আল্লাহ তাআলা মানুষের হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে এ পৃথিবীতে অনেক নির্বাচিত মহামানবকে প্রেরণ করেছেন। সে সকল মহামানবগণ নবী ও রাসূল হিসেবে পরিচিত। নিম্নে নবী ও রাসূলের পরিচয়, পার্থক্য ও ঈমানের তাৎপর্য বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো –
নবী শব্দের অর্থ কি ?
النَّبِيُّ শব্দটি نَبَأٌ ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত। এর অর্থ হলো – সংবাদদাতা, সংবাদ বাহক, অদৃশ্য জগতের দূত ইত্যাদি।
ইংরেজিতে : Prophet , Spokesman ইত্যাদি।
নবী কাকে বলে ?
শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর বিধি-বিধান সৃষ্টির নিকট পৌঁছানোর লক্ষ্যে আল্লাহর মনোনীত ও প্রেরিত ব্যক্তি এবং যিনি তার পূর্ববর্তী রাসূলের শরীয়তের অনুসারী ছিলেন তাকে নবী বলা হয়।
আরও পড়ুন : নবী করীম (সা) এর: জন্ম, নাম, বংশ পরিচয় ও মর্যাদা
রাসূল শব্দের অর্থ কি ?
رَسُولٌ শব্দটি পুংলিঙ্গ এবং فَعُولٌ ওজনে اِسْمُ المَصْدَرِ এর অন্তর্গত। এটা একবচন, বহুবচনে رُسُلٌ . আভিধানিক অর্থ হলো- বার্তা বাহক, প্রতিনিধি, প্রেরিত পুরুষ, দূত ইত্যাদি
ইংরেজিতে : Messenger, Envoy ইত্যাদি।
রাসূল কাকে বলে ?
শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর বিধি-বিধান সৃষ্টির নিকট পৌঁছানোর লক্ষ্যে আল্লাহর মনোনীত ও প্রেরিত ব্যক্তি এবং যিনি নতুন শরীয়তপ্রাপ্ত হয়েছেন তাকে রাসূল বলা হয়।
নবি ও রাসূল কারা ?
আল্লাহ তা’আলা যাঁদের প্রতি আসমানি কিতাব নাযিল করেছেন কিংবা নতুন শরিয়ত প্রদান করেছেন, তাঁরা হলেন রাসুল। আর যাঁদের প্রতি কোনো কিতাব অবতীর্ণ হয়নি কিংবা যাঁদের কোনো নতুন শরিয়ত দেওয়া হয়নি বরং যাদেরকে আল্লাহর বাণী প্রচারে মৌখিক নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে তাঁরা হলেন নবি। নবিগণ তাঁর পূর্ববর্তী রাসুলের শরিয়ত বা দীন প্রচার করেছেন। উল্লেখ্য, প্রত্যেক রাসুলই নবি; কিন্তু প্রত্যেক নবিই রাসুল নন ।
আরও পড়ুন : ওলির: অর্থ, সংজ্ঞা, মর্যাদা, মূল কাজ, বৈশিষ্ট্য, হাকীকত
নবি ও রাসূলগণের চরিত্র :
নবি-রাসুলগণ ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। সকল সৎ গুণাবলি তাঁরা অনুশীলন করতেন। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সৎ, সত্যবাদী এবং ন্যায়পরায়ণ। দয়া, ক্ষমা, ধৈর্য ইত্যাদি সবধরনের মানবিক গুণাবলি তাঁদের চরিত্রে বিদ্যমান ছিল। মিথ্যা, প্রতারণা, পরনিন্দা, হিংসা- বিদ্বেষ ইত্যাদি খারাপ স্বভাবের লেশমাত্র তাদের চরিত্রে কখনোই ছিল না।
বরং তাঁরা ছিলেন সৎস্বভাবের জন্য মানবজাতির অনুপম আদর্শ । তাই আমাদের জীবনকে তাঁদের জীবনের আলোকে গড়তে হলে তাঁদের চরিত্রের অনুসরণ করতে হবে। এছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর তাই আমরা তাদের চরিত্র অনুসরণ করব।
নবী ও রাসুলের মধ্যে ৫ টি পার্থক্য :
নবী | রাসুল |
---|---|
নবীগন সাধারণত একটি নির্দিষ্ট জনপদ বা সম্প্রদায়ের জন্য প্রেরিত হন। | আর রাসূল একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বা নতুন সম্প্রদায়ের জন্য প্রেরিত হয়, যাতে নতুন বিধান প্রচলিত হয়। |
নবীগণ মানুষকে সতর্ক করে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী , কিন্তু তিনাদের কাছে নতুন বিধান আনবার অধিকার নেই। | আল্লাহর নির্দেশে নতুন বিধান আনতে সক্ষম এবং তাদের বার্তা সর্বজনীনভাবে বাধ্যতামূলক। |
নবীদের সংখ্যা অনেক বেশি, ইসলামিক ইতিহাসে সকলের পরিচয় বিস্তারিতভাবে জানা নেই। | রাসুলের সংখ্যা তুলনামূলক কম, এবং তাদের নাম ও কাজ ইসলামের ইতিহাসে উল্লেখিত। |
সকল নবী রাসূল নন। | কিন্তু সকল রাসূলই নবী ছিলেন। |
নবীগণ সমাজে নৈতিকতা ও সতর্কতা প্রচারে গুরুত্ব দেন। | রাসুল নতুন আইন, নিয়ম ও ধর্ম প্রচারে গুরুত্ব দেন। |
নবী ও রাসূলগণের প্রতি ঈমানের অর্থ :
নবী ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনয়নের বিভিন্ন দিক ও অর্থ রয়েছে। যেমন-
১. নবী রাসূলগণের সংখ্যা : নবী রাসূলগণের বিস্তারিত বিবরণ মহান আল্লাহ জানাননি। নবী রাসূলগণের সংখ্যার বিষয়ে কোনো প্রসিদ্ধ হাদীস পাওয়া যায় না। মুসনাদে আহমদসহ বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত কয়েকটি হাদীসে এ বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। একাধিক হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসূলগণের সংখ্যা ছিল ৩১৩ বা ৩১৫ জন। এ সকল হাদীসের অধিকাংশই দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে।
আরও পড়ুন : সাহাবা অর্থ কি?সংজ্ঞা, আখলাক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
সুতরাং মুহাক্কিক আলেমগণ এ বিষয়ে সুনিশ্চিত কিছু না বলাই উত্তম বলে মত প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে মোল্লা আলী কারী (র) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স)-কে নবীগণের সংখ্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ১ লক্ষ ২৪ হাজার; তবে তাঁদের বিষয়ে কোনো সংখ্যা নির্ধারণ না করাই উত্তম ।
২. নবী রাসূলগণের নাম : পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত ২৫ জন নবীর ওপর আমরা বিশ্বাস রাখি। এছাড়া ওযায়ের (আ)-কে ইহুদিরা আল্লাহর পুত্র বলে দাবি করত বলে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর নবুয়ত সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।
৩. নবী ও রাসূলগণের জীবন বৃত্তান্ত : পবিত্র কুরআনের বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায়, কখনোই নবীগণের ব্যাপারে ঐতিহাসিক বা ভৌগোলিক তথ্য প্রদানকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি; বরং পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ২৫ জন নবীর মধ্যে কারো কারো বিষয়ে কিছু কিছু বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। যেমন- নূহ, ইবরাহীম, মুসা, ইউসুফ প্রমুখ। আর কারো কারো সম্পর্কে শুধু নবুয়তের উল্লেখ করেছেন ।
৪. তাঁরা সকলেই আল্লাহর বান্দা, মানুষ ও পুরুষ ছিলেন : নবীগণের মানবত্ব প্রমাণের জন্য আল্লাহ তাঁদের মানবীয় দিকগুলো উল্লেখ করেছেন। যেমন- তাঁদের খাদ্যগ্রহণ, বাজার করা, বিবাহ-শাদি, সন্তানগ্রহণ, মানবীয় সীমাবদ্ধতা, আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের বাইরে অলৌকিক কর্ম প্রদর্শন করতে না পারা ।
৫. সকল নবী রাসূলের দাওয়াত এক : সকল নবী রাসূলের মূল দাওয়াত ও ধর্ম ছিল এক ও অভিন্ন ইসলাম। তবে তাঁদের বিস্তারিত শরীয়ত ছিল যুগ ও সমাজ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন।
৬. তারা সকলেই আয়াত তথা মুজিযাপ্রাপ্ত ছিলেন : সকল নবী ও রাসূল আল্লাহর অহী এবং মুজিযা লাভ করেছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁরা অনেক মুজিযা তথা অলৌকিক কার্য প্রদর্শন করেছেন এবং অবিশ্বাসীদেরকে বিশ্বাসের পথে আহ্বান করেছেন।