্যদিকে কামরাঙ্গির চর এলাকার রিলিফ ক্যাম্পের অবস্থা সম্পর্কে জানা গেছে যে, কামরাঙ্গির চরে কয়েক দিনে মশার প্রকোপ বেড়ে গেছে। সেখানে পানিবাহিত রোগে আরো ৬ জন প্রাণ হারিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, জায়গার স্বল্পতা, বিশুদ্ধ পানি ও ভালো খাবারের অভাবে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ যাবৎ বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার পক্ষ থেকে যে পানীয় ও খাদ্য অত্র রিলিফ ক্যাম্পের জনগণ পেয়েছেন, তার মধ্যে বেশি পচাবাসি রুটি থাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। দেশের এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত সম্প্রসারণ করা দরকার।
আরো দেখুন : পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য চাই- বৃক্ষরোপণ প্রতিবেদন
৩. বন্যার পর তোমার এলাকায় গৃহীত পুনর্বাসন কাজ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন রচনা কর ।
অথবা, বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসনের বর্ণনা দিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট একটি প্রতিবেদন রচনা কর।
বরাবর
জেলা প্রশাসক
কুমিল্লা ।
বিষয় : বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন প্রসঙ্গে।
জনাব,
সম্প্রতি ঘটে গেল শতাব্দীর ভয়াবহতম ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা যা আপনি অবিদিত নন। দেশের চারশ ষাটটি থানার তিনশটিতেই এ বন্যা তার ভয়াল থাবা বিস্তার করে। দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে বন্যাপীড়িত মেঘনা থানা অন্যতম। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় এ থানার যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। তবু বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আপনি আমাদের যে সাহায্য-সহযোগিতা করে আসছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। আপনি বন্যার্তদের পাশে আছেন বলেই তারা আজ নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।
প্রায় দেড় মাস স্থায়ী এ বন্যায় এলাকার সকল শ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক, শ্রমিক ও দিনমজুর শ্রেণির লোকেরা। খাবার সংকট ও জরুরি ওষুধ-পথ্যের অভাবে তাদের অনেকে এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যার আঘাতে এলাকার স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদরাসা, রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট, হাট-বাজার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের এবং এলাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পুনর্বাসন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, গরিব-দুঃস্থদের মধ্যে ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ, কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ-সার-কীটনাশক প্রদান, সুদমুক্ত ঋণ প্রদান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ ইত্যাদি মেরামতের জন্য কিছু কিছু সরকারি অনুদান। কিন্তু সার্বিক দিক বিবেচনা করলে ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় এসব অনুদান আশানুরূপ নয় ।
কুমিল্লা জেলার নিম্নাঞ্চলে নবগঠিত মেঘনা থানাটি এমনিতেই যুগ যুগ ধরে অবহেলিত। তার ওপর সাম্প্রতিক বন্যায় এর যে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন আরো অধিক পুনর্বাসন সহায়তা। আর পুনর্বাসন কর্মসূচির সাহায্য-সামগ্রী সাধারণ লোকদের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রয়োজন অসৎ শ্রেণির লোকদের প্রতিহত করা। কেননা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য ও দুর্নীতির জন্য সাধারণ মানুষ প্রায়ই সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
বন্যাপরবর্তী এলাকায় আমাশয়, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। কিন্তু এখানে স্থায়ীভাবে কোনো চিকিৎসক টিম কাজ করছে না। ব্র্যাক, প্রশিকাসহ কয়েকটি এনজিও কর্মীরা কিছু ওষুধ-পথ্য নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ালেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বন্যার সময়ে অনেক সমাজসেবী ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সাহায্য-সহযোগিতা করলেও এখন আর কেউ এগিয়ে আসছে না। এলাকার বেশিরভাগ মানুষ দিন কাটাচ্ছে অর্ধাহারে-অনাহারে, সর্বত্রই শিশুদের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।
এমতাবস্থায় কেবল সরকারি সাহায্য-সহযোগিতাই এ এলাকার মানুষগুলোকে নতুনভাবে বাঁচার পথ দেখাতে পারে। তাই বন্যাদুর্গত মেঘনা থানাবাসীর পুনর্বাসনের জন্য জেলা প্রশাসনের সহযোগিতার হাতকে আরো প্রসারিত করার অনুরোধ করছি।
তারিখ : ২০ অক্টোবর, ২০২…
প্রতিবেদক
হাসান আলী
মেঘনা থানা, কুমিল্লা।
৪. ‘বাংলাদেশের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা’- শিরোনামে একটি প্রতিবেদন রচনা ।
প্রতিবেদনের প্রকৃতি : সংবাদ প্রতিবেদন
প্রতিবেদনের শিরোনাম : বাংলাদেশের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা
সরেজমিনে তদন্তের স্থান : ‘ক’ ও ‘খ’ প্রতিষ্ঠান
প্রতিবেদন তৈরির সময় : সকাল ১১.০০ টা
তারিখ : ২৮শে মার্চ ২০২…
বাংলাদেশের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার । যেহেতু শৈশবেই মানুষের নৈতিক শিক্ষার ভিত রচিত হয়, তাই প্রাথমিক শিক্ষাই একজনের জীবনের মৌল ভিত্তি । জাতীয় অগ্রগতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে শিক্ষা অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। শিক্ষার গুরুত্বের দিকটিকে বিবেচনা করেই বলা হয় যে, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। বর্তমান সময়ে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই । বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার গুরুত্ব আরও অনেক বেশি । সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক স্তর বা ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। এ কারণেই বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ধারণা : বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বলতে বোঝায়, দেশের সকল বালক-বালিকার জন্য প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণকে রাষ্ট্রকর্তৃক অবশ্য কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা । এ ব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষার সকল দায়িত্ব সরকারকেই গ্রহণ করতে হয় এবং শিক্ষাগ্রহণকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক করা হয় । বাংলাদেশ থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করতেই বাংলাদেশ সরকার এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন ও তা চালুর ইতিহাস : বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয় ১৯৯০ সালে, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাশ হওয়ার পর । ব্রিটিশ আমল থেকেই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে । বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয় । তবে তা বাস্তবায়নে তখনও সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তাই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে জাতীয় সংসদে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাশ করে । উক্ত আইনের আওতায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী সকল ছেলে-মেয়েকে ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করার ব্যবস্থা নেওয়া হয় । ১৯৯২ সালে এ আইনের আওতায় সর্বপ্রথম ৬৮টি থানায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় । ১৯৯৩ সাল থেকে সারাদেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয় ।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনটি কার্যকর হবে শিশুদের ওপর, অর্থাৎ যাদের বয়স ছয় বছরের কম নয় এবং দশ বছরের বেশি নয় । তবে কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে এ আইন প্রয়োগে বাধার সৃষ্টি হতে পারে । এগুলো নিম্নরূপ :
১. অসুস্থতা বা অন্য কোনো অনিবার্য কারণে শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো সম্ভব না হলে;
২. শিশুর আবাসস্থল থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকলে;
৩. আবেদন করা সত্ত্বেও শিশুকে কোনো প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে না পারলে;
৪. প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের বিবেচনায় শিশু বর্তমানে যে শিক্ষা গ্রহণ করছে তা প্রাথমিক শিক্ষার সমমানের না হলে;
৫. প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের বিবেচনায় শিশুর মানসিক অক্ষমতার কারণে তাঁকে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো আবশ্যক না হলে ।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য যে এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে; সে এলাকায় ইউনিয়ন বা পৌর এলাকাসমূহের প্রত্যেকটি ওয়ার্ডের জন্য বাধ্যতামূলক ‘প্রাথমিক শিক্ষা কমিটি’ নামে একটি কমিটি রাখার কথাও বলা হয়েছে এ আইনে ।
প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে সরকারি উদ্যোগ : বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে । সরকার নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেগুলো নিম্নরূপ :
১. নবনির্মিত সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অনুমোদন দান এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতকরা ৬০ ভাগ শিক্ষিকা নিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ ।
২. স্যাটেলাইট স্কুল ও কমিউনিটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিশুদের ভর্তির সুযোগ বৃদ্ধি করা ।
৩. ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে বই ও পোশাক বিতরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ ।
৪. গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ও পরবর্তীতে উপবৃত্তি চালু গ্রহণ ।
৫. ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা এবং ২০১৮ সাল নাগাদ এই সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ।
৬. প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্ন এনজিওকেও অংশীদার করা হয়েছে, যার মধ্যে ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, ব্র্যাক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।
প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে সরকারের এসব পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় । এসব পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে বাংলাদেশ থেকে অচিরেই নিরক্ষরতা দূর হবে বলে আশা করা যায় ।
বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব : বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই । দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা সর্বাগ্রে গুরুত্বপূর্ণ । সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হলো এ বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা । এর আওতায় শিশুদের আনা সম্ভব হলে, তা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় একটি অর্জন হবে । একজন নাগরিক প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করলে জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখার যোগ্যতা অর্জন করে । উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমাদের শিক্ষার হার বাড়াতে হবে । এ উদ্দেশ্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনকে কঠোরভাবে বলবৎ করা একান্ত প্রয়োজন । জাতীয় জীবনের পূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে সবার জন্য এক ও অভিন্ন শিক্ষানীতি চালু করতে হবে । তবেই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হবে ।