হোম পদার্থ রসায়ন জীব ইসলামিক

রচনা : আকাশ সংস্কৃতি / আকাশ সংস্কৃতি ও আমাদের করণীয়

উপস্থাপনা:

বর্তমান যুগকে Age of Science বা বিজ্ঞানের যুগ বলা হয়। কারণ বিজ্ঞানের জয়জয়কার অবস্থা এখন বিশ্বব্যাপী। সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত অবাধ তথ্য প্রবাহ এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার (Electronic Media) বদৌলতে একটি নতুন ভাবনা ও বাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো আকাশ সংস্কৃতি। বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে ভীষণ ব্যস্ত মানুষ আকাশ-সংস্কৃতির করাল আগ্রাসনের শিকার।

আকাশ সংস্কৃতি:

সংস্কৃতি শব্দের অর্থ বিনোদন, কর্ষণ, সংশোধন, শুদ্ধিকরণ। অনুশীলন দ্বারা লব্ধ বিদ্যা-বুদ্ধি, রীতিনীতি ও মার্জিত আচার-আচরণ ইত্যাদির উৎকর্ষ হলো কৃষ্টি (Culture) বা সংস্কৃতি। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে আকাশ-সংস্কৃতির নেটওয়ার্ক বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অধিকারিগণ তাদের মতবাদ, ধ্যান-ধারণা, তথ্য, বিনোদন, শিক্ষা ইত্যাদি উপস্থাপন করে বিশ্বমানব গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। মানুষ তা’ থেকে শিখছে এবং এসব সংস্কৃতি গ্রহণ করছে।

আরো পড়ুন : মানব কল্যাণে বিজ্ঞান অথবা বিজ্ঞানের জয়যাত্রা – রচনা | PDF

আকাশ সংস্কৃতির সূচনা:

প্রাচীন যুগে পায়রার পায়ে পত্র বেঁধে রাজায় রাজায় বা’ রণাঙ্গনে খবর পৌছানো থেকে আকাশ পথ ব্যবহারের ধারণা জন্মে। ইতালির বিজ্ঞানী মার্কনি বেতার আবিষ্কার (১৮৯৫) করলে আকাশ-সংস্কৃতির আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। জন লজি বেয়ার্ড ১৯২৫ সালে টেলিভিশন আবিষ্কার করেন। এর ফলে আকাশ-সংস্কৃতিতে বিপ্লব সাধিত হয়। মানুষ এসব মাধ্যমে প্রচার করতে শুরু করে তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার উদ্যোক্তাগণ বিভিন্ন তথ্য, বিষয়াদি, বুদ্ধিবৃত্তি, আবিষ্কার, বিনোদন সাধারণ দর্শক-শ্রোতার নিকট বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা চালায়।

আকাশ সংস্কৃতির প্রকারভেদ:

আকাশভিত্তিক মাধ্যমে (Media) বিভিন্নতার কারণে আকাশ-সংস্কৃতির বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ করা যেতে পারে। যথা- বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে শুধু তথ্য শ্রবণ করা যায়। টেলিভিশনের মাধ্যমে শোনার পাশাপাশি অনুষ্ঠান উপস্থাপক, পাত্রপাত্রী সবকিছু দেখাও যায়। আধুনিক কালের সর্বাধুনিক মাধ্যম (Media) ইন্টারনেটের মাধ্যমে শোনা, দেখা ছাড়াও তথ্য ডাউনলোড করে প্রিন্ট নেয়া যায়।

আকাশ সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক:

আকাশ সংস্কৃতি বা আকাশভিত্তিক মাধ্যমে পরিচালিত অনুষ্ঠানাদির বিভিন্ন দিক ও বিভাগ রয়েছে। যথা-

ক. সংবাদ: আকাশভিত্তিক প্রচার মাধ্যমের অন্যতম দিক সংবাদ পরিবেশনা। আধুনিক আকাশ-সংস্কৃতির মাধ্যমসমূহ বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করে।

আরো পড়ুন : ডিজিটাল বাংলাদেশ – রচনা ১৫০, ২৫০ এবং ৫০০ শব্দের

খ. শিক্ষা: আকাশ-সংস্কৃতির বিশেষ দিক হলো শিক্ষা। বর্তমান সময়ের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষামূলক প্রোগ্রামও প্রচারিত হয় বেতার ও টেলিভিশনে।

গ. বিনোদন: আকাশ-সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রভাবশালী বিষয় হলো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। বাহারি অনুষ্ঠানাদি মানুষের চিত্তবিনোদনে সহায়ক হলেও যৌন-উদ্দীপক ও অশ্লীল অনুষ্ঠান প্রচার আকাশ-সংস্কৃতির সর্বাধিক ক্ষতিকর দিক হিসেবে চিহ্নিত।

ঘ. অন্যান্য: আকাশ-সংস্কৃতির মাধ্যমে আরো বিবিধ অনুষ্ঠানাদি প্রচারিত হয়। যেমন- খেলাধুলা, প্রামাণ্য অনুষ্ঠানাদি, ধর্মসংক্রান্ত বিষয়াবলি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক তথ্যাদি, কৃষিতথ্য, বাজার ব্যবস্থা, আবহাওয়া ইত্যাদি।

আকাশ সংস্কৃতি ও গোয়েবলসীয় তত্ত্ব:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানির চ্যান্সেলর হিটলার তাঁর প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্ব দিয়েছিলেন গোয়েবলসের ওপর। গোয়েবলসের মতে, “একটি মিথ্যা সংবাদ বারবার প্রচার করলে তা সত্য হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে।” বর্তমান আকাশ-সংস্কৃতির তথ্য সম্প্রচার গোয়েবলসীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষত ইসলামী আন্দোলন ও মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে চলছে নগ্ন তথ্যসন্ত্রাস। এমনি তথ্যসন্ত্রাসের শিকার আজ আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিন, আলজেরিয়া, লেবানন, মিসর, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সকল মুসলিম দেশ। গোয়েবলসের আধুনিক প্রেতাত্মারা ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে হামলার ধুয়ো তুলে প্রমাণহীনভাবে তা মুসলিম বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দেয়।

অশ্লীল জাহেলী সংস্কৃতি:

আধুনিক যুগে আকাশ-সংস্কৃতির ভয়াবহ দিক হলো অশ্লীলতার বিস্তার। অশ্লীল যৌনোদ্দীপক নৃত্য, নারীদেহের নগ্ন প্রদর্শনী ইত্যাদির ফলে যুবসমাজের চরিত্র ধ্বংস হচ্ছে। সুষ্ঠুভাবে সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার পরিবর্তে যৌনাচারী অসভ্য জাহেলী বিকার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে উঠছে যুবসমাজ। ফলে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে ধর্ষণ, সম্ভ্রমহানী ও বেশ্যাবৃত্তির। আধুনিক সমাজ সভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে আকাশ-সংস্কৃতির প্রচার মাধ্যমসমূহ।

আরো পড়ুন : রচনা সহজ : দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান [ Class 6, 7, 8, 9, 10 ]

সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিস্তার:

আধুনিক আকাশ-সংস্কৃতি বিশেষত স্যাটেলাইট ডিশ অ্যান্টিনার বিস্তারের ফলে সামাজিক ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসনির্ভর ও নৈরাজ্যকর। । স্যাটেলাইট ডিশ অ্যান্টিনার বিভিন্ন চ্যানেলে মানুষ শিখছে সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি, মাদকদ্রব্যাদির বিস্ত ার, অন্যায় ও অশ্লীলতা। ফলে সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। বিস্তার লাভ করছে সন্ত্রাস, রাহাজানি, চাঁদাবাজি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষা ছেড়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে সন্ত্রাসীদের। শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে, কিন্তু আকাশ-সংস্কৃতির ভয়াবহ ছোবলে চরিত্র গঠনের পরিবর্তে সৃষ্টি হচ্ছে শত শত ধর্ষণ সেঞ্চুরিয়ান মানিকের।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের ছাত্রনেতা একশবার ধর্ষণের পর সেঞ্চুরি অনুষ্ঠান পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে। ইভটিজিং-এর শিকার হচ্ছে দেশের শত শত নারী, পরকিয়ার মাধ্যমে ভেঙে যাচ্ছে হাজারো সুখের সংসার, সম্ভ্রম হারাচ্ছে দেশের অগণিত মা-বোন, এসিড সন্ত্রাসের নির্মম শিকারে পরিণত হচ্ছে অসংখ্য তরুণী। এ হচ্ছে আকাশ-সংস্কৃতির নির্মম বাস্তবতা।

আকাশ সংস্কৃতি ও আমাদের করণীয়:

আকাশ-সংস্কৃতি মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ। মুসলমানদের বড় শক্তি ঈমান ও তাকওয়াকে ধ্বংস করে দিচ্ছে আকাশ-সংস্কৃতি। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ ও রাষ্ট্রনায়কদের বিরুদ্ধে অব্যাহত মিথ্যাচারের বিস্তার ঘটিয়ে একটি একটি করে মুসলিম দেশ সাম্রাজ্যবাদী ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি গ্রাস করে নিচ্ছে, মেতে উঠেছে নব্য ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায়। একদিকে বিনোদনের নামে নগ্নতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও নারীদেহের নগ্ন প্রদর্শনী; অপরদিকে তথ্যসন্ত্রাস চালিয়ে মুসলমানদেরকে কোণঠাসা করে ফেলার সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্রে মুসলিম উম্মাহ আজ দিশেহারা।

আরো পড়ুন : রচনা : মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের ভূমিকা

এহেন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুসলিম উম্মাহকে সমান্তরাল ইতিবাচক (Parallel positive) পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আকাশ-সংস্কৃতির মাধ্যমসমূহে (Media) নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে হবে। স্যাটেলাইট চ্যানেলসমূহে পর্যায়ক্রমে মুসলিম উম্মাহর শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব কায়েম করতে হবে। এসব প্রচার মাধ্যমে ইসলামের শাশ্বত সুন্দর আদর্শের শিল্পময় উপস্থাপন করার লক্ষ্যে সুযোগ্য ও প্রতিভাধর সাংস্কৃতিক কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। অশ্লীলতা, নগ্নতা ও আধুনিক জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শুরু করতে হবে। প্রকৃত ঘটনার বাস্তবানুগ উপস্থাপন করে পশ্চিমাদের তথ্যসন্ত্রাসের মোকাবেলায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে।

উপসংহার:

বর্তমান দুনিয়ায় আকাশ-সংস্কৃতির প্রচার মাধ্যমসমূহের প্রায় সবটাই দখল করে আছে ইসলামের শত্রুরা। বিশেষত পরাশক্তি ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়াসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদিরা। তাদের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী তাগুতি শক্তি কর্তৃক ইসলাম এবং মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলীন করার সর্বনাশা এক নীল-নকশা প্রণীত হয়েছে। সে নীল-নকশা অনুসারে সুপরিকল্পিতভাবে আকাশ-সংস্কৃতির আগ্রাসন পরিচালিত হচ্ছে। এমনি সংকটময় মুহূর্তে মুসলিম উম্মাহকে সবধরনের হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে বেতার টেলিভিশনের জগতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

Leave a Comment