শরীয়তের দ্বিতীয় মূলভিত্তি হলো আল হাদীস। এটা আল কুরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থ। রাসূল (স)-এর কথা, কাজ, আদর্শ ও গুণাবলি সবই মানুষের জন্য হেদায়াতস্বরূপ; যাকে বলা হয় হাদীস। তাই শরীয়তে হাদীসের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে প্রশ্নালোকে হাদীসের অর্থ, সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু আলোচনা করা হলো-
হাদিস (حَدِيثٌ) অর্থ কি ?
হাদিস এর আভিধানিক অর্থ : حَدِيثٌ শব্দটি اِسْمٌ তথা বিশেষ্য। একবচন, বহুবচনে أَحَادِيثُ মূল অক্ষর ح – د – ث জিনসে صَحِيحٌ এর আভিধানিক অর্থ হলো –
- القَوْلُ তথা কথা, বাণী।
- الوَعْظُ তথা উপদেশ।
- القِصَصُ তথা কাহিনী, ঘটনা।
- الخَبَرُ তথা সংবাদ বা খবর।
- الجَدِيدُ তথা নতুন।
- القُرْآنُ তথা আল কুরআন।
- النَّصِيحَةُ তথা উপদেশ।
- আধুনিক।
- অভিনব।
- সাম্প্রতিক।
- ضِدُّ القَدِيمِ তথা পুরাতনের বিপরীত।
আরও জানো : উসুলুল হাদিস:অর্থ,সংজ্ঞা,আলোচ্য বিষয়,উদ্দেশ্য,উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
হাদিস (حَدِيثٌ) কাকে বলে ?
সাধারণ অর্থে রাসূল (সাঃ), সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের বাণী এবং রাসূল (সাঃ ) এর কাজ ও মৌন সম্মতিকে হাদিস বলে।
ড. মাহমুদ আত তাহহান (র) বলেন –
الْحَدِيثُ مَا أُضِيفَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ أَوْ تَقْرِيرٍ – অর্থাৎ নবী কারীম (স) এর কথা, কাজ ও মৌনসম্মতিকে হাদিস বলে।
শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র) বলেন-
الْحَدِيثُ هُوَ مَا جَاءَ عَنِ الرَّسُولِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
হাদীসের প্রকারভেদ :
মূল হিসেবে হাদীস তিন প্রকার। যথা-
১। حَدِيثٌ مَرْفُوعٌ তথা মারফু হাদীস।
২। حَدِيثٌ مَوْقُوفٌ তথা মাওকুফ হাদীস।
৩। حَدِيثٌ مَقْطُوعٌ তথা মাকতু হাদীস।
১। حَدِيثٌ مَرْفُوعٌ তথা মারফু হাদীস :
আভিধানিক অর্থ : আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে مَقْطُوعٌ শব্দটি رَفْعٌ মাসদার থেকে اِسْمٌ مَفْعُولٌ এরوَاحِدٌ مُذَكَّرٌ এর সীগাহ। বাবে فَتْحٌ জিনসে صَحَّحَ অর্থ— উন্নত, সর্বোচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত, মর্যাদাবান ইত্যাদি ।
পারিভাষিক সংজ্ঞা :
যে সকল হাদীসের সনদ নবী করীম (স) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে حَدِيثٌ مَرْفُوعٌ বলে।
কতিপয় আলেম বলেন,
যে হাদীসের সনদ রাসূল (স) পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং কিতাব সংকলন পর্যন্ত কোনো বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েনি তাকে حَدِيثٌ مَرْفُوعٌ তথা মারফু হাদীস বলে।
উদাহরণ : যেমন- إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ
হুকুম : শরীয়তের দলীল হিসেবে মারফু হাদীস হাদীস গ্রহণযোগ্য। আর মারফু এর সাথে মাওকুফ এবং মাকতু হাদীসের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে মারফু হাদীস প্রাধান্য পাবে ।
আরও জানো : কুরআন ও হাদীসের : অর্থ , সংজ্ঞা ও পার্থক্য
২। حَدِيثٌ مَوْقُوفٌ তথা মাওকুফ হাদীস :
আভিধানিক অর্থ : আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে مَوْقُوفٌ শব্দটি الوَقْفُ মাসদার থেকে اِسْمُ مَفْعُولٍ এর وَاحِدٌ مُذَكَّرٌ এর সীগাহ। যার অর্থ- স্থগিত, মুলতবি, স্থিরকৃত, ওয়াকফকৃত ইত্যাদি।
পারিভাষিক সংজ্ঞা :
যে সকল হাদীস সাহাবীগণের কাছ থেকে এসেছে তথা সাহাবীদের কথা, কাজ ও স্বীকৃতিকে হাদীসে মাওকুফ বলে।
জমহুর মুহাদ্দিসীনের ভাষায়-
مَا انْتَهَى إِلَى صَحَابِيٍّ يُقَالُ لَهُ المَوْقُوفُ অর্থাৎ, যে হাদীসের সনদ সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছে স্থগিত হয়, মাওকুফ বলে।
উদাহরণ : যেমন – عَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ قَالَ: لَا قِرَاءَةَ مَعَ الإِمَامِ فِي شَيْءٍ
হুকুম : হাদিসে মাওকুফ যদি কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত না হয়, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। অন্যথা পরিত্যাজ্য হবে।
৩। حَدِيثٌ مَقْطُوعٌ তথা মাকতু হাদীস :
আভিধানিক অর্থ : مَقْطُوعٌ শব্দটি قَطْعٌ মাসদার থেকে اِسْمُ مَفْعُولٍ-এর وَاحِدٌ مُذَكَّرٌ -এর সীগাহ। এর আভিধানিক অর্থ- বিচ্ছিন্ন, কর্তনকৃত, পৃথক, বিচ্ছিন্ন, টুকরোকৃত ইত্যাদি ।
পারিভাষিক সংজ্ঞা :
যে হাদীসের সনদ তাবেয়ী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মাকতু হাদিস বলে ।
ড. মাহমুদ আত তাহহানের ভাষায়-
مَا أُضِيفَ إِلَى التَّابِعِيٍّ فَمَنْ دُونَهُ مِنْ قَوْلٍ أَوْ فِعْلٍ
কতিপয় আলেম বলেন,
যে হাদীসে তাবেয়ীর কথা, কাজ, মৌনসমর্থন ও গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে, তাকে হাদীসে মাকতু বলে ।
উদাহরণ : আবু হানীফা (র) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, অযুর মধ্যে নিয়ত শর্ত নয় ।
হুকুম : হাদিসে মাকতু সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য নয় । তবে যদি কোনো তাবেয়ীর ফতোয়া সাহাবীগণের যুগে খ্যাতিলাভ করে এবং এ ব্যাপারে শরীয়তের কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া না যায়; তাহলে এরূপ হাদিসে মাকতু গ্রহণযোগ্য হবে ।
আরও জানো : সনদ ও মতন: অর্থ, সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও উদাহরণ সহ বিস্তারিত
হাদীসের আলোচ্য বিষয় :
হাদীসের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে হাদীসবেত্তাগণের অভিমত নিম্নরূপ-
১. আল্লামা কিরমানী (র) বলেন-
مَوْضُوعُ الْحَدِيثِ ذَاتُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ حَيْثُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّهِ.
অর্থাৎ, হাদীসের আলোচ্য বিষয় হলো নবী করীম (স)-এর ব্যক্তিত্ব; এ হিসেবে যে তিনি হলেন আল্লাহর রাসূল ।
২. কারো মতে – مَوْضُوعُ الْحَدِيثِ أَقْوَالُ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَفْعَالُهُ
৩। একদল মুহাদ্দিসের মতে, হাদীসের আলোচ্য বিষয় মানুষ। কেননা হাদীস হলো মানুষের কল্যাণে এক সাবলীল দিকনির্দেশনা
হাদীসের উদ্দেশ্য :
হাদীসের প্রধান উদ্দেশ্য হলো বিশ্ব মানবতাকে পথভ্রষ্টতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করা। এর প্রমাণ হলো-
ক. মহান আল্লাহর বাণী- لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
ঘ. রাসূল (স)-এর বাণী- تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابُ اللَّهِ وَسُنَّةُ رَسُولِهِ
অর্থাৎ নবী করীম (স)-এর অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্য অর্জন করাই হচ্ছে মূলত হাদীসের উদ্দেশ্য।
পরিশেষে : পবিত্র কুরআনকে সুস্পষ্টভাবে অনুধাবনের ক্ষেত্রে হাদীসের বিকল্প নেই। ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্য হাদীসের অনুসরণ একান্ত অপরিহার্য।